এ বছরের শুরুতে ভারতের বিজেপিশাসিত কর্নাটক রাজ্যের উদুপি জেলার একটি কলেজ কর্তৃপক্ষ তাদের প্রাতিষ্ঠানিক ড্রেস কোডে হিজাব নিষিদ্ধ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিম ছাত্রীরা প্রতিবাদ শুরু করেন। গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাজ্যের বিজেপি সরকার ওই কলেজ কর্র্তৃপক্ষের বিতর্কিত সিদ্ধান্তের পক্ষে সমর্থন দেয়। এতে হিজাববিরোধী হুজুগ ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য স্কুল-কলেজেও। হিজাব পরা মুসলিম ছাত্রীদের ক্যাম্পাসে ও ক্লাসে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। এমনকি কোথাও কোথাও মুসলিম শিক্ষিকাকেও বোরকা খুলে ক্যাম্পাসে ঢুকতে বাধ্য করা হয়েছে। হিজাবের বিরুদ্ধে পাল্টা গেরুয়া শাল ও স্কার্ফ পরে মাঠে নামে হিন্দুত্ববাদী গেরুয়া বাহিনীর অনুসারী ছাত্ররা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, গেরুয়া শাল পরা একদল হিন্দু ছাত্র মুসকান নামে এক বোরকাধারী মুসলিম ছাত্রীকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে দিচ্ছিল না। কিন্তু ছাত্রীটি কোনোভাবে ক্যাম্পাসে ঢুকতে সক্ষম হলে তাকে উদ্দেশ করে ওই উগ্র ছাত্রের দল ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিতে থাকে। সাহসী মুসকানও তাদের উদ্দেশে পাল্টা ‘আল্লাহু আকবার’ স্লোগান দেন। তার এ সাহসিকতা বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রশংসিত হয়।
হিজাব নিয়ে কর্নাটকের চলমান উত্তেজনা ও ঘটনাপ্রবাহ এমনকি উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ও পুদুচেরিতেও হিজাববিরোধী মনোভাব উসকে দিয়েছে। পুরো ভারতজুড়েই এখন হিজাব-বিতর্ক তুঙ্গে। ঘটনা গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত। হিজাব পরার অধিকারের দাবিতে কর্নাটকের উচ্চ আদালতে মামলা করেছিল কয়েকজন মুসলিম ছাত্রী। গত ১০ ফেব্রুয়ারি আদালত এক অন্তর্বর্তী আদেশে বলেছে, এ মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত হিজাবসহ কোনো ধরনের ধর্মীয় পোশাক পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসা যাবে না। রাজ্যের বিজেপি সরকার উচ্চ আদালতের এই নির্দেশ পালনে কঠোর অবস্থান নিয়েছে এবং উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সামাল দিতে ১৪৪ ধারা জারিসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পুলিশি প্রহরাও বসিয়েছে। উচ্চ আদালতের ওই অন্তর্বর্তী আদেশের সমালোচনা করে ভারতীয় সচেতন আইনজীবীরা এটিকে ‘মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ’ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। সর্বশেষ আরেকটি সরকারি কলেজে আদালতের নির্দেশ না মেনে হিজাব পরে আসায় ৫৮ জন মুসলিম ছাত্রীকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে (২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২, দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস)।
কর্নাটক সরকারের হিজাব নিষিদ্ধকরণ আন্তর্জাতিক আইনে বর্ণিত ধর্মীয় স্বাধীনতা ও বৈষম্যহীনভাবে শিক্ষা প্রাপ্তির অধিকার থেকে হিজাব পরিহিত মুসলিম নারী ও মেয়েদের বঞ্চিত করবে তাতে সন্দেহ নেই। অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি) ভারতে মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরা নিষিদ্ধকরণ এবং উত্তরাখন্ডের হরিদ্বারে প্রকাশ্যে মুসলিমদের গণহত্যার হুমকি দেয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, এই হিজাব নিষিদ্ধকরণ ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘন করেছে এবং নারী ও মেয়েদের ‘কলঙ্কিত’ ও ‘প্রান্তিকীকরণ’ করেছে। বিশ্বখ্যাত বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কি বলেছেন, ভারতে ইসলামোফোবিয়া সবচেয়ে প্রাণঘাতী রূপ নিয়েছে এবং ২৫০ মিলিয়ন মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নির্যাতিত সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হয়েছে।
পোশাক হিসেবে হিজাব ও বোরকা উদারনৈতিক বয়ানে ব্যক্তিস্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ ও অধিকারের ইস্যু হলেও ইসলাম ধর্মে এটি আল্লাহর বিধান। একটি আবশ্যকীয় ধর্মীয় অনুশাসন। আর ভারতীয় সংবিধানের ২৫ নং থেকে ২৮ নং অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকারের আওতাভুক্ত হিসেবে সে দেশের ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা সংরক্ষিত। কিন্তু ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, ‘আমি মনে করি, সব ধর্মের মানুষের উচিত স্কুলের ড্রেস কোড মেনে চলা’। সাংবিধানিক অধিকারের তোয়াক্কা না করে হিন্দুত্ববাদীরা যেকোনো মুসলিম নাম-চিহ্ন ও পরিচয় মুছে দিতে সবসময় উদ্যত। তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তীব্র সমালোচনা, প্রতিবাদ ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখে বিজেপি সরকার আইনিভাবে হিজাব নিষিদ্ধ না করলেও কথিত ‘স্কুল ড্রেস কোডে’র দোহাই দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করছে।
যে উদুপি জেলায় হিজাব-বিতর্কের সূত্রপাত, সেটি একটি উপকূলীয় অঞ্চল। আর সেটিকে বিজেপির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে দেখা হয়। শুধু তাই নয়, সমর হালার্নকর নামে ব্যাঙ্গালুরুর একজন শীর্ষ সাংবাদিক কর্নাটকের উপকূলীয় অঞ্চলকে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ‘ফুটন্ত কড়াই’ ও ‘প্রমাণক্ষেত্র’ বলে অভিহিত করেছেন।
ভারতীয় বিশ্লেষকরা বলছেন, উদুপির যে কলেজে হিজাব-বিতর্ক শুরু হয়েছিল, স্থানীয়ভাবেই সেটির সুরাহা হয়ে যেতে পারত। কিন্তু বিষয়টি এতদূর গড়ানোর পেছনে তারা প্রধানত স্থানীয় বিজেপি ও আরএসএসকে দায়ী করছেন। কারণ কর্নাটকের বিধানসভা নির্বাচন আগামী বছর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, হিজাব-বিতর্ককে ক্যাশ করে মুসলিমবিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তৈরি করে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ভোট ধরে রাখার একটা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বিজেপি। এ বিষয়ে রয়টার্সের এক রিপোর্ট বলছে, Opposition parties and many political analysts accuse the BJP of fomenting tensions in Karnataka to consolidate its appeal to majority Hindus, like they say it has elsewhere in the country. BJP’s Karnataka spokesperson Ganesh Karnik blamed Muslims for seeking what he called a different identity by insisting on wearing the hijab in class, and said the dispute could unite Hindus. He said the BJP was confident of retaining power in Karnataka state elections next year and then expanding further in the region. (18 Feb, 2022).
সুতরাং, গণেশ কার্নিকের বক্তব্যে বোঝা যায়, হিজাব-বিতর্কের সুযোগে কর্নাটকের আগামী বিধানসভা নির্বাচনে হিন্দু ভোট বাড়াতে মুসলিমবিদ্বেষ উসকে দেয়ার যে অভিযোগ বিজেপির বিরুদ্ধে উঠেছে, তা অমূলক নয়। এটা সত্য, সাম্প্রতিক সময়ে কর্নাটক রাজ্যে বিজেপির আধিপত্য তৈরি হয়েছে। যদিও কর্নাটক ছাড়া দক্ষিণ ভারতের আর কোনো রাজ্যে বিজেপি এখনো নির্বাচনে সফলতা পায়নি। কর্নাটকে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায় প্রায় ১৩ শতাংশ। আর ভারতের সর্বমোট মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় ১৭ শতাংশই দক্ষিণ ভারতে বাস করে। দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও ক্ষমতায় আসতে বিজেপি বদ্ধপরিকর। কিন্তু গত বছরের শেষ দিকে হিমাচল প্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও কর্নাটকসহ কয়েকটি রাজ্যের উপনির্বাচনে বিজেপি ভালো করতে পারেনি। বিশেষত কর্নাটকের দু’টি উপনির্বাচনের একটিতে (হাভেরি জেলার হাঙ্গালে) কংগ্রেসের কাছে হেরে গিয়েছিল। হাঙ্গাল এলাকাটি কর্নাটকের বর্তমান বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাইয়ের নিজ জেলায়। ফলে উপনির্বাচনটি বিজেপির জন্য ছিল ‘প্রেস্টিজ ইস্যু’। এ ছাড়া বাসবরাজ বিজেপি থেকে মুখ্যমন্ত্রী হলেও নির্বাচনী ময়দানে তার রাজনৈতিক নেতৃত্ব এখনো অপরীক্ষিত রয়ে গেছে। সে কারণে বাসবরাজ নিজে টানা ১০ দিন ওই এলাকায় গিয়ে সামনে থেকে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছিলেন এবং দলের জয় নিশ্চিত করতে ১০ জন মন্ত্রীকেও সেখানে প্রচারণায় পাঠানো হয়েছিল (২ নভেম্বর ২০২১, এনডিটিভি)। এরপরও হাঙ্গালে বিজেপির হার ঠেকানো যায়নি। দলীয় স্বার্থ পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় বাসবরাজ আগামী বিধানসভা নির্বাচন ঘিরে দলের মধ্যে নিজের অবস্থান ও প্রাসঙ্গিকতা টিকিয়ে রাখার জন্য নিজেকে আরো হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসেবে তুলে ধরতে হিজাব-বিতর্ক উসকে দিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে ভারতীয় পত্রিকা ‘দ্য প্রিন্ট’ এক রিপোর্টে খোলাখুলি লিখেছে, ‘Sources in the BJP pointed to Bommai’s desire to portray himself as committed to the party’s ideology in order to stay relevant among rivals. Another BJP leader said that the hijab row was initially between an educational institute and Muslim students but “once he (the CM) got embroiled in the matter, he couldn’t choose the timing of his intervention. A Karnataka BJP leader pointed out that “Bommai has no option but to become a Hindutva leader, and this compulsion is the defining point of his chief-ministership” (23 Feb. 2022, The Print).
যাই হোক, হিজাব-বিতর্কের নেপথ্যে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন। ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে ভারত তার ধর্মনিরপেক্ষ নীতি থেকে টলে গেছে। গরু জবাই নিষিদ্ধকরণ থেকে শুরু করে তিন তালাক আইন বাতিল, ধর্মান্তরবিরোধী বিল এবং সর্বশেষ কর্নাটকে হিজাব নিষিদ্ধকরণ- সবই হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডার অংশ। আর এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মুসলিমবিদ্বেষ ছড়িয়ে এবং দাঙ্গা লাগিয়ে হিন্দু ভোট জয় করে ক্রমেই আধিপত্য বিস্তারকারী বিজেপি ভারতজুড়ে সংখ্যালঘু মুসলমানদের দমন-পীড়নপূর্বক ‘মাৎস্যন্যায়ে’র রাজত্ব কায়েম করেছে।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
Leave a Reply