ছয় দশক আগে বিহারের দারিদ্রের কষাঘাত থেকে পালিয়ে দিল্লি এসেছিলেন মোহাম্মদ মুনাজির। তার ভূমিহীন বাবা সেখানে অন্যের খামারে মজুরী খাটতো। শুরুতে, লাখ লাখ অন্য দরিদ্র অভিবাসীর মতোই ভারতের বর্ধনশীল রাজধানীর এক কোনায় তারপুলিনে ঘেরা এক ছোট ঘরে থাকতেন মুনাজির।
একটি পুস্তক বাঁধাইয়ের দোকানে কাজ নিয়ে তিনি চলে যান খাজুরি খাস এলাকায়। এলাকাটি দিল্লির উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। এখানকার শিক্ষাদীক্ষার হার ভারতের জাতীয় গড়ের তুলনায় অনেক কম।
বই বাঁধাইয়ের দোকান যখন বন্ধ হয়ে গেল, মুনাজির তখন নিজেই কিছু করার কথা চিন্তা করলেন। ছোট একটি গাড়ি কিনলেন, সাথে কিনলেন চাল আর মুরগি। শুরু করলেন বাড়িতে বানানো বিরিয়ানি বিক্রির ব্যবসা।
তার ব্যবসা টিকেও গেল- “আমি নায়ক হয়ে গেলাম, সবাই আমার বিরিয়ানি পছন্দ করতো”। মুনাজির প্রায় ১৫ কেজি বিরিয়ানি রান্না করতেন যা বিক্রি করে দিনপ্রতি অন্তত ৯০০ রুপি লাভ হতো। সবকিছুই ভাল যাচ্ছিল।
প্রায় তিন বছর আগে, নিজের ও ভাইয়ের সঞ্চয় মিলিয়ে ২৪ লাখ রুপি দিয়ে একটি বাড়ি কেনেন মুনাজির। তার ভাই একজন গাড়িচালক। সরু এক গলিতে ম্যাড়মেড়ে এক দোতলা বাড়ি।
বাড়ির প্রতি তলায় দুটি করে কামরা। জানালার বালাই নেই। একটি করে ছোট রান্নাঘর আর একটি করে বাথরুম। দুটি পরিবারের জন্য খুবই ছোট, কিন্তু বাড়িতো! দিল্লির গুমোট গ্রীষ্মের হাত থেকে বাঁচতে তারা শীতাতপ যন্ত্রও লাগিয়েছিলেন বাড়িটিতে।
মুনাজির বলেন, “এটা ছিল একটি নীড়, যেটি আমি আমার স্ত্রী আর ছয় সন্তানের জন্য সারা জীবনের কষ্টের সঞ্চয় দিয়ে কিনেছিলাম। সারাজীবন শুধু এই একটি মাত্র জিনিস চেয়েছি এবং এই একটি স্বপ্নই আমার বাস্তব হয়েছিল।”
কিন্তু গত সপ্তাহের মঙ্গলবারের এক রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে তার সেই স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গেলো।
মুনাজিরের বাড়ি লুট করে আগুন দিয়েছিল একদল মুখোশ আর হেলমেট পরা মানুষ। যাদের হাতে ছিল লাঠি, হকিস্টিক, পাথর আর পেট্রোল ভর্তি বোতল। কণ্ঠে ছিলো শ্লোগান ছিল, “জয় শ্রী রাম”।
বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে শুরু হওয়া দিল্লিতে কয়েক দশকের মধ্যে ভয়াবহতম প্রাণঘাতী ধর্মীয় সহিসংতায় খাজুরি খাস ছিন্ন ভিন্ন জনপদে পরিণত হয়েছে।
তিন দিন ধরা জ্বলা আগুন আর নৃশংসতায় দিল্লির উত্তর-পূর্বের ওই এলাকায় ৪০টি প্রাণ নিঃশেষ হয়েছে, শত শত মানুষ আহত হয়েছেন এবং অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন। কোটি কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ নষ্ট হয়েছে।
আর প্রমাণ মিলছে যে, পরিকল্পিতভাবে মুসলিমদের টার্গেট করা হয়েছিল এই সহিসংতায়। নথিবদ্ধ প্রমাণাদি বলছে যে, সেখানে কিছু পুলিশ দাঙ্গাকারীদের সহায়তা করছিল বা বিষয়টিকে পুরোপুরি এড়িয়ে গেছে।
খাজুরি খাস এলাকায় প্রায় ২০০টির মতো বাড়ি ও দোকান ছিল, যার এক পঞ্চমাংশের মালিক ছিল মুসলমানেরা। যারা জানেন না, তাদের পক্ষে দেখে বোঝা কঠিন ছিলো, গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা ছোট ঘরগুলোর কোনটি মুসলমানের আর কোনটি তাদের হিন্দু প্রতিবেশীর। কোথাও কোথাও দুই ধর্মের দুই প্রতিবেশীর বাড়ির ছিলো একই দেয়াল। কোথাও কোথাও জোড়া লাগানো টানা ছাদ।
তারপরও খুব সহজেই শুধুমাত্র মুসলিমদের বাড়ি আর দোকানগুলোতেই হামলা করেছিল দুষ্কৃতিকারীরা।
এখন অক্ষত দাঁড়িয়ে থাকা রং করা তকতকে হিন্দুদের বাড়ির পাশেই চোখে পড়ে মুসলমানদের কালি-ঝুলি মাখা, ভাঙাচোরা বাড়ি। মুসলমানদের মুরগি, মুদি পণ্য, মোবাইল ফোন আর মানি ট্রান্সফারের দোকান, কোচিং সেন্টার আর একটি সোডা কারাখানা আগুন দিয়ে ঝলসে দেয়া হয়েছে। আর এগুলোর পাশে থাকা হিন্দুদের দোকানগুলোতে এখন ঝাঁপ খুলতে শুরু করেছে।
দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে এখন একমাত্র মিলটি হচ্ছে, তারা একই রাস্তায় যাতায়াত করে যার উপর ছড়ানো ছিটানো সহিংসতার ছাপ: ভাঙা কাঁচের টুকরো, পুড়ে যাওয়া গাড়ি, ছিঁড়ে ফেলা স্কুলের বই আর নষ্ট হয়ে যাওয়া রুটি।
ধ্বংস্তুপের মধ্যে দাঁড়িয়ে ডাকতে থাকা কয়েকটি ছাগলই সেখানে একমাত্র প্রাণের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।
“আমি জানি না যে দাঙ্গাকারীরা ভেতরের নাকি বাইরের। আমরা তাদের মুখ দেখিনি। কিন্তু স্থানীয় কারো সহায়তা ছাড়া তারা আমাদের বন্ধ ঘর দেখেও কিভাবে শনাক্ত করলো?” প্রশ্ন মুনাজিরের।
রাতারাতিই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পাহাড় সমান অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে।
মুনাজিরের পুড়ে যাওয়া বাড়ির ঠিক উল্টোদিকের দোতলা বাড়িটির মালিক এখজন হিন্দু। তার পেশা পান বিক্রি করা। তার সাথে থাকা দুই ছেলে সরকারি পরিবহন কোম্পানিতে চাকরি করেন। মুনাজির বলেন, বছরের পর বছর ধরে শান্তিতেই পাশাপাশি বাস করে আসছিলেন তারা।
মুনাজির বলেন, ‘এমনকি আমি তার বাড়িতে ভাড়া থেকেছি। তিনি বেরিয়ে এসে দাঙ্গাকারীদের সাথে কথা বলে বোঝাতে পারতেন, হয়তো আমার বাড়িটা বেঁচে যেতো।’
সেই দুর্ভাগ্যের সকালে ভয়ের ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গিয়েছিলো মুনাজিরের শিরদাঁড়া বেয়ে। তিনি পুলিশ এবং ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিয়েছিলেন। স্থানীয় এক হিন্দু স্কুল শিক্ষক অস্ত্রধারীদের শান্ত করে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করছিলেন।
“চিন্তা করবেন না, কিছু হবে না। বাড়ি যান,” উদ্বিগ্ন মুসলিমদের তিনি একথা বলছিলেন। এক হিন্দু যুবক দাঙ্গাকারীদের অন্য আরেকটি লেনে প্রবেশ ঠেকানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু দাঙ্গাকারীরা তার কথা শোনেনি আর এর পরপরই তারা ভাঙচুর শুরু করে। আর তখন মুনাজির তার বাড়ি যান এবং প্রধান ফটক দরজা বন্ধ করে দেন।
দাঙ্গাকারীরা তার দরজা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছিল আর তখনই তাদের নজরে আসে কয়েক বাড়ির পরে থাকা মসজিদ। তাই তারা আপাতত দরজা ভাঙা বাদ দিয়ে মসজিদ লক্ষ্য করে পেট্রোল বোমা ছুড়তে থাকে।
মুনাজির বলেন, ছয় ঘণ্টা পর পুলিশ আসে। তারা মুসলিম বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাচ্ছিল উগ্রবাদীদের চোখের সামনে দিয়েই, আর উগ্রবাদীরা তাদের চর-থাপ্পড় ও পাথর মারছিল।
পুলিশের সাথে সদ্যই ধর্মীয় সহিংসতার জেরে শরণার্থীতে পরিণত হওয়া মুসলমানেরা বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে দাঙ্গাকারীরা তাদের বাড়িতে ঢুকে লুটপাট শুরু করে এবং লুটপাট শেষে আগুন দিতে থাকে।
“তুমি ভাগ্যবান যে তুমি বেঁচে গেছো,” মুনাজিরকে এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেছিল। “তুমি যেখানে চাও, আমরা তোমাকে সেখানেই নিয়ে যাবো।”
রাস্তার শেষের দিকে মুসলিম অধ্যুষিত এক এলাকায় এক আত্মীয়ের বাড়ি যেতে চান তিনি। সেখানে পৌঁছে দেখেন এরই মধ্যে শরণার্থীতে ভরে উঠেছে বাড়িটি। ছোট তিনটি কক্ষে আশেপাশের ১১টি পরিবারের ৭০ জন নারী, পুরুষ আর শিশু আশ্রয় নিয়েছে।
এদের মধ্যে এক যুবতী মা ছিলেন যিনি তার ছয় দিন বয়সী শিশুকে কোমরে বেঁধে প্রাণ বাঁচাতে তিন তলা ভবন থেকে লাফিয়ে পড়েছেন। তাদের সবার বাড়ি ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল। এদের মধ্যে কয়েক জনকে পুলিশ সেখানে নিয়ে এসেছে, আর কমপক্ষে ৪০ জনকে উদ্ধার করেছে ওই ভবনের মুসলিম নারীরা যা অসাধারণ সাহসের প্রতীক।
“আমি এখনো ভাবি যে পুলিশ কেন ওই এলাকায় গিয়ে আমাদের বাড়িগুলো রক্ষা করলো না। তারা কেন আরো বাহিনীর সাহায্য চাইলো না? এটা কি ইচ্ছাকৃত ছিল নাকি তাদের আর কোন বাহিনী ছিল না?” এমন প্রশ্ন করছিলেন দিল্লিতে চাকরীর খোঁজে আসা বিক্ষিপ্ত এক যুবক প্রকৌশলী।
আর এজন্যই খাজুরি খাসের ৭০ জন বাসিন্দা তাদের জীবন বাঁচানোর জন্য মুস্তারি খাতুনের কাছে কৃতজ্ঞ। যিনি ভোর বেলা সাহস করে প্রধান রাস্তা পার হয়ে, দাঙ্গা কবলিত এলাকায় গিয়ে মুসলিম নারী আর শিশুদের উদ্ধার করে নিয়ে এসে আশ্রয় দিয়েছেন।
উত্তেজিত দাঙ্গাকারীদের তোয়াক্কা না করে “চার-পাঁচবার” তিনি ওই এলাকায় গিয়েছেন এবং তাদের উদ্ধার করে অন্তত এক কিলোমিটার দূরে থাকা নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আশ্রয় দিয়েছেন।
নারী আর শিশুরা বের হওয়ার জন্য নিরাপদ জায়গা না পাওয়া পর্যন্ত এক ছাদ থেকে আরেক ছাদে লাফিয়ে লাফিয়ে পার করেছে। পুলিশের চেয়েও বেশি জীবন বাঁচিয়েছেন মুস্তারি খাতুন।
“এখন থেকে আমাদের নিজেরাই নিজেদেরকে বাঁচাতে হবে। দিল্লি আর আমাদের রক্ষা করবে না,” তিনি বলেন। তার কণ্ঠে দমে যাওয়া নয় বরং প্রতিরোধের স্বর। বিবিসি।
Leave a Reply