সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী রাষ্ট্রনায়ক, পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বাধিক উদার সমরনীতির প্রবর্তক, ভিন্নমত ও পথের অভাবনীয় ও অকল্পনীয় সম্মান ও স্বীকৃতি দানের নজির স্থাপনকারী মহান নেতা রাসুল (সা.) থেকে নিয়ে ইসলামের স্বর্ণযুগের সোনালি শাসননীতি ও হাল আমলের নামকাওয়াস্তের মুসলিম শাসকরাসহ পৃথিবীর কোনো কালে কোনো স্থানে কোনো অপকৌশলে রাষ্ট্রীয় ছত্রচ্ছায়ায় অমুসলিম দমন-পীড়ন আর নির্যাতনের কোনো ইতিহাস কেউ দেখাতে পারবে না।
সর্বপ্রথম মুসলিম শাসক রাসুল (সা.) কর্তৃক বিভিন্ন শ্রেণির অমুসলিমদের সামাজিক স্বীকৃতি দান, তাদের প্রতি প্রদত্ত সম্মান, সদাচরণ, ন্যায়পরায়ণতা এবং বিশেষত মক্কার জীবনের দুর্বিষহ নির্যাতনকারী শত্রু-নেতাদের প্রতি তাঁর মহানুভবতার কথা ইতিহাসের পাতায় পাতায় বিস্তৃত। সেগুলো পরিসংখ্যান এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে আর টানতে চাই না।
মুসলিম রাষ্ট্রনায়করা রাজ্য জয় করেছেন, সাম্রাজ্য স্থাপন করেছেন, কিন্তু এসব করতে গিয়ে কখনো কোথাও বিজিতদের ওপর প্রতিশোধস্পৃহায় উন্মত্ত হয়ে মানবতাকে ভূলুণ্ঠিত করে ইসলামের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেননি। যেমনটি করেছেন কথিত সভ্যতার দাবিদার বিভিন্ন অমুসলিম শাসকরা।
মুসলিম শাসকদের উদারতা, মানবতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন নিয়ে আলোচনা করতে চাইলে সর্বাগ্রে রাসুল (সা.) এর মক্কা বিজয়কালীন মহানুভবতা ও ক্ষমার অনুপম দৃষ্টান্তের কথা না বললেই নয়। সুদীর্ঘকাল যাদের নির্যাতন আর নিপীড়নের কারণে প্রিয় মাতৃভূমি মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করলেন, গড়ে তুললেন পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে কার্যকর রাষ্ট্রব্যবস্থা। সেখানেও সেই মক্কাবাসীর নানা হামলা প্রতিরোধ আর অবরোধের ধূম্রজাল সৃষ্টির পাঁয়তারা করে আসছিল। সব কিছুর প্রাচীর ডিঙিয়ে তিনি যখন মক্কা বিজয় করলেন তখন তিনি একটি প্রাণীকেও হত্যা করেননি। কাউকে বিতাড়িত করেননি নিজের বসতভিটে থেকে।
খলিফা ওমর (রা.)-এর শাসনামলে আবু উবায়দাহ ইবনুল জাররাহ (রা.) জেরুজালেম দখল করলেন। কিন্তু সেদিন ওমর (রা.) কাউকে হত্যার নির্দেশ তো প্রদান করেনইনি; বরং তিনি সেখানে ক্ষমা ও উদারতার যে পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন তাতে দলে দলে সাধারণ জনতা ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। সেখানে তিনি খ্রিস্টানদের প্রদান করেন পরিপূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা। এমনকি খ্রিস্টানরা ইহুদিদের সেখানে থাকার কোনো অধিকার দিত না তিনি তাদেরকেও সেখানে বসবাসের সুযোগ করে দিলেন।
ইতিহাসে সুপরিচিত মুসলিম শাসক তারেক বিন জিয়াদ কর্তৃক ৭১২ খ্রি. ইউরোপীয় ভূখণ্ড দখল করে নেওয়া সময়কালীন দৃশ্যপটেও চিত্রিত হয়েছে একই রীতি। সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয় মুসলিম শাসনব্যবস্থা। কিন্তু স্পেন দখল ও তৎপরবর্তী উমাইয়া শাসন প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত কোনো সময়েই চালানো হয়নি ন্যূনতম কোনো গণহত্যা। বরং সেখানে স্থাপন করা হয় খ্রিস্টানদের সঙ্গে এক সম্প্রীতি ও সৌহার্দপূর্ণ শাসনব্যবস্থার। কিন্তু ১৪৯২ খ্রি. সেখানে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটলে রাজা ফার্ডিনান্ড ও রানি ইসাবেলার প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডে মুসলিম গণহত্যা ও মুসলিম নিদর্শনাবলি ধ্বংসের কথা ইতিহাস ঢেকে রাখতে পারেনি।
১০৯৯ খ্রি. ক্রুসেডারদের জেরুজালেম দখল করার সময় পরিচালিত অমানবিকতা ও গণহত্যার উপাখ্যান তো অবর্ণনীয় ও অভাবনীয়। কিন্তু ১১৮৭ সালে জেরুজালেম পুনরুদ্ধারের সময় ঠিক তার উল্টো আচরণ করেছিলেন সালাহ উদ্দিন আইয়ুবী। তিনি চালাননি কোনো গণহত্যা; বরং সম্পূর্ণ রক্তপাতহীনভাবে জয় করেন জেরুজালেম। ইচ্ছা করলে তিনি ১০৯৯ সালের প্রতিশোধ নিতে পারতেন। তিনি তা না করে ক্ষমা ও দয়ার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন।
পৃথিবীময় যেসব অঞ্চলসমূহে দীর্ঘকাল মুসলিম শাসন কার্যকর ছিল এর মধ্যে অন্যতম ভারত উপমহাদেশ। সেখানে নিত্যদিনের জীবনসংগ্রামে ধর্ম, বর্ণ আর বিভেদকে দূরে ঠেলে দিয়ে বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের পথে বহু শতাব্দীর সরব উপস্থিতি নিয়ে ইসলাম ও মুসলমান হয়ে উঠেছিল ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বরং ইসলামের আগমন ভারতকে ভিতর থেকে নতুন এক রঙে রাঙিয়ে তোলে। ভারতবর্ষে মুসলিমদের আগমন এক দিনে ঘটেনি। প্রাচীনকাল থেকেই ভারতের সঙ্গে চলে আসছিল আরবদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক। সেসব বাণিজ্যিক কাফেলার সঙ্গে ভারতে আগমন করে অনেক ধর্মপ্রচারক, অলি-আউলিয়া। রাসুল (সা.)-এর জীবদ্দশাতেই সাহাবী মালিক ইবন দিনারের নেতৃত্বে ২০ জনের একটি ইসলাম প্রচারক দল ভারতে আসেন। ৬২৯ হিজরিতে ভারতের কেরালায় প্রতিষ্ঠা করেন চেরামান জুম্মা মসজিদ। একই সময়ে গুজরাট ও বাংলাতেও স্থাপিত হয় অনেক মুসলিম উপাসনালয়।
পরিশেষে ধর্ম প্রচারকদের হাতে নবদীক্ষিত মুসলিমদের স্থানীয় শাসকগণ কর্তৃক অসহনীয় নির্যাতন, শ্রীলঙ্কা থেকে হজের উদ্দেশে ভ্রমণরত জাহাজ লুণ্ঠনের মতো অসংখ্য অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অষ্টম শতাব্দীতে মহাবীর মুহাম্মাদ বিন কাশেমের নেতৃত্ব পরিচালিত অভিযানে ভারতে মুসলিম শাসনের ভিত রচিত হয়। এরপর যথাক্রমে মুহাম্মাদ গজনবী, কুতুবউদ্দিন আইবেক ভারতে বিজয়ের ধারা অব্যাহত রেখেছেন। অবশেষে ১৩১৬ খ্রি. পর্যন্ত সুলতান আলাউদ্দিন শাহ সমগ্র ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। যার ধারা ১৮৫৮ খ্রি. পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
এই সুদীর্ঘকাল শাসনে মুসলিমদের রাজ্য জয় ও শাসন প্রতিষ্ঠার কোনো ক্ষেত্রেই তারা কোনো গণহত্যা কিংবা ধ্বংসযজ্ঞ চালাননি। বরং অত্যন্ত সৌহার্দ ও সম্প্রীতি স্থাপন করে তাঁরা সাম্রাজ্য শাসন করেছেন। ভারতের মুসলিম শাসকরা ইচ্ছা করলে বহু শতাব্দীর এই শাসনামলে সব ধরনের ভিন্নমত, জাত ও ধর্মকে চিরতরে ভারতের মানচিত্র থেকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দিতে পারতেন। সেটার প্রয়োজন ইসলাম কখনোই বোধ করেনি। কারণ ভারতসহ পৃথিবীর যে প্রান্তেই মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা হয়েছে সেখানেই মুসলিম শাসক, সেনানায়ক ও মুসলিম জনতার উদার নীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধে আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে স্থানীয় জনতা ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। ভারতের মুসলিম শাসকদের আচরণের বর্ণনা দিতে গিয়ে ভারতেরই প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও গবেষক ড. তারাচাঁদ লেখেন, ‘মুসলিম বিজয়ীরা বিজিতদের ওপর সংগত আচরণ করেন এবং জনগণের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ প্রদর্শন করেন। ভূমি রাজস্বের ক্ষেত্রে তাঁরা ভারতীয়দের পূর্বরীতি চালু রাখেন। হিন্দু পূজারি, যোগী, পুরোহিতদের মন্দিরে পূজা অর্চনা করার পূর্ণ সুযোগ দেওয়া হয়। তাদের ওপর অতি অল্প পরিমাণের একটি কর (জিজিয়া) ধার্য করা হয়।’
প্রিয় পাঠক! বহু শতাব্দীর হিন্দু-মুসলিম সৌহার্দ ও সম্প্রীতি নিয়ে ভারতের মুসলমানরা রচনা করে এসেছেন এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। সমকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, ‘সারে জাহাঁ সে আচ্ছা হিন্দুস্তান হামারা’ এর মতো সাম্যের গান।
এই হলো মুসলিম শাসকদের উদারতা আর মানবতার প্রতি শ্রদ্ধার সামান্যতম চিত্রমাত্র। এ ছাড়া উসমান (রা.), আলী (রা.) মুয়াবিয়া উমর ইবনে আব্দুল আজিজ, ইমামুদ্দিন, নুরুদ্দীন (রহ.)সহ হাজারো মুসলিম শাসকের অভাবনীয় আর অচিন্তনীয় মহানুভবতার কথা বিশ্ব কখনো ভুলতে পারবে না।
লেখক : অনুবাদক ও মুহাদ্দিস
ফকিরের বাজার, নেত্রকোনা।
Leave a Reply