বইমেলা এখন উৎসবে পরিণত হয়েছে। বইকে ঘিরে এ রকম আয়োজন ব্যতিক্রমী, গর্ব ও গৌরবেরও বটে। বইমেলার মধ্য দিয়ে উন্মোচিত হয় আমাদের বৌদ্ধিক রূপ। বইমেলা ফি বছর যেভাবে ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে, লেখক-প্রকাশকের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে। বৌদ্ধিক সংস্কৃতি কি সেভাবে বিকশিত হচ্ছে, বৌদ্ধিকতার সার্বিক রূপের কি পরিবর্ধন-পরিযোজন হচ্ছে, নাকি অবনমন ঘটছে? এসব প্রশ্ন তালাশ করা জরুরি জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই। কেননা বৈশি^ক জ্ঞানসূচকে আমাদের অবস্থান তলানিতে। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ায়ও আমরা সবার থেকে পিছিয়ে রয়েছি।
শুধু কি বৈশ্বিক জ্ঞানসূচক? যেসব সূচক জাতিকে বিশ^মাঝারে শক্তভাবে দাঁড়ানোর শক্তি ও সাহস জোগায়, তার সবগুলোতে আমাদের অবস্থান হতাশাজনক। এই অবস্থায় বইমেলাকে ঘিরে মাসব্যাপী যে উৎসব তা সংখ্যাগত দিকে আমাদের আনন্দ ও সন্তুষ্টি জোগালেও তলিয়ে দেখা উচিত বইমেলা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিকে ইতিবাচকতার দিকে কতটা প্রভাবিত করছে।
অমর একুশে বইমেলা শুধু উৎসবমুখর হয়নি, কয়েক দশকে এর নিজস্ব একটা অর্থনীতিও দাঁড়িয়ে গেছে। ফি বছর লেখক-প্রকাশকের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি বইমেলাকেন্দ্রিক অর্থনীতিরও নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা উন্মোচিত হয়েছে। এসবই সুখের কথা, আনন্দের বারতা। এই সুখ, এই আনন্দ সদর্থক অর্থেই দেশ ও জাতির জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিত, যদি বইমেলা আমাদের বৌদ্ধিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কার্যকর ও সন্তোষজনক অবদান রাখতে সক্ষম হতো। বেদনার জায়গা হলো, সেটা তো হচ্ছে না, উল্টো তার অবনমন ঘটছে। এ ব্যাপারে ব্যক্তি পর্যায়ে, প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোথাও কোনো হেলদোল নেই।
বইমেলায় প্রতিবছর কয়েক হাজার বই প্রকাশিত হয়। সংখ্যাটায় হেরফের আছে, কিন্তু তা যে কমপক্ষে তিন হাজার মতান্তরে পাঁচ হাজারের মতো তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ কম। এর মধ্যে বেশিরভাগ বই গল্প-উপন্যাসের। নানাধর্মী বই থাকলেও মেলায় সবচেয়ে কম প্রকাশিত হয় প্রবন্ধের বই। আবার প্রবন্ধের বইয়ের নামে প্রাবন্ধিকদের একটা বড় অংশ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তাৎক্ষণিক পাঠক চাহিদার জন্য লেখা নিবন্ধগুলোকেই প্রবন্ধ বলে চালিয়ে দেন। আরও একটা আছে, যারা পদোন্নতির জন্য লেখা আর্টিকেলকে প্রবন্ধের বই হিসেবে প্রকাশ করেন। প্রকৃতার্থে প্রবন্ধের বই যাকে বলা হয়, সত্যিকারার্থে সেই ধরনের বই প্রকাশিত হয় খুবই কম। অথচ একটা জাতির মনন গঠনে, বৌদ্ধিক সংস্কৃতির বিকাশে প্রবন্ধের বইয়ের ভূমিকা থাকে সবচেয়ে বেশি। অন্য বইয়ের ভূমিকাও থাকে, তবে সেটা একেবারেই গৌণ।
বইমেলায় বাংলা একাডেমি প্রতিবছর আলোচনার অনুষ্ঠান করেন মাসজুড়েই। বিভিন্ন বিষয়ের ওপর প্রবন্ধ পাঠ আলোচনা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। এতে দর্শক উপস্থিতি থাকে যৎসামান্য। এর কারণ কী, বিষয়ের দুর্বলতা, আলোচকদের দুর্বলতা, নাকি আয়োজকদের দুর্বলতা এর কারণ অনুসন্ধান জরুরি। প্রাবন্ধিক ও আলোচক হিসেবে যারা থাকেন প্রতিবছর তারাই থাকেন। কাটকপি পেস্টের মতো ব্যাপারটা দাঁড়িয়ে গেছে। একাডেমির মহাপরিচালক পরিবর্তন হন। কিন্তু এসবের গতানুগতিকতার কোনো পরিবর্তন হয় না।
যে দেশে এক মাস ধরে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয় সে দেশে কেন ফি বছর আন্তর্জাতিক বইমেলা অনুষ্ঠিত হয় না, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। এমনকি বাংলা ভাষাভাষীদের নিয়েও একটা বইমেলা অনুষ্ঠিত হতে পারে। যেখানে হাজির করা যেতে পারে ভারতের একাধিক রাজ্যের বাংলা ভাষাভাষী প্রকাশনের বই। মোট কথা শুধু ফেব্রুয়ারিতে এক মাসজুড়ে বইমেলা করলে হবে না। বছরজুড়েই নানা ধরনের বইমেলার আয়োজন করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, আয়োজনের মধ্যে যেন একটা বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। জ্ঞানবিনিময় যে বইমেলার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক সেটাকে মান্যতা দিতে হবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। মেলার যারা আয়োজক এবং অংশীজন উভয় পক্ষকে স্বীকার করতে হবে যে, এ ধরনের মেলার আয়োজনে উৎসবের আমেজটা দেওয়ার নেপথ্যের কারণ হলো জ্ঞান উৎপাদন করা, জ্ঞানের সমৃদ্ধি ও বিকাশ ঘটানো।
সময় যত গড়াচ্ছে বইমেলার আয়োজনের সার্থকতা তত বেশি প্রশ্ন বাড়ছে। মেলা আয়োজনে বাংলা একাডেমি সম্পূর্ণ ব্যর্থ এ কথা জোরদারভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। বাংলা একাডেমির কাজ মেলা আয়োজন করা না হলেও এর সঙ্গে যেহেতু নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা ও অর্থযোগের ব্যাপার রয়েছে, এ কারণে বাংলা একাডেমি কখনই চাইবে না এ রকম ‘লক্ষ্মী’ তাদের হাতছাড়া হয়ে যাক। আবার এটাও ভেবে দেখা দরকার, আয়োজনটা বাংলা একাডেমির বাইরে গেলে যতটুকু মান আছে ততটুকুও আদৌ ধরে রাখা যাবে কি। আমাদের বৌদ্ধিক সংস্কৃতির এটাও একটা দুর্বল দিক যে, আমরা যথোচিত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।
বইমেলায় প্রতিবছরই কোনো না কোনো অঘটন ঘটে। হুমায়ুন আজাদ, অভিজিৎ রায় হামলার শিকার হয়েছেন এই বইমেলায়ই। হুমায়ুন আহত হওয়ার কিছুদিন পর মারা গেলেও অভিজিতের ঘটনাস্থলেই প্রাণনাশ হয়েছে। প্রকাশনীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা, বই নিষিদ্ধের ঘটনাও ঘটেছে। এ বছর আদর্শ প্রকাশনীকে বইমেলায় স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। তাদের প্রকাশিত তিনটি বইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছে। ব্যাপারটা আদালত পর্যন্ত গড়ালেও শেষ পর্যন্ত আদর্শকে স্টল না দেওয়ার সিদ্ধান্তই বহাল থেকেছে। বইমেলার মাঝামাঝি সময়ে এসে নিষিদ্ধ করা হয়েছে জান্নাতুন নাঈম প্রীতির আত্মজীবনীমূলক বই ‘যোনী ও জন্মের ইতিহাস।’ এসব ঘটনায় অসহিষ্ণুতার দিকটাই উন্মোচিত হলো কিনা সেটা ভেবে দেখা জরুরি। গণতান্ত্রিক ও বৌদ্ধিক সমাজের সৌন্দর্য হলো পরমতসহিষ্ণুতা। এসব ঘটনা সেসবকে প্রশ্নবিদ্ধ করে কিনা তা গভীরভাবে ভেবে দেখা জরুরি।
এ কথা সর্বৈবভাবে সত্যি যে, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের আর্থসামাজিক খাতে প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। বিশেষ করে যোগাযোগব্যবস্থা, তথ্যপ্রযুক্তি, স্থাপনা ও অবকাঠামোগত দিকে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে আশাতীত। সেসবে অবকাঠামোগত উন্নয়নও হয়েছে। যুক্ত হয়েছে শিক্ষাসহায়ক নানারকমের সুযোগ-সুবিধা। শিক্ষকের সংখ্যাও বেড়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ। কিন্তু আসল জায়গাটায় আশাব্যঞ্জক উন্নতি তো হয়নি, উপরন্তু ভর করেছে হতাশা ও লজ্জার অধ্যায়। শিক্ষার মান না বাড়িয়ে বিষয়টিকে খেলো ও গুরুত্বহীন করে তোলা হয়েছে।
আমাদের এসব শিক্ষার্থী যখন নানা দায়িত্বে যুক্ত হবে তখন আমাদের জ্ঞানকাঠামোর অবস্থা আরও বেশি শোচনীয় ও করুণ হয়ে উঠবে। বৈশ্বিক জ্ঞানসূচকে আমরা তখন আরও পিছিয়ে পড়ব। এমনিতেই আমরা আছি তলানিতে, তার পর যদি আরও পিছিয়ে পড়ি তা হলে সেটা কতটা বেদনার হবে তা ভাবা দরকার এখনই।
আমাদের মাসব্যাপী বইমেলা হয়। আমাদের হাজারে হাজার বই প্রকাশিত হয়। বইমেলায় কয়েকশ কোটি টাকার বই বেচা হয়। কবি-লেখকদের ভিড়ে ফেসবুকে ঢুঁ মারা যায় না। তা হলে বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গায় কেন আমরা আশাবাদ দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছি। এর অর্থ হলো যা হচ্ছে, সংখ্যাগত জায়গায় হয়তো ঠিক আছে। কাজের জায়গায় নয়, প্রকৃতার্থে তো নয়ই।
এই অবস্থা কারও জন্য স্বস্তির নয়। এখান থেকে বেরোতে হবে। যা করতে পারে কেবল সমাজ-রাষ্ট্রের বৌদ্ধিক মানুষগুলোই। ডেল কার্নেগীর ফিরে আসার রমরমা সময়ে এখন খালি কথাবাজি আর উপদেশের ফর্দ হাজির করার বাহাদুরি। কথাবাজি দিয়ে বৌদ্ধিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো যায়নি। তার জন্য প্রয়োজন কাজ। দরকার সঠিক ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। স্থাপনা আর অবকাঠামোর উন্নয়ন তো অনেক হলো, এখন সময় মানুষের দিকে মনোযোগ দেওয়ার। তার সুকুমারবৃত্তি ও উদ্ভাবনী শক্তিকে জাগিয়ে তোলা। প্রযুক্তিগত ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার। এসবের জন্য প্রত্যেকের থাকা দরকার একটা দরদি মন। এই মন ব্যক্তি ও রাষ্ট্র পর্যায়ে কাজ করবে সবার জন্য, সমতার ভিত্তিতে ন্যায্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। সেই কাজে থাকবে দরদের ছোঁয়া, বৌদ্ধিক প্রেম, দূরদর্শিতা ও সর্বপ্রাণের কল্যাণের জন্য প্রয়াস ও প্রচেষ্টা।
এসব যদি সম্ভবপর হয় তবেই বইমেলার ফি বছরের এই আয়োজন আরও সার্থক ও অর্থবহ হবে। বৌদ্ধিক সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গাতেও ঘটবে ইতিবাচক পরিবর্তন।
ড. কাজল রশীদ শাহীন : সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও গবেষক
Leave a Reply