সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন নাহার রুনিকে হত্যার সাড়ে ৯ বছরেও আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি তদন্ত সংস্থা। বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে এখন পর্যন্ত ৮২ বার সময় নেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ গত ২২ আগস্ট ধার্য দিনেও প্রতিবেদন দাখিলে ব্যর্থ হওয়ায় সিএমএম আদালত আগামী ২১ সেপ্টেম্বর পরবর্তী দিন ধার্য করেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা র্যাব সদর দপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার মো. শফিকুল আলম গত বছরের ৭ অক্টোবর অবশ্য একটি প্রতিবেদন দেন আদালতকে। তাতে উল্লেখ করা হয়- ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া দুজন অজ্ঞাত ব্যক্তির ডিএনএ থেকে ছবি প্রস্তুতের মাধ্যমে হত্যাকারীদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে। কিন্তু দীর্ঘ ১১ মাসেও যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত দুটি প্রতিষ্ঠান সেই ছবি আঁকার কাজ শেষ করতে পারেনি বলে জানিয়েছেন র্যাবের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা।
হত্যাকা-ের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন সাংবাদিকদের বলেছিলেন- ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তার করা হবে। নৃশংস হত্যাকা-ের দুদিন পর ওই সময়ের পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছিলেন- তদন্তে ‘প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি’
হয়েছে। সর্বশেষ তদন্ত সংস্থা র্যাবও কয়েক বছর ধরে একই ‘অগ্রগতি’র গল্প শুনিয়ে আসছে। সর্বশেষ আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার মো. শফিকুল আলম উল্লেখ করেন, তিনি ২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে কাজ শুরু করেছেন। পূর্ববর্তী তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্তের আনুষঙ্গিক কাজসহ মোট আটজনকে এ মামলায় গ্রেপ্তার করেন। তাদের মধ্যে ছয়জন বর্তমানে জেলহাজতে আছেন এবং দুজন জামিনে মুক্ত। এদিকে মামলাটি যথাযথভাবে তদন্তের লক্ষ্যে ঘটনাস্থল থেকে জব্দ আলামতের ডিএনএ পরীক্ষার জন্য আদালতের অনুমতিক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের আইএফএসে (ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফরেনসিক সার্ভিস) পাঠানো হয়। সেই পরীক্ষার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আগে পাঠানো আলামতগুলো এবং গ্রেপ্তার করা আসামিদের বুকল সোয়াব পর্যালোচনায় অজ্ঞাতনামা দুজন পুরুষের ডিএনএ পাওয়া গেছে। তদন্তকালে অজ্ঞাতনামা ওই পুরুষকে চিহ্নিতের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে প্যারাবন স্টারশট নামে যুক্তরাষ্ট্রের অপর একটি ডিএনএ ল্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। ডিএনএ থেকে অপরাধী বা জড়িত ব্যক্তির ছবি প্রস্তুতের সক্ষমতা রয়েছে ওই প্রতিষ্ঠানটির। বর্তমানে আগের প্রতিষ্ঠান আইএফএসের সঙ্গে সমন্বয় করে ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের ছবি প্রস্তুতের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এমনকি আইএফএসে সংরক্ষিত সেই ডিএনএ প্যারাবন স্টারশটকে সরবরাহের সার্ভিস চার্জ হিসেবে এক হাজার ২০০ মার্কিন ডলার ফি চাওয়া হয়। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে নির্ধারিত সেই অর্থও পরিশোধ করা হয়েছে এরই মধ্যে। পরীক্ষার অগ্রগতি বিষয়ে জানতে সর্বশেষ গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর আইএফএস ল্যাবকে ই-মেইলও পাঠানো হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ওই প্রতিষ্ঠানটি এ বিষয়ে এখনো কোনো মতামত দেয়নি। তবে ডিএনএ প্রযুক্তির মাধ্যমে সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহের প্রচেষ্টাসহ মামলার তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে, যা বিজ্ঞ আদালতের সদয় অবগতির জন্য জানানো হলো।
এর আগেও একটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে আদালতকে জানানো হয়েছিল, মামলায় জব্দ আলামতের সঙ্গে ম্যাচিংয়ের জন্য গ্রেপ্তার আট আসামি ও সন্দেহভাজন ২১ আত্মীয়স্বজনের ডিএনএ নমুনা যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি তদন্তকালে ঘটনাস্থলের আশপাশের লোকজন, নিহতের আত্মীয়স্বজন, অফিসের সহকর্মী ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিসহ ১৫০ ব্যক্তির জবানবন্দি ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
ডিএনএ থেকে ছবি তৈরির প্রক্রিয়াকে সময়ক্ষেপণের হাতিয়ার বলছেন সাগর-রুনির স্বজনরা। দীর্ঘ দিনেও এই হত্যাকা-ের রহস্য উন্মোচন না হওয়ায় তারা হতাশ। পূর্বের তদন্তকারী সংস্থা ডিবি পুলিশের মতো র্যাবও ব্যর্থ বলে মনে করেন নিহত সাংবাদিক রুনির ভাই নওশের রোমান। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ‘এসব (ডিএনএ থেকে ছবি) কিছুই না। এগুলো আসলে সময়ক্ষেপণের হাতিয়ার হিসেবে সামনে আনা হচ্ছে। এটি নিয়ে আর কিছু বলার নেই আমাদের।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আমাদের সময়কে বলেন, ‘ডিএনএ থেকে ছবি তৈরির বিষয়টির কী ধরনের অগ্রগতি আছে আমাদের এখনো জানানো হয়নি।’ তবে সেখান থেকে ছবি এবং ডিএনএ প্রতিবেদন পেলেও আসামিদের শনাক্ত করা কঠিন হবে বলে মনে করেন তিনি।
রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া ফ্ল্যাট থেকে ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে বেসরকারি টিভি চ্যানেল মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনির ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। ঘটনার পর শেরেবাংলানগর থানায় হত্যা মামলা করা হয়। থানাপুলিশ হয়ে চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার তদন্তভার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওপর ন্যস্ত করা হয়। ৬২ দিনের মাথায় হাইকোর্টে ব্যর্থতা স্বীকার করে ডিবি। এর পর আদালতের নির্দেশে তদন্তভার নেয় র্যাব। ভিসেরা পরীক্ষার জন্য সাগর-রুনির লাশ কবর থেকে উঠায় সংস্থাটি। ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী নিহত সাংবাদিক দম্পতির শিশুপুত্র মাহীর সারওয়ার মেঘের সঙ্গেও দফায় দফায় কথা বলা হয়। র্যাব জানায়, ঘটনাস্থল থেকে সংগ্রহ করা সাগর-রুনির রক্তমাখা জামাকাপড়, বঁটি, মোজাসহ কিছু আলামত পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণাগারে পাঠানো হয়। মামলায় আমেরিকান দুটি প্রতিষ্ঠানের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা নেওয়া হয়েছে এ ক্ষেত্রে। কিন্তু এখন পর্যন্ত র্যাবও এ ঘটনার তদন্তে কোনো কিনারা করতে পারেনি।
মামলার নথি থেকে দেখা যায়, গ্রেপ্তার আসামিদের মধ্যে নিহত রুনির কথিত বন্ধু তানভীর রহমান, বাড়ির দারোয়ান পলাশ রুদ্র পাল জামিনে আছেন। এ ছাড়া বাড়ির সিকিউরিটি গার্ড এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবির, রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মিন্টু ওরফে বারগিরা মিন্টু ওরফে মাসুম মিন্টু, কামরুল হাসান অরুন ও আবু সাঈদ কারাগারে রয়েছেন।
Leave a Reply