শিশুদের হাঁপানি এমন একটি সমস্যা যেখানে শুধু ওষুধ সেবনে সব সময় কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যায় না। তাই আমরা অভিভাবকদের কিছু নিয়ম মেনে চলতে পরামর্শ দিই। হাঁপানি যেহেতু একটি দীর্ঘমেয়াদি অ্যালার্জিজনিত সমস্যা, এ নিয়মগুলো দিয়ে অ্যালার্জি থেকে দূরে থাকতে বলা হয়।
প্রথমেই জেনে নিই, অ্যালার্জি ব্যাপারটি কী? অ্যালার্জি বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় অতি-সংবেদনশীলতা। আমাদের শরীরে যেকোনো বাইরের অবাঞ্ছিত বস্তু প্রবেশ করলে (শ্বাস, খাদ্য, রক্তের মাধ্যমে) সৃষ্টিকর্তার দেয়া শারীরিক নিয়ম চেষ্টা করে একে বের করে কিংবা নিষ্ক্রিয় করে দিতে। এই বস্তু ধোঁয়া, ধূলিকণা, বিশেষ খাদ্যদ্রব্য, প্রসাধন, এমনকি ওষুধও হতে পারে। এটি একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার ধাপে ধাপে হয়ে থাকে। এ প্রক্রিয়ার মধ্যে অনেক সময় ত্বরান্বিত কিংবা অতিরিক্ত ধাপের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াই হচ্ছে অ্যালার্জি।
এই অ্যালার্জি অনেক রূপে প্রকাশ পেতে পারে। চুলকানি, লাল ছোপ, শরীরে পানি আসা, নাকে পানি, হাঁচি-কাশি, শ্বাসকষ্ট- এ সবই অ্যালার্জির বহিঃপ্রকাশ হতে পারে। হাঁপানি (অ্যাজমা) হচ্ছে এমনই একটি অ্যালার্জিজনিত সমস্যা, যেখানে কাশি, বুকে ব্যথা ও শোঁ-শোঁ করা, শ্বাসকষ্ট একসাথে থাকতে পারে।
এখন জেনে নিই শিশুদের ক্ষেত্রে আমরা কি কি নিয়ম মেনে চলতে বলি-
১. বাতাসের মধ্যে ভাসমান অ্যালার্জি থেকে বাঁচা : শুধু করোনা নয়, সবসময় রাস্তা, বাজার ও বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে মুখোশ পরার অভ্যাস করুন, উৎসাহ দিন। বিশেষ করে ঢাকার বিষাক্ত বাতাসে চলাফেরায় মুখোশ পরা অনেক ধরনের রোগ থেকে সুরক্ষা দেবে।
– ঘরে মশার কয়েল বা ¯েপ্র ব্যবহার করবেন না (অন্তত শিশুর ঘরে)। মশারির ব্যবহার বাড়ান। দরজা-জানালায় জাল (নেট) লাগাতে পারেন।
– ধূমপান পরিহার করুন। শিশুদের পরোক্ষ ধূমপানের হাত থেকে বাঁচান। ধূমপানের আধ ঘণ্টা পরও শ্বাস থেকে নিকোটিন কামরায় ছড়াতে পারে।
– শীতকালে কম্বল ব্যবহার না করে কাভারসহ লেপ ব্যবহার করবেন। কম্বলের সূক্ষ্ম আঁশ শ্বাসনালীতে সমস্যা করে।
– আঁশযুক্ত খেলনা, কারপেট, কুশন পরিহার করবেন।
– ঘর ঝাড় দেয়ার সময় শিশুকে সরিয়ে রাখুন।
– গ্রামের ফসল তোলার সময়ও হাঁপানির জন্য খারাপ। ফুলের রেণু, ফসলের আঁশ শ্বাসকষ্টের কারণ হতে পারে।
২. খাবারের অ্যালার্জি থেকে বেঁচে থাকুন : মায়েদের অভিযোগ, চিকিৎসকের কাছে অ্যালার্জির জন্য গেলে মোটা দাগে মজার সবগুলো খাবার বাদ দিতে বলেন। সব বাদ না দিয়ে কোনো বিশেষ খাবারে এলার্জি আছে কি না বের করতে হবে। একই খাবারে সবার সমস্যা নাও হতে পারে। প্রমাণিত এলার্জিযুক্ত খাবার (গরুর গোশত, গরু-ছাগলের দুধ, ইলিশ, চিংড়ি, বেগুন, পুঁইশাক, হাঁসের ডিম ইত্যাদি), যেকোনো একটি খুব অল্প পরিমাণে দিয়ে দেখতে হবে সমস্যা হচ্ছে কি না। সমস্যা হলে ওই বিশেষ খাবার বাদ দিতে হবে। সমস্যা না হলে সতর্কতার সাথে খাওয়া যেতে পারে। লক্ষ রাখবেন, একাধিক এলার্জিযুক্ত খাবার একই দিন না দেয়াই ভালো। রক্ত পরীক্ষা করেও কোনো কোনো খাবারে অ্যালার্জি হতে পারে, সেটি বের করা যায়।
– কৃত্রিম রঙযুক্ত খাবার (প্যাকেটের জুস, চকোলেট, চিপস, সস), ফাস্টফুড, ক্ষতিকর রাসায়নিকযুক্ত (ফরমালিন, কার্বাইড ইত্যাদি) ফল, সবজি পরিহার করবেন।
– টাটকা দেশী মৌসুমি ফল (আম, জাম, পেয়ারা, আমড়া, লেবু, কামরাঙা, কলা, কমলা, পেঁপে, গাব, সফেদা, আতা, লটকন, আমলকী ) বেশি করে খাওয়ার অভ্যাস করুন।
– আগে কোনো ওষুধে প্রতিক্রিয়া হলে নোট করে রাখুন ও চিকিৎসককে জানান।
৩. শারীরিক সক্ষমতা বাড়াতে জোর দিন : টিভি, মোবাইল, ট্যাব দেখা কমিয়ে ঘরের বাইরে খেলাধুলা, হাঁটাহাঁটির চেষ্টা করুন। শহরের শিশুরা ছাদেও খেলাধুলা করতে পারে।
– সব শিশুর জন্য জন্মের প্রথম ছয় মাস শুধু বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। এরপর ঘরে তৈরি পরিপূরক খাবারের অভ্যাস করুন। কৌটার দুধ, গরু-ছাগলের দুধ, প্যাকেটের সিরিয়াল এগুলো অ্যালার্জি বাড়াতে পারে।
– নিয়ম মতো টিকা দিন।
– ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার শিক্ষা দিন। হাত পরিষ্কার রাখা ব্যাপারটিই অনেক জীবাণু থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে।
– বাজারে, রাস্তায় অনেক সময় শ্বাসকষ্ট ‘নির্মূলের’ টোটকা চিকিৎসা দেয়া হয়, যেখানে উচ্চমাত্রার হাঁপানির ওষুধ ও অনেক ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ রাসায়নিক থাকে। এগুলো সাময়িক ভালো লাগার অনুভূতি সৃষ্টি করে। কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য এগুলো ভয়ঙ্কর ক্ষতির কারণ।
– সবশেষে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে রাখি। শ্বাসকষ্টের জন্য ইনহেলার জাতীয় ওষুধ ঠিকমতো ব্যবহার না করলেও হাঁপানি রোগে তেমন উন্নতি পাওয়া যায় না। আপনার ইনহেলার, স্পেসার ব্যবহার ঠিকমতো হচ্ছে কি না, সেটিও চিকিৎসকের সাথে কথা বলে জেনে নিন।
লেখক : রেজিস্ট্রার (শিশু বিভাগ), আইসিএমএইচ, মাতুয়াইল, ঢাকা
Leave a Reply