ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে আমেরিকার প্রতিরক্ষা বিভাগের বেশ কিছু নথি, মানচিত্র, বিভিন্ন নকশা ও ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে।
অনলাইনে ফাঁস হওয়া এসব কাগজপত্রের মধ্যে রয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধের বিস্তারিত ধারাবাহিক টাইমলাইন এবং অসংখ্য দুর্ভেদ্য সামরিক সংক্ষিপ্ত শব্দসহ কাগজপত্র, যার ওপরে ‘অত্যন্ত গোপনীয়’ শব্দ লেখা রয়েছে।
কী ধরণের প্রভাব এর?
এসব নথিতে জানা যাচ্ছে, উভয় পক্ষের কতজন হতাহত হয়েছে। দু’পক্ষের সামরিক দুর্বলতাগুলো কী? বিশেষ করে তাদের সামরিক শক্তির দিকগুলো কী হতে পারে? এসব তথ্য ফাঁস হলো এমন এক সময়, যখন ইউক্রেন তাদের বহু প্রত্যাশিত বসন্তকালীন পাল্টা অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এসব কাগজপত্র এবং ছবি মূলত কতটা মূল? আমরা এ পর্যন্ত যা জানি, তার বাইরে এগুলো আমাদের নতুন কী তথ্য দিচ্ছে?
প্রথম বিষয়টি হলো, ইউক্রেনে ১৪ মাস আগে রাশিয়া পুরোদমে হামলা শুরু করার পর এটা হচ্ছে আমেরিকান তথ্যের সবচেয় বড় ফাঁস হওয়ার ঘটনা। এর কিছু কিছু কাগজপত্র ছয়মাস পর্যন্ত পুরনো, কিন্তু এগুলোর বিশাল প্রভাব রয়েছে।
পেন্টাগনের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, কাগজপত্রগুলো জাল নয়, মৌলিক। এসব দলিলের অন্তত একটির তথ্য পরবর্তীতে পরিবর্তন করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে শতাধিক কাগজপত্রের মধ্যে এটাকে তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ বলে বর্ণনা রয়েছে।
এরকম ২০টি নথি বিবিসির হাতে রয়েছে। ইউক্রেনের বাহিনীকে যেসব সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে, সেগুলোর বিশদ বর্ণনা রয়েছে এতে। একইসাথে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে নতুন একটি আক্রমণ পরিচালনা করার জন্য ইউক্রেনের বেশ কিছু ব্রিগেডকে একত্রিত করার বর্ণনাও রয়েছে।
এসব নথিতে বলা হয়েছে, কখন এসব ব্রিগেড আক্রমণের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হবে। সেগুলোর জন্য পশ্চিমা মিত্রদের দেয়া ট্যাঙ্ক, আর্মড গাড়ি এবং কামানের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে।
তবে সেখানে এটিও উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহের সময়ের ওপরে প্রশিক্ষণ এবং প্রস্তুতির’ বিষয়গুলো নির্ভর করবে। একটি মানচিত্রে একটি এলাকাকে ‘কাদা-বরফে আচ্ছাদিত এলাকা’ বলে বলা হয়েছে, যার মাধ্যম বসন্ত এগিয়ে আসার সাথে সাথে পূর্ব ইউক্রেনের স্থল পরিস্থিতি বর্ণনা করা হয়েছে।
এই শীতেই ইউক্রেনের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা পর্যন্ত হামলা মোকাবেলা করেছে। সেখানে কিয়েভের ক্রমশ কমতে থাকা বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষমতার একটি গভীর বিশ্লেষণও রয়েছে।
ইউক্রেন তার সীমিত বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষমতা ব্যবহার করে একইসাথে বেসামরিক নাগরিক, গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো এবং যুদ্ধের সামনের সারিতে থাকা সৈন্যদের সুরক্ষা দিতে চায়।
ফাঁস হওয়া এসব নথিপত্রে রাষ্ট্র হিসেবে শুধুমাত্র ইউক্রেনের অবস্থাই তুলে ধরা হয়নি, সেখানে ওয়াশিংটনের আরো কিছু মিত্রের বিষয়েও তথ্য রয়েছে। ইউক্রেন ইস্যুতে ইসরায়েল থেকে দক্ষিণ কোরিয়া পর্যন্ত দেশগুলোর মধ্যেকার অভ্যন্তরীণ বিতর্কের বিষয়টিও এসব নথিকে উঠে এসেছে। এর মধ্যে কিছু কাগজপত্র ‘চরম গোপনীয়’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। আবার কিছু নথিপত্রের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, এগুলো আমেরিকার ঘনিষ্ঠ গোয়েন্দা সহযোগীদের সাথে ভাগাভাগি করা যাবে।
এসব তথ্য কতটা নতুন?
ফাঁস হওয়া কাগজপত্রে যেসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, তার অনেক কিছুই আগে থেকেই জানা। এখানে পার্থক্য হলো, সেগুলোর অনেক বিস্তারিত রয়েছে এবং সবকিছু একটি স্থানে পাওয়া যাচ্ছে। যেমন, হতাহতের কথাই ধরা যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা অনুযায়ী যুদ্ধে এক লাখ ৮৯ হাজার ৫০০ থেকে দুই লাখ ২৩ হাজার রাশিয়ার সৈন্য নিহত বা আহত হয়েছে।
ইউক্রেনের শিবিরেও অনেকটা কাছাকাছি হতাহতের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে এক লাখ ২৪ হাজার ৫০০ থেকে এক লাখ ৩১ হাজার। সাম্প্রতিক সময়ে হতাহতের বিষয়ে সাংবাদিকদের যেসব সংখ্যা জানানো হয়েছে, ফাঁস হওয়া নথিপত্রের হতাহতের সংখ্যার সাথে তার মিল আছে।
তবে উভয় ক্ষেত্রে পেন্টাগনের বক্তব্য হচ্ছে, এই সংখ্যার ওপর তাদের আস্থা খুবই কম। কারণ সেখানে তথ্যের ঘাটতি, অভিযানের নিরাপত্তা এবং উভয় পক্ষ থেকেই বিভ্রান্তি তৈরির চেষ্টার অবকাশ রয়েছে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এসব নথিপত্র কারা ফাঁস করেছে এবং কেন?
‘এখানে কিছু ফাঁস হওয়া নথিপত্র আছে’
কীভাবে এসব নথিপত্র ডিসকর্ড নামের একটি ম্যাসেঞ্জিং অ্যাপ থেকে ফোরচ্যান হয়ে টেলিগ্রামে গেছে, সেটা বর্ণনা করেছেন ইনভেস্টিগেটিভ ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ বেলিংক্যাটের এরিক টোলার।
তিনি বলেছেন, ঠিক কোথা থেকে এসব তথ্য এসেছে, সেটা এখনো জানা যায়নি। তবে গেমারদের কাছে জনপ্রিয় একটি সাইটে গত মার্চ মাসে এসব নথিপত্র প্রকাশ করা হয়।
কম্পিউটার গেম মাইনক্রাফটের একদল খেলোয়াড়ে ম্যাসেঞ্জিং প্ল্যাটফর্ম ডিসকর্ডে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে তর্কবিতর্ক করছিল। এই সময় একজন বলেন, ‘এই দেখো, এখানে কিছু ফাঁস হওয়া তথ্য নথিপত্র আছে।’ এরপর তিনি ১০টি নথি পোস্ট করেন। এভাবে নথিপত্র ফাঁস বিরল হলেও একেবারে নতুন কিছু নয়।
যুক্তরাজ্যের ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য বাণিজ্য চুক্তির নথিপত্র এভাবে রেডিট, ফোরচ্যান এবং অন্য সাইটে প্রকাশ করা হয়েছিল। ওই সময় রেডিট জানিয়েছিল, এসব নথিপত্র রাশিয়া থেকে এসেছে।
গত বছর আরেকটি ঘটনায় অনলাইন গেম ওয়ার থান্ডারের খেলোয়াড়রা বেশ কিছু স্পর্শকাতর সামরিক নথিপত্র প্রকাশ করেছিল। নিজেদের মধ্যে তর্কে জেতার জন্য এটা করেছিল বলে মনে করা হয়। তবে সর্বশেষ এসব নথি ফাঁসের ঘটনা অনেক বেশি স্পর্শকাতর এবং অনেক বেশি ক্ষতিকর।
নিজেদের ‘অভিযানের নিরাপত্তার’ বিষয়গুলো ইউক্রেন অনেক বেশি গুরুত্বের সাথে দেখে থাকে। ফলে এরকম স্পর্শকাতর তথ্য অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ছে, সেটা তাদের ভালো লাগার কথা নয়।
ইউক্রেন যে ‘বসন্তকালীন আক্রমণের’ পরিকল্পনা করছে, সেটা এই যুদ্ধের চিত্র বদলাতে এবং পরবর্তীতে শান্তি আলোচনায় নিজেদের অবস্থান জোরালো করে তুলতে পারে। কিয়েভের কর্মকর্তারা বহুদিন ধরেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টার কথা বলছেন।
তবে সামরিক ব্লগাররা মনে করেন, এটা পশ্চিমাদের একটি প্লটও হতে পারে, যার মাধ্যমে তারা রাশিয়ার সেনা কমান্ডারদের বিভ্রান্ত করতে চায়। তবে সত্যি কথা বলতে, এসব কাগজপত্রের মধ্যে এমন কোনো তথ্য নেই, যা ইউক্রেনের বসন্তকালীন আক্রমণকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
ইউক্রেনের যুদ্ধ প্রস্তুতির ব্যাপারে হয়তো এর মধ্যেই একটি ধারণা পেয়ে গেছে রাশিয়া (যদিও পুরো যুদ্ধ জুড়েই তাদের গোয়েন্দা ব্যর্থতার চিত্র পরিষ্কার হয়ে উঠেছে)। তবে সবচেয়ে ভালো সাফল্য পেতে হলে তাদের আক্রমণের বিষয়ে নিয়ে প্রতিপক্ষ কী ভাবছে, সেই সম্পর্কেও কিয়েভকে আগেভাগে একটা ধারণা করতে হবে।
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply