এবারের কুরবানি ঈদে উত্তরবঙ্গের মানুষের ঘরযাত্রার ভোগান্তি দেখে সেতুমন্ত্রী বলেছেন, ‘রাস্তার দোষ নয়, সিস্টেমের দোষ।’ সেতুমন্ত্রীকে এজন্য ধন্যবাদ যে, অতঃপর তিনি উত্তরবঙ্গের মানুষের ভোগান্তির কথা স্বীকার করে নিয়েছেন।
কিন্তু রেলমন্ত্রী সে কথাটিও স্বীকার করেন বলে মনে হয় না। কারণ, পাবনার মানুষ যখন পাবনা-ঢাকা সরাসরি ট্রেন সার্ভিস চালুর দাবি তুলেছিলেন, তখন তিনি একবার ট্রেনের বগিস্বল্পতার কথা এবং আরেকবার যমুনা সেতুর রেললাইনের অসক্ষমতার কথা বলে পাবনাবাসীর সে দাবিকে পাশ কাটিয়ে গিয়েছিলেন। আর এখানেই পাবনা তথা উত্তরবঙ্গবাসীর দুর্ভাগ্য।
পাবনা বা উত্তরবঙ্গের নেতৃত্বের দুর্বলতায় অতীত থেকেই এ এলাকার মানুষ অনেক ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে; যার অন্যতম আরিচা-নগরবাড়ী সড়ক সেতু। সেই পাকিস্তান আমলে আরিচা-নগরবাড়ী সেতু নির্মাণের কথা থাকলেও শুধু নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। শত শত বছরের ঐতিহ্য ও ইতিহাসের ধারক-বাহক আরিচা-নগরবাড়ী-গোয়ালন্দের গুরুত্ব বিবেচনা করে পাকিস্তান আমলে যখন সেই স্থানে সেতু নির্মাণের প্রস্তাব গৃহীত হয়, তখন সে প্রস্তাবকে সঠিকভাবে এগিয়ে নিয়ে তা বাস্তবায়ন করার মতো শক্তি, মেধা বা দক্ষতার পরিচয় সে সময়ে পাবনা-কুষ্টিয়া বা উত্তরবঙ্গের নেতাদের কেউ দেখাতে পারেননি।
যদি তাই হতো, তাহলে এ দেশে আজ বড় বড় দুটি সেতুর স্থানে তিনটি সেতুর দেখা মিলত। অন্তত ইস্ট-ওয়েস্ট বিদ্যুৎ কানেক্টর টাওয়ার নির্মাণের সময়েও ডিজাইনটি কিছুটা পরিবর্তন করলেই একটি সেতু হয়ে যেত। অর্থাৎ যমুনা এবং পদ্মা সেতুর আগেই আরিচা-নগরবাড়ী পয়েন্টে আরও একটি বড় সেতু এ দেশে নির্মিত হয়ে যেত। আর সে ক্ষেত্রে হয়তো বর্তমান যমুনা সেতু আরও একটু উত্তরেই নির্মিত হতো। উল্লেখ্য, সে সময় আরিচা-নগরবাড়ী সেতু নির্মাণের মূল যুক্তি ছিল, আরিচা থেকে পার্বতীপুর এবং খুলনা সমদূরবর্তী। সুতরাং, দেশের সর্বপ্রথম বড় সেতু প্রকল্প হিসাবে আরিচা-নগরবাড়ী পয়েন্টকেই সে সময় বেছে নেওয়া হয়েছিল; কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তরকালে সেতুটি উত্তর দিকে সরিয়ে নেওয়ায় উত্তরবঙ্গসহ দেশের পশ্চিমাংশের মানুষকে এখন রাজধানী ঢাকায় আসতে যেতে ঢাকা, গাজীপুর, টাঙ্গাইল ঘুরে সিরাজগঞ্জের ওপর দিয়ে বাদবাকি জেলায় যাতায়াত করতে হয়।
আর ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জ যেতে যমুনা সেতু পর্যন্ত পৌঁছাতে যে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়, তা বলার মতো নয়! একবিংশ শতাব্দীর এই দিনেও এ এলাকার মানুষকে সড়কে আটকা পড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অমানুষিক যন্ত্রণা ভোগ করে যেভাবে আহাজারি করতে হয়, তা-ও বলার মতো নয়! আর এ যন্ত্রণা শুধু ঈদের সময়ই নয়, বছরজুড়েই নারী, পুরুষ, শিশুসহ কখনো যমুনা সেতুর পূর্বপ্রান্তে; আবার কখনো পশ্চিমপ্রান্তের সড়কে ১০-১২ ঘণ্টা পর্যন্ত আটকে থাকতে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানবাহন স্থবির হয়ে পড়ায় এক পর্যায়ে ৪০-৫০ কিলোমিটার রাস্তায় যানজট ছড়িয়ে পড়লে মানুষের ত্রাহি অবস্থার সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে শিশু ও নারীদের করুণ অবস্থার কথা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এ অবস্থায় টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জের জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের সাহায্য চেয়ে রাস্তায় আটকে থাকাদের কেউ কেউ ফোনও করে থাকেন। সুতরাং, সেতুমন্ত্রী যে বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছেন, সেজন্য আবারও তাকে ধন্যবাদ।
কিন্তু অবস্থা এভাবে চলতে দিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলেও তো চলবে না। কারণ, দিন দিন এ সমস্যা যে আরও বাড়বে, এ কথাটিও তো কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। দিনের পর দিন ট্রাক, বাস, লরি, ওয়াগনবাহী দৈত্যাকার যান, প্রাইভেট কার, জিপ, মোটরসাইকেল সবকিছুই তো বেড়ে যাবে! আর তখন শুধু দুটি মাত্র বড় সেতু দিয়ে কি পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে? আমার মনে হয়, বিষয়টি এখনই গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখে বিশ্বব্যাংক যদি কম সুদে ঋণ দেয়, তাহলে আরও একটি বড় সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতেই পারে। আর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে এখনই যে আরও একটি বড় সেতু নির্মিত হবে, তেমনটিও তো নয়। তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণে দেরি করলে কাজটি যে অনেক বেশি পিছিয়ে যাবে, জনান্তিকে সেই কথাটিই বলে রাখা হলো।
আরও বলে রাখা হলো, আগামী ২০ বছরেই কিন্তু দেশের জনসংখ্যা ২০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে; আর তখন বর্তমান বড় দুটি সেতুর ওপর যে চাপ পড়বে, সে চাপ সেতু দুটি সহ্য করতে পারবে না। এ বিষয়ে আমার কিছুটা বিশেষ জ্ঞান থাকায়, সেতুমন্ত্রী তথা সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, অচিরেই পদ্মা সেতুর ওপর কিন্তু অতিরিক্ত চাপ পড়বে এবং সে কারণে সেতুটির ক্ষতিসাধন হওয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়।
তাছাড়া ওপারের জেলাগুলোয় যখন শিল্প-কারখানা, খামার ইত্যাদি গড়ে উঠবে আর সেখানকার উৎপাদিত পণ্য যখন পারাপার শুরু হবে, তার সঙ্গে মোংলা, পায়রা ইত্যাদি বন্দরের ওয়াগনবাহী যানবাহন চলাচল শুরু হলে পদ্মা সেতু কিন্তু কুলিয়ে উঠতে পারবে না। যমুনা সেতুর উভয় পাড়ের মতো পদ্মা সেতুর উভয় পাড়েও অসহনীয় যানজট সৃষ্টি হবে। এ সমস্যা সমাধানে তাই এখনই আরও একটি সমান্তরাল বড় সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রয়োজন। আর সে সেতুটি যে আরিচা-কাজিরহাট-দৌলতদিয়া পয়েন্টে একটি ত্রিমুখী সেতু হবে, সে কথাটি বলাই বাহুল্য।
উল্লেখ্য, কয়েক দিন আগে পদ্মা সেতু দর্শনে গিয়ে আমি যা দেখতে পেয়েছি, তাতে করে উপরের ধারণাগুলো আমার কাছে আরও দৃঢ়মূল হয়েছে। কারণ, ঢাকা থেকে পদ্মা সেতুতে পৌঁছাতে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে বেশ কিছু সময় আটকে থাকার পর পদ্মা সেতুর টোল প্লাজার তিন কিলোমিটার পূর্ব থেকেই যানজট দেখে সেদিনই বুঝতে পেরেছি, ভবিষ্যতে কী হতে চলেছে। অতঃপর পদ্মা সেতুর উভয় পারেই যে প্রচণ্ড যানজটের সৃষ্টি হবে, সে কথাটি মাথায় রেখে এখনই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি বলেই মনে করি। আর সে ক্ষেত্রে আরিচা-কাজিরহাট-দৌলতদিয়ায় একটি ত্রিমুখী সেতু নির্মাণই হবে কাজের কাজ।
কারণ, এ সেতুটি নির্মাণ করা গেলে বর্তমান পদ্মা ও যমুনা সেতুর ওপর চাপ কমে যাবে। নাটোর, পাবনা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গার মানুষসহ ঈশ্বরদী ইপিজেডের মালবাহী যানবাহনকে তখন আর পদ্মা-যমুনা সেতু যেমন ব্যবহার করতে হবে না, তেমনি রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ, মাগুরা; এমনকি ফরিদপুরের মানুষকেও পদ্মা সেতু ব্যবহার করতে হবে না। পদ্মা সেতুতে যানজট বা ভিড়ের কারণে ফরিদপুরের যানবাহনও তখন আরিচা হয়ে যাতায়াত করবে। কারণ, এ পথে যাতায়াত করলে পদ্মা সেতুর মতো একই দূরত্ব পাড়ি দিয়ে যানজটের ঝুঁকি ছাড়াই ফরিদপুর পৌঁছানো যাবে। মোট কথা, পদ্মা এবং যমুনা সেতুর মধ্যবর্তী স্থান আরিচা-কাজিরহাট-দৌলতদিয়া পয়েন্টে আরও একটি বড় সেতু নির্মাণের অপরিহার্যতা ভুলে না গিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এখনই ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে, তেমনটিই প্রত্যাশিত।
আমার জানা মতে, মুক্তিযুদ্ধের উপসর্বাধিনায়ক একে খোন্দকার পরিকল্পনামন্ত্রী থাকাবস্থায় আরিচা-কাজিরহাট-দৌলতদিয়া সেতু প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়েছিল এবং পদ্মা সেতু নির্মাণ সমাপ্তির পর তা বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ বিষয়ে এখন আর তেমন কোনো কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে না; বরং সরকারের একটি মহল থেকে নাকি সরকারের হাইকমান্ড তথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বোঝানো হচ্ছে যে, সেখানকার নদীর গভীরতা ইত্যাদি কারণে আরিচা-কাজিরহাট-দৌলতদিয়া পয়েন্টে সেতু নির্মাণ সম্ভব নয়।
জানি না কথাটি সত্যি কিনা, তবে আমাকে একজন সাবেক প্রতিমন্ত্রী কথাটি জানিয়ে এ বিষয়ে হতাশা ব্যক্ত করায় আমি তথ্যটি সঠিক বলেই ধরে নিয়েছি। যদিও সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রীর আমলে গৃহীত ও অনুমোদিত আরিচা-কাজিরহাট-দৌলতদিয়া প্রকল্পটির মৃত্যু ঘটেছে, নাকি সেটা হিমঘরে চলে গেছে, সে সম্পর্কেও আমরা কিছু জানি না। তবে সরকারের উচিত এ বিষয়ে দেশের মানুষকে সবকিছু জানিয়ে দেওয়া। কারণ, এতবড় একটি প্রকল্পের মৃত্যু ঘটবে বা তা হিমঘরে চলে যাবে আর আমরা তা জানতে পারব না, তেমনটি হওয়া উচিত নয়।
পরিশেষে আবারও জোর দিয়ে বলতে চাই, পাশ কাটানোর ইচ্ছায় বা আঞ্চলিকতার কারণে কেউ যদি আরিচা-কাজিরহাট-দৌলতদিয়া সেতু প্রকল্পটি আটকে দিতে চান, তাহলে তা একটি আত্মঘাতী কাজ হিসাবেই বিবেচিত হবে। আবার কেউ যদি প্রকল্পটির বাস্তবায়ন অসম্ভব বলেন, তা-ও সঠিক নয় বলেই মনে করি। সে ক্ষেত্রে যারা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন অসম্ভব বলে মত দিচ্ছেন, তাদের সেসব যুক্তির পক্ষের রিপোর্টগুলোও প্রকাশিত হওয়া উচিত। কারণ, প্রকল্পটির সঙ্গে দেশের চার-পাঁচ কোটি লোকের ভালো-মন্দ জড়িত আছে, কোটি কোটি মানুষের সেন্টিমেন্ট জড়িত আছে। এ অবস্থায় আরিচা-কাজিরহাট-দৌলতদিয়া সেতু প্রকল্পটি নিয়ে সরকারেরও ‘ঝেড়ে কাশা’ উচিত।
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট
Leave a Reply