করোনায় কৃষকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ফুলচাষিরা। যশোরের গদখালী, মাগুরা কিংবা সাভারের গোলাপ গ্রামের ফুলচাষিরা মাঠের পর মাঠের ফুল ফেলে দিয়ে নষ্ট করেছেন। ভীষণ দুঃসময় কাটিয়ে তারা আবার দাঁড়িয়েছেন। তারা মাঠে নেমেছেন, ফুলে ফুলে ভরিয়েছেন বাগান। পুরোদমে শুরু হয়েছে ফুলবাণিজ্য।
বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষের ইতিহাস খুব একটা পুরনো নয়। আশির দশকে যশোরের ঝিকরগাছায় যে বিপ্লবের শুরু হয়েছিল, তা এখন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এর আগে ফুলের বাজার দখল করে রেখেছিল ভারত। মনে পড়ে আমার বিয়ের সময়কার কথা। বন্ধু নান্নু তখন বাংলাদেশ বিমানের ইঞ্জিনিয়ার। এই সূত্রে তাকে নিয়মিত ঢাকা-কলকাতা করতে হতো। ওই সময় এ দেশে ভিসিআরে হিন্দি সিনেমার রমরমা অবস্থা। সিনেমায় বিয়ের দৃশ্য মানেই বর-কনের গলায় রজনীগন্ধা-গোলাপ ফুলের মোটা মালা। এ দৃশ্য সবার মনে গেঁথে গিয়েছিল। আর আমাদের দেশে বিয়েতে মালাবদল হতো জরির মালায়। নান্নুকে বলেছিলাম কলকাতা থেকে ফেরার সময় রজনীগন্ধা ফুলের দুটি মালা আনার জন্য। এনে দিয়েছিল। ওই মালা দিয়েই হয়েছিল আমার মালাবদল। যাক সে কথা।
বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গেই ফুল এখন নিত্যদিনের চাহিদার একটি অংশ। শুভেচ্ছা বিনিময় তো আছেই, ফুল ছাড়া কোনো উৎসব কিংবা অনুষ্ঠানের কথা কল্পনাও করা যায় না। তাই ফুল এখন গুরুত্বপূর্ণ এক কৃষিপণ্য।
বাংলাদেশে ফুল চাষের ইতিহাস টানলে আনতে হবে শের আলী সরদারের কথা। ১৯৮৩ সালে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালীতে তিনি মাত্র ৩০ শতক জমিতে প্রথম চাষ শুরু করেন রজনীগন্ধা ফুলের। এর মধ্য দিয়ে দেশে শুরু হয় বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ ও বিপণন। গদখালীকে এখন বলা হয় ‘ফুলের রাজধানী’। সেখানে মাঠের পর মাঠজুড়ে দেখা যায় নানা রঙের, বর্ণিল জাতের ফুল। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে গদখালীর ৭৫টি গ্রামের ৫ হাজার চাষিসহ ৫ লাখ মানুষ ফুল উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত। সারাদেশে ২৪টি জেলার প্রায় ১২ হাজার একর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ হচ্ছে। ফুল চাষ এবং ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২০ লাখ মানুষ জড়িত। বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকার ফুলের বাজার তৈরি হয়েছে দেশে। বর্তমানে যশোর ছাড়াও ঢাকার সাভার, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, সাতক্ষীরা, কুমিল্লা প্রভৃতি অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ হচ্ছে।
ফুল চাষে কৃষকের এই বিপ্লব খুব কাছ থেকে দেখেছি। বিটিভির সেই ‘মাটি ও মানুষ’ থেকে ফুল চাষের এই বিস্তার নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে এসেছি বিভিন্ন সময়ে। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ইউরোপিয়ান কাট ফ্লাওয়ার যেমন: ক্রিসেনথিমাম, জারবেরা, কার্নিশা, টিউলিপ ফুলগুলো যার হাত ধরে চাষ এবং পরে সম্প্রসারিত হয়, তার প্রধান কারিগর বেলজিয়ান উন্নয়নকর্মী জন পল পেরিন। ফুল নিয়ে কাজের সূত্রে তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব। পুরো বিশ্বের ফুলবাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র ফ্লোরা হল্যান্ড, রয়েল ভ্যানজান্টিসহ বিভিন্ন এলাকার ফুল চাষ ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম তুলে ধরেছি চ্যানেল আইয়ের ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে। এরও আগে ২০০৬ সালে চীনের কুনমিংয়ে জারবেরা ফুলের আবাদ ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম আপনাদের সামনে তুলে ধরেছিলাম, এমনকি পূর্ব আফ্রিকার দেশ উগান্ডায় গ্রিন হাউসে বড় পরিসরে ফুল উৎপাদনের চিত্রও দেখিয়েছি। দেখিয়েছি কাতারের ফুলের রাজ্য। এরই প্রতিচ্ছবি দেখেছিলাম বছর পাঁচেক আগে ময়মনসিংহের ভালুকায় নিশিন্দা গ্রামে। নিউ এশিয়া গ্রুপ পলিনেট হাউসে চাষ করে জারবেরা ফুল। গহিন গ্রামের ভেতর নেট হাউসে বিশাল ফুলের চাষক্ষেত্র দেখে অভিভূত হয়েছিলাম। গদখালীর ফুল চাষ থেকে সেটি বেশ ব্যতিক্রম। এরই মধ্যে গদখালীর কৃষকদের অনেকে সরকারি সহযোগিতায় গ্রিন হাউসে ফুল ও সবজি চাষ শুরু করেছেন। তবে ওই কৃষকরা উন্নত দেশের প্রযুক্তি তাদের উপযোগী ও সীমিত ব্যয় সাধ্যের মধ্যে নিয়ে এসে ফুল চাষ করছেন। আর নিশিন্দা গ্রামে ফুলের চাষ হচ্ছে বড় বিনিয়োগে পুরোপুরি উন্নত বিশ্বের প্রযুক্তি অনুসরণ করে। সেখানকার পলিনেট হাউসে ফুল উৎপাদন কার্যক্রমের কারিগরি সহায়তা পুরোপুরি ভারত থেকে নেওয়া।
সারাদেশেই ফুল চাষের পরিধি বাড়ছে, বাড়ছে গ্রিন হাউসে ফুলের চাষ। নানা ফল-ফসলের পাশাপাশি কৃষক ও কৃষিশ্রমিকদের কাছে ফুল নিয়ে এসছে বিস্ময়। পরিকল্পিত চাষের তিন মাসের মাথায় ফুল তুলে বাজারে পাঠানোর এই ব্যবস্থায় যুক্ত হয়ে বছরব্যাপী জমিতে নতুন কৃষিবিন্যাসের সুযোগ পাচ্ছেন কৃষক। এখন ফুলের সুরভির সঙ্গে মনে-প্রাণে মিশে গেছেন তারা। ফুল চাষ থেকে বাজার বিপণন প্রতি ক্ষেত্রেই তৈরি হয়েছে নতুন নতুন কর্মসংস্থান। শুধু পুরুষরাই নন, ফুল চাষ ও ফুল প্যাকেজিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন স্থানীয় নারীরা। তাদের জন্যও এটি চমৎকার এক কর্মসংস্থান।
কৃষির গতি-প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত থেকে সব সময়ই উপলব্ধি করছি, বিশ্বব্যাপীই কৃষির বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটছে। এ পরিবর্তন যেমন প্রযুক্তিতে, তেমনিভাবে বিনিয়োগ ও বাণিজ্যেও হচ্ছে। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাণিজ্যিক কৃষি সম্প্রসারণে উদ্যোগী হয়ে উঠেছেন দেশের কৃষি অনুরাগী শিল্প উদ্যোক্তারা। তারা ইতোমধ্যেই বেশকিছু সাফল্যের নজির গড়েছেন। এ অনুশীলনটি দিনে দিনে সম্প্রসারণ হতে থাকবে। এর মধ্য দিয়ে একটি শ্রেণির বিষমুক্ত ফল-ফসলের চাহিদা যেমন পূরণ হবে, তেমনি অনেক ফসলেরই আমদানি চাহিদা থেকে বেরিয়ে আসতে পারব আমরা এবং তৈরি হবে রপ্তানিবাণিজ্যও। ফুলের ক্ষেত্রে আমদানিনির্ভরতা থেকে অনেকটাই বেরিয়ে আসতে পেরেছি। হয়তো অল্পদিনে ফুল রপ্তানিতেও একটি বাণিজ্যিক সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। পরিবর্তিত ও বিশ্বমানের কৃষির এ দৌড়ে আমাদের কৃষক থেকে শুরু করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অংশীদারিত্ব ধরে রাখাটিই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ বিষয়গুলো নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। কৃষকের স্বার্থ বিবেচনায় একটা নীতিমালা প্রণয়নে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসা উচিত। এর পাশাপাশি দেশ-বিদেশি ফুল চাষের যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, তা ধরে রাখতে এবং এ অগ্রযাত্রাকে বেগবান করতে প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি বাস্তবামুখী কার্যক্রম গ্রহণ। বিদেশি ফুল চাষের প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে কৃষকদের দক্ষতা বৃদ্ধির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া প্রয়োজন আন্তর্জাতিক বাজারে ফুল নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করার বিষয়েও আমাদের সুদৃষ্টি রাখতে হবে।
শাইখ সিরাজ : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব
Leave a Reply