সুদ উর্দু শব্দ। আরবি ভাষায় সুদের প্রতিশব্দ রিবা। বাংলাভাষায় ‘সুদ’ শব্দটি যেমন সুপরিচিত, তেমনি আরবি ভাষায়ও ‘রিবা’ শব্দের ব্যবহার বহুল প্রচলিত। রিবার আভিধানিক অর্থ বৃদ্ধি, আধিক্য, পরিবর্ধন, বেশি, স্ফীত, ইত্যাদি।
ইসলামী পরিভাষায়, লেনদেনের ক্ষেত্রে চুক্তির শর্তানুযায়ী শরিয়াহসম্মত কোনোরূপ বিনিময় ব্যতীত মূলধনের ওপর অতিরিক্ত যা কিছু গ্রহণ করা হয় তাকে সুদ বলে।
সুদের কারবার মহামারীর মতো সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। তৃণমূল থেকে নিয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ, সবাই এই অর্থনৈতিক ক্যানসারে আক্রান্ত। অবস্থা এমন হয়েছে যে, সুদের কারবার ছাড়া বড় মাপের কোনো কিছু করার কথা কল্পনাই করা যায় না। ঋণ চাইলে চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ ছাড়া কেউ দিতেও রাজি হয় না।
সুদ অর্থনৈতিক কাঠামোকে ঘুণে খাওয়া কাঠের মতো বিধ্বস্ত করে দিচ্ছে। ধনীকে আরো ধনী এবং গরিবকে আরো গরিব বানাতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।
সুদের কারণে এক দিকে মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে সম্পদ জমা হচ্ছে, অন্য দিকে সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী দিন দিন সর্বহারা হয়ে পড়ছে।
নবীজী সা: বলে গেছেন, ‘সাবধান! জাহেলিয়াতের প্রত্যেক বিষয় আমার দু’পায়ের নিচে।… জাহেলি যুগের ‘রিবা’ বাতিল। আর প্রথম রিবা, যা আমরা বাতিল করছি তা আমাদের রিবা; আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের রিবা। তা পুরোটাই বাতিল’। (সহিহ মুসলিম-১২১৮)
মুসলিম তো এমন হওয়া উচিত ছিল যে, একজন বিপদে পড়লে আরেকজন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। একজন ঋণগ্রস্ত হলে আরেকজন করজে হাসানা দিয়ে তার সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে। হজরত আবু হুরায়রা রা:-এর বর্ণনায় নবী মুহাম্মদ সা: ইরশাদ করেন, ‘এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার ওপর কোনো জুলুম করে না। তার সাহায্য ত্যাগ করে না। যে তার মুসলিম ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণে থাকে, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণে থাকেন। আর যেকোনো মুসলমানের একটি বিপদ দূর করবে, আল্লাহ তার কিয়ামতের দিনের বিপদসমূহ থেকে একটি বিপদ দূর করে দেবেন। ’ (সহিহ বোখারি : ২৪৪২)
ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে করজে হাসানা দেয়া, গরিব-দুঃখীদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসা, তাদের প্রয়োজন পূরণের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা এটাই প্রকৃত মুমিনের পরিচয়, এটাই মুমিনের কাছে তার ঈমানের দাবি। কিন্তু জাতি আজ তার ঈমানি দাবি পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে, নবীজীর আদর্শকে পেছনে ফেলে ধ্বংসের পথ বেছে নিচ্ছে।
বর্তমান পৃথিবীতে দু’ধরনের সুদি লেনদেন বেশি প্রচলিত। এক. মহাজনী সুদ, অর্থাৎ কেউ কোনো সাময়িক বা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে কারো কাছ থেকে ঋণ নিলে এর বিপরীতে ঋণের অতিরিক্ত যে অর্থ নেয়া হয়। দুই. বাণিজ্যিক সুদ, যা কোনো উৎপাদনমূলক কাজে গৃহীত ঋণের বিপরীতে নেয়া হয়। দুটোই সুদ, পবিত্র কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী দুটোই হারাম।
সুদের এই ভয়াবহতার মাঝে নতুন আতঙ্ক হয়ে হাজির-মাইক্রো ক্রেডিট বা ক্ষুদ্রঋণের আপদ। দেশের বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও ছোট উদ্যোক্তারা যেন কোনো কিছু করতে পারে এই লক্ষ্যে ক্ষুদ্রঋণ চালু করা হয়েছে এবং তা বেশ জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছে।
অভাবগ্রস্ত মানুষের অভাবকে কাজে লাগিয়ে চড়া সুদের কড়া শর্তে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে ঝুঁকিমুক্ত লাভজনক ব্যবসা পরিচালনার নাম ক্ষুদ্রঋণ।
ক্ষুদ্রঋণের নামে সুদি লোন বিতরণকারী প্রচুর ব্যাংক, সমিতি ও নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।
ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন এমন লোকের খোঁজ আছে কি-না তা বলা মুশকিল। বরং চোখের সামনেই দেখেছি, সুদ আদায় করতে না পেরে বহু পরিবার ভেঙে পড়েছে, বহু মানুষ ঘর ছেড়েছে, ভিটা হারিয়েছে।
সুদের শাস্তি : হজরত সামুরা ইবনে জুনদুব রা: থেকে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদিসে নবী কারীম সা:-এর একটি স্বপ্নের কথা বর্ণিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে-‘আমি দেখলাম আজ রাতে আমার কাছে দু’জন মানুষ আসল এবং তারা আমাকে একটি পবিত্র ভূখণ্ডে নিয়ে গেল। আমরা চলতে চলতে একটি রক্তের নদীর কিনারে গিয়ে উপস্থিত হলাম। সেই নদীতে একজন পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। আর নদীর কিনারে দাঁড়িয়ে আছে আরেকজন পুরুষ। তার সামনে রয়েছে পাথর। যখন নদীর লোকটি কিনারে উঠতে চায় তখন কিনারে থাকা লোকটি তার মুখে পাথর নিক্ষেপ করে। পাথরের আঘাতে লোকটি যেখানে ছিল সেখানে ফিরে যায়। এরপর সে আবারো নদীর কিনারে উঠতে চায়, এভাবে সে যখনই কিনারে উঠতে চায় তখনই তাকে পাথর মেরে যেখানে ছিল সেখানে ফিরিয়ে দেয়া হয়। আমি আমার সাথে থাকা লোকদের জিজ্ঞেস করলাম, রক্তের নদীতে অবস্থিত লোকটি, যার মুখের ওপর পাথর মেরে আপন জায়গায় ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে, সে লোকটি কে? তখন তাদের একজন আমাকে বললেন, এ লোকটি সুদখোর।’ (সহিহ বুখারি-১৩৮৬)
সুদ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার জীবনের তিনটি পর্যায়ে সুদের ভয়বহতা আঁচ করতে পারে। সুদ মানুষের তিনটি বিষয়ের উপর আঘাত হানে। প্রথমত: মানুষের ঈমানদারিতায়। অর্থাৎ সুদের কারণে সুদসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার অন্যতম পরিচয় ঈমানদার হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করা থেকে বঞ্চিত হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের যা অবশিষ্ট আছে, তা পরিত্যাগ করো, যদি তোমরা মুমিন হও। কিন্তু যদি তোমরা তা না করো তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা নাও, আর যদি তোমরা তাওবা করো, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই থাকবে। তোমরা জুলুম করবে না এবং তোমাদের প্রতি জুলম করা হবে না।’ (বাকারা : ২৭৮-২৭৯)
সুতরাং একজন মুমিনের কখনোই সুদের সাথে জড়িত হতে পারে না, স্পষ্ট বা পরোক্ষ কোনোভাবেই সুদকে সাপোর্ট দিতে পারে না।
দ্বিতীয় : পরকালীন মুক্তির বিষয়ে অর্থাৎ পরকালীন জীবনে আল্লাহর অপূর্ব নেয়ামত জান্নাত লাভের পরিবর্তে জাহান্নামে নিপতিত হওয়াকে নিশ্চিত করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা সুদ খায় তারা সেই ব্যক্তির ন্যায় দাঁড়াবে যাকে শয়তান স্পর্শ দ্বারা জ্ঞানশূন্য করে দিয়েছে। এজন্য যে, তারা বলে ক্রয়-বিক্রয় তো সুদের মতোই। অথচ আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম। যার কাছে রবের এ নির্দেশ এসেছে এবং সে বিরত হয়েছে। তবে অতীতে যা হয়েছে তা তারই এবং তার ব্যাপার আল্লাহর এখতিয়ারে। আর যারা আবার আরম্ভ করবে তারাই জাহান্নামি। সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে।’ (সূরা বাকারা : ২৭৫)
তৃতীয়ত : অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর, অর্থাৎ সুদ যদিও বেশি দেখায়, কিন্তু এর পরিণতি কমতির দিকে। সুদ সম্পদের বরকতহীনতাকে ত্বরান্বিত করে। সম্পদের মুখ্য উদ্দেশ্য তথা সুখ শান্তি থেকে মানুষকে বঞ্চিত করে। পবিত্র কুরআনে এসেছে, ‘সুদকে আল্লাহ কমিয়ে দেন এবং দানকে বর্ধিত করেন।’ (সূরা বাকারা : ২৭৬) অর্থাৎ তার একূল ওকূল সব কূলই বৃথা।
বিভিন্ন ধর্ম ও মতবাদে সুদ
কুরআন-সুন্নাহর বাইরে বিভিন্ন ধর্মেও সুদ নিষিদ্ধ ছিল। তাওরাত, ইনজিল, বেদ প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থ, বিভিন্ন মতবাদ বা দর্শনে সুদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ এক্সডোসে এর ২২ স্তবকে বলা হয়ছে, ‘তোমরা যদি আমার কোনো লোককে অর্থ ধার দাও যারা গরিব, তবে তোমরা তার মহাজন হবে না এবং তার কাছ থেকে সুদ আদায় করবে না।’
খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থ ‘ডিউটারোনোমির’ ২৩ স্তবকে বলা হয়েছে, ‘তোমরা তোমাদের ভাইকে সুদে ধার দেবে না, অর্থের ওপর সুদ, খাদ্যসামগ্রীর ওপর সুদ এবং যেকোনো জিনিস যা ধার দেয়া যায়, তার ওপর সুদ।’
হিন্দুধর্ম বেদে বলা হয়েছে, ‘সুদখোরের বাড়িতে যেয়ো না।’
প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো তার ‘লজ’ নামক গ্রন্থে সুদের নিন্দা করেছেন। তিনি সুদকে মানবতাবিরোধী, অন্যায় ও জুলুম এবং কৃত্রিম ব্যবসা বলে তীব্রভাবে এর বিরোধিতা করেছেন। বিখ্যাত দার্শনিক অ্যারিস্টটলও কঠোর ভাষায় সুদের নিন্দা করেছেন। তিনি অর্থকে বন্ধ্যা মুরগির সাথে তুলনা করেছেন, যা ডিম দিতে পারে না। তিনি আরো বলেছেন, ‘অর্থ কোনো অর্থ সৃষ্টি করতে পারে না।’ অ্যারিস্টটল আরো বলেন, ‘অন্যান্য পণ্যের মতো অর্থ কেনাবেচা করা একটি কৃত্রিম ও জালিয়াতি ব্যবসা।’
বস্তুত: যে ব্যক্তি টাকার মাধ্যমে সুদি লেনদেনে জড়িয়ে থাকে সে মূলত তার সৃষ্টির রহস্যের সম্পূর্ণ বিপরীত কাজ করে। অন্যায় ও নীতিহীন কাজে সম্পৃক্ত থাকে। কেননা টাকা/মুদ্রার সৃষ্টি অন্যান্য জিনিস অর্জনের জন্য। সে তো সত্তাগতভাবে উদ্দেশ্য হওয়ার জন্য সৃজিত হয়নি। এজন্য যে ব্যক্তিই মুদ্রা বেচাকেনা শুরু করে দিয়েছে এবং তার মাধ্যমে ব্যবসা বাণিজ্য আরম্ভ করেছে সে মুখ্য উদ্দেশ্যের বাইরে মুদ্রাকে একটি উদ্দেশ্যের জিনিস এবং ব্যবসার মাল বানিয়ে নিয়েছে। অথচ মুদ্রাকে তার উদ্দেশ্যের বাইরে অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা সম্পূর্ণ বেআইনি। নীতি বিবর্জিত কাজ।
মুমিন মুসলমানের উচিত, সুদের লেনদেনের সাথে কোনো সম্পর্ক না রেখে ব্যবসা করে হালাল পন্থায় জীবিকা নির্বাহ করা। দুনিয়ার জীবনে সুদসহ আল্লাহর সব নিষেধাজ্ঞাকে নিজেদের জীবনে মেনে চলা। সুদ পরিহার করা। সুদের ভয়াবহতা ও শাস্তি থেকে নিজেদের হেফাজত করা। কুরআনের বিধান মোতাবেক জীবন পরিচালনা করা।
সুতরাং ‘সুদ’কে ‘না’ বলুন। ব্যবসাকে ‘হ্যাঁ’ বলুন। কল্যাণের জীবিকা পেতে দান করুন। কষ্ট যত বেশিই হোক না কেন; প্রয়োজন যত বেশিই হোক না কেন; নিজের প্রয়োজন ও কষ্টের কথা মহান আল্লাহকে বলুন। তিনিই সব সমস্যার সমাধান করে দেবেন। ধারণাতীত জায়গা থেকে দান করবেন সাহায্য ও রিজিক, ইনশাআল্লাহ।
লেখক : শিক্ষার্থী, উচ্চতর গবেষণা বিভাগ, শায়েখ জাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, ঢাকা ।
Leave a Reply