ছেলে ইমনের জন্য পাত্রী দেখতে যাবেন। পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে নিয়ে বেশ সাড়ম্বরে যাত্রা শুরু করলেন বৃদ্ধ আব্বাসউদ্দিন। মাইক্রোবাসে চেপে যথাসময়ে যাত্রাও শুরু করলেন। কিন্তু তাদের সে আনন্দযাত্রা শেষ পর্যন্ত পরিণত হয় লাশের মিছিলে।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নবীগঞ্জ উপজেলার কান্দিগাঁওয়ে তাদের বহনকারী মাইক্রোবাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সঙ্গে ধাক্কা খায়। এতে আব্বাসউদ্দিন ও তার ছেলে ইমনসহ ১০ জন নিহত হন। আরও তিন আরোহীও গুরুতর আহত হয়েছেন। হৃদয়বিদারক এ দুর্ঘটনাটি ঘটেছে গতকাল সকাল সাড়ে সাতটার দিকে। নারায়ণগঞ্জের পাগলা থেকে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার জগদল গ্রামের উদ্দেশে যাচ্ছিল পুরো পরিবারটি।
শুধু এটিই নয়, গতকাল শুক্রবার ছুটির দিনেও দেশের বিভিন্ন সড়কে দুর্ঘটনায় নারী-শিশুসহ ২৭ জন নিহত হয়েছেন। হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ ৯টি জেলায় এসব দুর্ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কেই গতকাল আব্বাসউদ্দিনদের বহনকারী মাইক্রোবাস ছাড়াও পৃথক আরেকটি দুর্ঘটনায় ৬ জন নিহত হয়েছেন। ভোর সাড়ে তিনটার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে বাস ও মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে এ প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত ৪ জনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তারা কেউই আশঙ্কামুক্ত নন। হতাহতরা সবাই নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার চৌপাড়ার দেউলি গ্রামের বাসিন্দা। তারা মাইক্রোবাসে চেপে সিলেটে যাচ্ছিলেন মাজার জিয়ারতের উদ্দেশে।
এ ছাড়া ময়মনসিংহের ভালুকা, সাভার ও ফেনীর সোনাগাজীতে সড়ক দুর্ঘটনায় দুজন করে মোট ছয়জন, পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে, চাঁদপুরের শাহরাস্তিতে ও কুমিল্লার দাউদকান্দি ও বান্দরবানে একজন করে নিহত হয়েছেন।
হবিগঞ্জ : ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নবীগঞ্জ উপজেলার কান্দিগাঁও নামক স্থানে প্রাইভেট মাইক্রোবাসটি সড়কের পাশে গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে দুমড়ে-মুচড়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলে ৮ জন নিহত হন। পরে হাসপাতালে আরও ২ জন মারা যান। দুর্ঘটনার পর পরই আশপাশের শত শত লোক ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। এ সময় সেখানে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে গোপলার বাজার তদন্তকেন্দ্রের পুলিশ, শেরপুর হাইওয়ে থানার পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কয়েকটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশগুলো উদ্ধার করে। এ ছাড়া ঘটনাস্থলে ছুটে যান হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. কামরুল হাসান ও নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ^জিৎ কুমার পাল। পরে নিহতদের লাশ শেরপুর হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। বিকালে আত্মীয়স্বজনরা থানায় উপস্থিত হয়ে লাশ শনাক্ত করেন। বর ইমনের মামাতো ভাই আব্দুল আহাদ বলেন, নিহতরা একটি বিয়ের পাত্রী দেখার জন্য সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে যাচ্ছিলেন।
দুর্ঘটনাস্থলে নিহতরা হলেনÑ বর ইমন খান (২৬), তার বাবা আব্বাসউদ্দিন খান (৫০), ভাই রাব্বি খান (২৩), মামাতো ভাই রাজিব আহমেদ (২৭), খালাতো ভাইয়ের বউ আসমা বেগম (২৮), গিয়াসউদ্দিন (৫১), বন্ধু মহসিন আহমেদ (২৫) ও ইমরান মিয়া (২৪)। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর ইমনের মামি সুমনা বেগম (২৮) এবং নিহত সুমনা বেগমের শিশুসন্তান খাদিজা আক্তারের (৪) মৃত্যু হয়।
গুরুতর আহতরা হলেন- রফিকুল ইসলাম (৫৫), আবুল হোসেন (৫০) ও গাড়িচালক নাদিম মাহমুদ (৩৬)। তারা সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
কান্দিগাঁও জামে মসজিদের মুয়াজ্জিম আমির আলী জানান, তিনি নামাজ পড়ে হাঁটাহাঁটি করছিলেন। এ সময় হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে দৌড়ে গিয়ে দেখেন একটি মাইক্রোবাস গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। কয়েকটি লাশ মাটিতে পড়ে আছে। ভিতরেও কয়েকজন লোক ছটফট করছিল। এ সময় তিনি চিৎকার শুরু করেন। সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এসে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেন। আহতদের সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। তিনি আরও বলেন, দুর্ঘটনায় কয়েকজনের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ বিচ্ছিন্নœ হয়ে যায়।
শেরপুর হাইওয়ে থানার ওসি এরশাদুল হক ভূইয়া জানান, কান্দিগাঁও গ্রামে দুর্ঘটনার পর পরই ঘটনাস্থলে পুলিশ পৌঁছে হতাহতদের উদ্ধার করে। পরে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। একই কথা বলেন হবিগঞ্জ ফায়ার স্টেশনের ডিউটি অফিসার আইয়ুব।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া : বিশ^রোডের খাঁটিহাতা হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মাইনুল ইসলাম জানান, রাত সাড়ে তিনটায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বিজয়নগর উপজেলার রামপুরার ভাটি কালিসীমা এলাকায় নারায়ণগঞ্জ থেকে সিলেটগামী মাইক্রোবাস ও সুনামগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী লিমন পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে মাইক্রোবাসটিতে আগুন ধরে গেলে হতাহতের এ ঘটনা ঘটে। মাইক্রোবাসের ১০ যাত্রীর মধ্যে ৬ জন নিহত হন। তারা হলেন মাইক্রোবাসের চালক সোহান (২০), যাত্রী হারুন মিয়া (৪০), শাকিল মিয়া (২৫), সাগর (২২), রিফাত (১৬) ও ইমন মিয়া (১৯)। গুরুতর আহত ৪ যাত্রীকে দ্রুত উদ্ধার করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। তারা হলেন শাহিন (৩০), বিজয় (২২), আবির (৩৫) ও জিসান (২৫)। পরে তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
হাইওয়ে পুলিশের এসআই প্রেমধন জানান, বাস-মাইক্রোবাসের সংঘর্ষের পর মাইক্রোবাসটিতে আগুন ধরে যায়। এতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই পাঁচজন মারা যান। হাসপাতালে নেওয়ার পথে আরেকজন মারা যান। তবে বাসটি খাদে পড়ে গেলেও কোনো যাত্রী তেমন আহত হননি। এ দুর্ঘটনার পর মহাসড়কে প্রায় ৬ কিলোমিটার যানজট সৃষ্টি হয়। সকাল ৮টার দিকে দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ি মহাসড়ক থেকে সরিয়ে নিলে ফের যান চলাচল শুরু হয়।
সাভার : ঢাকার সাভারে বাস ও ট্রাকচাপায় মোটরসাইকেলের দুই আরোহী নিহত হন। বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা-আরিচা ও আবদুল্লাপুর-বাইপাইল সড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন রাজধানীর শেওড়াপাড়ার কাজী নাজমুল হক ও নারায়ণগঞ্জ শিল্প পুলিশের কনস্টেবল আকাশ আহমেদ। নাজমুল গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের নাগরপুর থেকে মোটরসাইকেলে ঢাকার বাসায় যাচ্ছিলেন। বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল সড়কের জামগড়া এলাকায় রিকশার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে বাসের নিচে চলে যান তিনি। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। একই রাত ১টার দিকে আশুলিয়ার শ্রীপুরের বাড়ি থেকে মোটরসাইকেলে নারায়ণগঞ্জে কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন আকাশ। সাভারের উলাইল এলাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে একটি ট্রাক মোটরসাইকেলসহ তাকে চাপা দিলে তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান।
মিরসরাই : কয়েকটি মোটরসাইকেলে করে গত বৃহস্পতিবার রাতে ঘুরতে বের হন চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার ৬ তরুণ। তাদের মধ্যে ৪ জন জীবিত বাড়ি ফিরলেও দুজনকে ফিরতে হয়েছে লাশ হয়ে। রাত সাড়ে ১১টার দিকে সোনাগাজী সড়কের মতিগঞ্জ বাজার এলাকার সাতবাড়িয়া ব্র্যাক অফিসের পাশে নির্মাণাধীন একটি সেতুর নিচে মোটরসাইকেলসহ পড়ে তারা নিহত হন। তারা হলেন মো. আজিজুল হক সাহেদ ও জিয়াউদ্দিন বাবলু। সাহেদ মিরসরাই উপজেলার ধুম ইউনিয়নের নাহেরপুর গ্রামের তাজুল ইসলামের পুত্র। বাবলু একই উপজেলার জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের ইমামপুর গ্রামের মৃত বশির আহম্মদের পুত্র। বাবলু মিরসরাই মাদ্রাসা থেকে কামিল পরীক্ষা দিচ্ছিল।
কুমিল্লা : দাউদকান্দি উপজেলার জিংলাতলী স্থানে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ঢাকাগামী একটি বাসচাপায় মোটরসাইকেলের আরোহী এক ব্যক্তি ঘটনাস্থলেই মারা যান। তার পরিচয় পাওয়া যায়নি। গতকাল সকাল ৯টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
সরাইল : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের মালীহাতা নামক স্থানে ট্রাকচাপায় মাসুম ব্যাপারী নামে এক মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হন। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে মোটরসাইকেলযোগে সিলেট অভিমুখে যাওয়ার সময় মালীহাতা এলাকায় পেছন থেেক একটি ট্রাক তাকে ধাক্কা দেয়। মাসুম ব্যাপারী আশুগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রে চাকরি করেন। তিনি মানিকগঞ্জ জেলার আব্দুর রউফ ব্যাপারীর ছেলে। থাকতেন আশুগঞ্জ ওয়াপদা কলোনিতে।
পটুয়াখালী : মির্জাগঞ্জে ট্রাকচাপায় মো. চুন্নু মোল্লা নাম একজন নিহত এবং সোহেল ও সুরা মনি জান্নাতি (৬) নামে দুজন গুরুতর আহত হন। শুক্রবার বিকাল ৫টার দিকে বাকেরগঞ্জ-চান্দুখালী মহাসড়কের মির্জাগঞ্জের সুবিদখালী রাড়ী বাড়ির বটতলা এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত চুন্নু মোল্লা বরগুনার বেতাগী উপজেলার সড়িসামুড়ি গ্রামের রহমান মোল্লার ছেলে।
লালমোহন (ভোলা) : লালমোহনে যাত্রীবাহী মোটিফাই টেম্পো উল্টে পুকুরে পড়ে মো. মানিক নামের এক চালক নিহত হন। শুক্রবার দুপুরে উপজেলার মঙ্গল সিকদার সড়কের চরকালাচাদ নামক স্থানে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত মানিক পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের জাহাঙ্গীরের ছেলে।
চাঁদপুর : শাহরাস্তি উপজেলায় রাস্তা পার হতে গিয়ে ট্রাকচাপায় হাবিবউল্লাহ নামে বৃদ্ধ নিহত হন। গত বৃহস্পতিবার রাত ৮টায় চাঁদপুর-কুমিল্লা আঞ্চলিক মহাসড়কের মজুমদার বাড়িসংলগ্ন এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। হাবিবুল্লাহ পৌর শহরের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মজুমদারবাড়ির বাসিন্দা।
রাজবাড়ী : সদর উপজেলার চরখানখানাপুরের এবিকের ইটভাটাসংলগ্ন ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে কাভার্ডভ্যান ও ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে দুটি গাড়ির চালক গুরুতর আহত হন। তারা হলেন কাভার্ডভ্যানের চালক শিবু কু-ু ও ট্রাকচালক মো. মান্নান মন্ডল। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
ময়মনসিংহ : ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ভালুকা উপজেলায় বড় পিকআপের ধাক্কায় ছোট পিকআপের চালকসহ ২ জন নিহত ও ২ জন আহত হন। গতকাল ভোরে মেহরাবাড়ী এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেনÑ নেত্রকোনার ঠাকুরাকোনা গ্রামের পিকআপভ্যানের চালক রাজন রবিদাস ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানার তালাশ কোর্ট এলাকার আবদুস সালামের ছেলে মো. আজিম (২৩)।
বান্দরবান : শহরের ক্যাংয়ের মোড় এলাকায় গতকাল দুপুরে একটি মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সঙ্গে ধাক্কা খায়। এতে সাইকেলের আরোহী মো. জাহেদ মারা যান; আরেক আরোহী গুরুতর আহত হন। জাহিদ শহরের বনরূপা পাড়ার বাসিন্দা বজলুর রহমানের ছেলে।
Ñপ্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক দীপক চৌধুরী বাপ্পী, সাভার থেকে নিজস্ব প্রতিনিধি মো. জাহিদুর রহমান, হবিগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি রুহুল হাসান শরীফ, নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি আবু সাউদ মাসুদ, বান্দরবান জেলা প্রতিনিধি জাকির হোসেন, নবীগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি সলিল বরন দাশ, শাহরাস্তি উপজেলা প্রতিনিধি মো. জামাল হোসেন, লালমোহন প্রতিনিধি এনামুল হক রিংকু, মির্জাগঞ্জ প্রতিনিধি মো. ফারুক খান, সরাইল প্রতিনিধি মো. আলমগীর মিয়া এবং দাউদকান্দি প্রতিনিধি মোহাম্মদ আলী শাহীন।
Leave a Reply