বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় রাজধানী ঢাকা আবারও প্রথম স্থানে উঠে এসেছে। রবিবারের পর গতকাল সোমবার সকাল ৮টায় এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) স্কোর ২৯৩ নিয়ে দূষিত শহরের তালিকায় প্রথম স্থানে থাকে ঢাকা। গত শনিবারও শীর্ষে ছিল ঢাকা। এ নিয়ে টানা তিন দিন তালিকার শীর্ষ অবস্থানে থাকে এ মহানগর।
এর আগে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে এবং এ বছরে জানুয়ারির শুরু থেকে একাধিকবার তালিকার শীর্ষে ছিল ঢাকা। বায়ুদূষণে অন্য দেশের তুলনায় শুষ্ক মৌসুমে ঢাকা বারবার শীর্ষে চলে আসছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, শুষ্ক মৌসুমে বায়ু বেশি দূষিত হয়। জানুয়ারি মাসে বছরের ৩০ শতাংশ বায়ু দূষিত হয়। আর মোট বায়ুদূষণের প্রায় ৬০ শতাংশ বায়ু শুষ্ক মৌসুমে দূষিত হয়।
একিউআই স্কোর ১০০ থেকে ২০০ পর্যন্ত ‘অস্বাস্থ্যকর’ হিসেবে বিবেচিত হয়। একইভাবে একিউআই স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে স্বাস্থ্য সতর্কতাসহ জরুরি অবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয়। এ অবস্থায় শিশু, প্রবীণ ও অসুস্থ মানুষকে বাড়ির ভেতরে এবং অন্যদের বাড়ির বাইরের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। এ পরিমাণে বায়ুদূষণ গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।
জানা যায়, রাজধানী নগরীর ৯০ শতাংশ মানুষই ভয়াবহ বায়ুদূষণের শিকার। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন দূষিত বাতাসে শ্বাস নেন। বায়ুদূষণের কারণে বছরে নিম্ন ও মধ্যআয়ের দেশে আনুমানিক ৭০ লাখ মানুষের অকালমৃত্যু হয়।
আইকিউ এয়ারের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ ছিল বাংলাদেশ। ২০২০ সালেও বাংলাদেশ এই তালিকায় শীর্ষে ছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এক ঘনমিটার বাতাসে বছরে পার্টিকুলেট ম্যাটার (পিএম) বা বায়ুম-লীয় পদার্থ কণা ২ দশমিক ৫-এর উপস্থিতির গড় পাঁচ মাইক্রোগ্রামের বেশি হওয়া উচিত নয়। কিন্তু আইকিউ এয়ারের রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশের বাতাসে পিএমএর উপস্থিতির গড় ছিল ৭৬ দশমিক ৯ শতাংশ।
বায়ুদূষণের বিষয়ে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালক অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার আমাদের সময়কে বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে প্রতিবছর বায়ুদূষণ বেড়ে যায় এটা নতুন কিছু নয়। ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ এই চার মাসের মধ্যে বাংলাদেশে বায়ুদূষণ বেশি থাকে। বিশেষ করে জানুয়ারি মাসটা বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের মাস। ২০১৬ থেকে ২০২৩ এই সাত বছরের ডাটা থেকে আমরা দেখতে পাই ৩০ শতাংশ বায়ু দূষিত হয় জানুয়ারি মাসে। অন্যান্য মাসের তুলনায় এই মাসে প্রায় ছয়গুণ বেশি বায়ু দূষিত হয়। ডিসেম্বর মাস দ্বিতীয়, ফেব্রুয়ারি তৃতীয় আর মার্চ চতুর্থ। এই চার মাসে সবচেয়ে বেশি বায়ু দূষিত হয়। এই চার মাসে ৬০ শতাংশ বায়ুদূষণ হয়ে থাকে। আর জুন, জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর মাসে সবচেয়ে বায়ু ভালো থাকে।
শুষ্ক মৌসুমে বেশি বায়ুদূষণের বিষয়ে অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান বলেন, এই সময়ে ইটের ভাটাগুলো বেশি উৎপাদনে থাকে। ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো শুষ্ক সময়ে চলাচল করলে বায়ু দূষিত হয়। রাস্তা সংস্কারসহ সব ধরনের নির্মাণকাজ এই সময়ে বেশি করা হয়। ঢাকা শহরে বর্তমানে ১০০টির বেশি রাস্তায় সংস্কারকাজ চলছে। ধুলাবালি উড়ছে, অন্যদিকে যানজট লেগে ওখানকার বায়ু দূষিত করছে। বড় বড় প্রকল্পের কাজ যেখানে যেখানে হচ্ছে, সেখানে অনেক বেশি বায়ু দূষিত হচ্ছে। আব্দুল্লাহপুর, তিনশ ফুট, আগারগাঁও, তেজগাঁও এলাকায় দীর্ঘদিন ঘরে উন্নয়নকাজ হচ্ছে। ফলে বায়ুদূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে দেখা যায়, মানুষ আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে। এই পোড়ানোর কারণে অনেক বায়ুদূষণ হয়। আজকেও আমি ঢাকা শহরের ১০টি জায়গায় বর্জ্য পোড়াতে দেখেছি। তেজগাঁও একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে বর্জ্য পোড়ানোর দৃশ্য মোবাইলে রেকর্ডও করেছি। আমিনবাজার এবং মাতুয়াইলের ডাম্পিং স্টেশনে পোড়ানো হচ্ছে। এই অসচেতনতামূলক কার্যক্রমের জন্য শুষ্ক মৌসুমে বায়ু বেশি দূষিত হয়।’
বায়ুদূষণ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুস সালাম বলেন, ‘অন্যদেশের তুলনায় আমাদের দেশে দূষণ বেশি। কারণ আমাদের এক্টিভিটি বেশি, কন্সট্রাকশন বেশি; কিন্তু নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থাও নেই। দিল্লিতেও দূষণ হচ্ছে। তারাও মাঝে মাঝে দূষণের শীর্ষে চলে আসে। কিন্তু ঢাকার মতো ধারাবাহিকভাবে প্রথম হয়নি। এ ছাড়া এসব দেশ বায়ুদূষণ রোধে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। আমরা সে তুলনায় কিছুই করছি না। ধুলার ফলে শরীরের ফুসফুস, কিডনির ক্ষতি হয়। ধুলার সিলিকন শিশুদের নরম ফুসফুস শক্ত করে দেয়। ব্লাড ক্যানসারেও এটা ভূমিকা রাখে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, বায়ুদূষণের মূল কারণ- অকারণে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, ভবন নির্মাণ ও ভাঙা, ইটের ভাটা। আগের থেকে ঢাকায় কনস্ট্রাকশন কাজ অনেক বেড়েছে। ইট-বালু সুরকির কাজ চলছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিধিবিধান না মেনে, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই রাস্তাঘাট খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। এসব থেকে দূষণ হচ্ছে। গাড়ির কালো ধোঁয়া মারাত্মক দূষণ সৃষ্টি করছে। ভালো পাবলিক ট্রান্সপোর্ট আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। শীতকালে ইটের ভাটায় দূষণ বেড়ে যায়। কলখারখানায় দূষণ বেশি হয়। বর্জ্য থেকেও দূষণ হচ্ছে। মিথেন গ্যাস হচ্ছে। সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও গড়ে উঠেনি।
বাপা সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘একেক দেশের দূষণের কারণ সাধারণত ভিন্ন হয়। অন্য দেশগুলোতে যেখানে দূষণের কারণ একটি বা দুটি, সেখানে আমাদের দূষণের কারণ অনেক। এতগুলো কারণ থাকায় যে কোনো একটি নিয়ে কাজ করলে হবে না। আমাদের অনেক বিষয়কে সামনে রেখে পরিকল্পনা করতে হবে।’ তিনি বলেন, বায়ুদূষণের তালিকার শীর্ষ থেকে নামতে হলে সরকারি সংস্থাগুলোকে তাদের কাজের পরিধি বড় করতে হবে, দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষজ্ঞদের উচিত গবেষণা করে বের করা কত দ্রুত এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যায়।
Leave a Reply