পানিই পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রেখেছে। পানি ছাড়া জীবন ও সভ্যতা অচল। পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগ পানি। সাদামাটাভাবে পানির অফুরন্ত উৎস নিয়েই পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে। নিরাপদ পানির সুষ্ঠু ব্যবহারের অভাবে প্রকৃতি তার বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে, জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। নিরাপদ পানির অভাব জীবনযাত্রার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যে দেশের মানুষ পানিতে হাবুডুবু খায়, ডুবে মারা যায়, বন্যায় ভাসে, সে দেশে পানির সরবরাহ কিংবা পানি কিনে খাওয়ার কথা উঠেছে। পানি কিনে খেতে হবে,পানির অভাবে ভুগতে হবে এমন ভাবনা আগে কেউ ভাবেনি। দুনিয়াজুড়ে পরিবেশ দূষণের সাথে পাল্লøা দিয়ে পানিদূষণের ভয়াবহতা দিন দিন বেড়েই চলছে, পানির অভাব তীব্র হয়ে উঠছে। এ সমস্যা নিরসনের জন্য পানি ব্যবস্থাপনা জরুরি। ১৯৬০ সাল থেকে এ পর্যন্ত স্বাদু পানির সহজলভ্যতার পরিমাণ অর্ধেকে নেমে এসেছে, সুপেয় পানির ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এই পানির চাহিদা, সরবরাহের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেড়ে যাবে। স্বাভাবিকভাবেই সুপেয় পানি হয়ে উঠবে দুর্লভ।
ভূগর্ভস্থ পানি অনেক আগেই আবর্জনা এবং রাসায়নিক বর্জ্যরে কারণে দূষিত হয়েছে। অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। ভূপৃষ্ঠের প্রাকৃতিক জলাধারগুলো শুকিয়ে মিলিয়ে গেছে। খাল-বিল, নদী-নালা শুকিয়ে অস্তিত্বহীন। তবু দখলদারদের তৃপ্তি মিটে না। ফলে জলজ উদ্ভিদ এবং প্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে, পুকুর ভরা মাছের দেশে মাছের দেখা মেলা ভার। রসনা তৃপ্ত করার বিভিন্ন প্রজাতির দেশী মাছ আর দেখা যায় না। সারা বছর যেসব জলাশয় পুকুর বিল হাওর-বাঁওড় বা ছোট ছোট নদী এবং উপনদীতে পানির সরবরাহ থাকত সেগুলো এখন শুকিয়ে ফসলের মাঠ অথবা ধূসর।
পদ্মা নদীর দুরবস্থা, তিস্তা নদীর করুণ দশা আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে করুণ পরিণতির কথা। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা আর তুরাগ নদীর ঘন কালো দুর্গন্ধযুক্ত পানির দিকে তাকালে গা শিউরে ওঠে। এসব দুর্গন্ধযুক্ত পানির সাথে লাখো মানুষ ও পশুপাখির বসবাস করতে হয়। ফলে বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ, কলেরা, ডায়রিয়া, টাইফয়েড ও হৃদরোগ বাড়ছে। ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধির ফাঁদ এই দূষিত পানি। কলকারখানার অনিয়ন্ত্রিত বর্জ্য ও বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্যাদির কারণে নগরের অপরিশোধিত দূষিত পানি নদীতে বা পুকুরে গিয়ে পড়েছে। বয়স্ক, গর্ভবতী মা এবং শিশুরা দূষিত পানির কারণে সবচেয়ে বেশি মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে। আর্সেনিকযুক্ত পানির প্রকোপ ও লবণাক্ততার কারণে বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ ও প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। বিপন্ন হচ্ছে কীটপতঙ্গ ও পাখপাখালির জীবন। ফলে পশুপাখি এখন আর আগের মতো দৃষ্টিগোচর হয় না। কিছুসংখ্যক অর্থলোভী লোকের কারণে পরিবেশ আজ দূষিত। মানবজীবন হুমকির সম্মুখীন।
পরিবেশ দূষণের কারণে গড় উষ্ণতা ও প্রকৃতির খামখেয়াল বেড়েছে। ঋতুচক্রে দূষিত পানির প্রচণ্ড প্রভাব পড়ছে। সবাই যদি এখনই সচেতন না হই আর হ্রদের মতো হারিয়ে যাবে আমাদের নদ-নদী। চরম প্রাকৃতিক বিপর্যয় এড়ানোর জন্য এখনই ব্যবস্থা নেয়া দরকার অত্যন্ত জরুরিভাবে। এ ক্ষেত্রে একটি সুচিন্তিত পানি ব্যবহার নীতিমালা থাকা দরকার। প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি যেন ব্যবহৃত না হয় সেদিকে সবারই দৃষ্টি দেয়া দরকার। পানির সংরক্ষণ করা দরকার। এমনকি দূষিত পানিকে কিভাবে আবার ব্যবহার উপযোগী করে তোলা যায় সে ব্যাপারে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সমাবেশ, আলোচনা সভা, রচনা প্রতিযোগিতা, টেলিভিশনে পানি দূষিত হওয়ার কারণ এবং এর অপকারিতার ওপর ঘন ঘন আলোচনা হওয়া দরকার। বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতার আয়োজন করে শিশুদেরও এ ব্যাপারে সচেতন করা প্রয়োজন। এটি একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যা। এ ব্যাপারে যেমনি দেশের ভেতরে মানুষের ও সরকারের, তেমনি আন্তর্জাতিক পর্যায়েরও সচেতন হওয়া দরকার। এ ক্ষেত্রে পরিবেশ মন্ত্রণালয়, পানি মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত নীতিমালা প্রয়োজন। নইলে নিকট ভবিষ্যতে ‘পানির দামে সস্তা পানি’ সোনার দামেও মিলবে কি না সন্দেহ।
লেখক : অধ্যাপক ও চক্ষুরোগ রিশেষজ্ঞ
Leave a Reply