আফগানিস্তানের জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে অবস্থানরত বাংলাদেশি সৈন্য ও সাধারণ মানুষ কাবুলে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
আফগানিস্তানের জনগণ ওই সময় বাংলাদেশিদের সাদরে গ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩-৭৪ সালে আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে আফগান এয়ারলাইন্সের বিমান ভাড়া করে পাকিস্তানে আটকেপড়া বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনা হয়। ইসলামি সহযোগিতা সংস্থায় (ওআইসি) বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান একসঙ্গে কাজ করে।
২০০৭ সালে আফগানিস্তান দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) সদস্য হতে চাইলে বাংলাদেশ তাতে দ্ব্যর্থহীন সমর্থন দেয়। এমন সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের মধ্যে সহযোগিতা তেমন গড়ে ওঠেনি, যা দুর্ভাগ্যজনক; যদিও দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা, বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সামাজিক ক্ষেত্রে যোগাযোগ বৃদ্ধির অবারিত সম্ভাবনা রয়েছে।
আফগানিস্তানে নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ দেখা দেওয়ার কারণে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সহযোগিতা প্রত্যাশিত মাত্রায় গড়ে ওঠেনি। দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার প্রবেশদ্বারে অবস্থিত দেশটির দুর্ভাগ্য-সাম্প্রতিক ইতিহাসের বেশিরভাগ সময় দুর্গম পর্বতের জনপদের মানুষের জীবন যুদ্ধে কেটেছে। স্নায়ুযুদ্ধের কালে সত্তরের দশকে সেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নপন্থি সরকার ক্ষমতায় ছিল।
এরই এক পর্যায়ে ১৯৭৯ সালে লিওনিদ ব্রেজনেভের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সরাসরি সৈন্য পাঠিয়ে আফগানিস্তান অধিগ্রহণ করে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আফগানিস্তানের ব্যাপক জনগোষ্ঠী সোভিয়েত আগ্রাসনকে মেনে নিতে পারেননি। ওই সময়ে আফগান মুজাহিদদের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু হয়। ১০ বছর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর সোভিয়েত বাহিনী ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে বিদায় নেয়।
ওই সময় ক্ষমতা নিয়ে আফগান মুজাহিদদের মধ্যে তুমুল বিরোধ দেখা দেয়। তখন আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি মাদ্রাসার ছাত্ররা গড়ে তোলেন তালেবান নামে সংগঠন। তার নেতৃত্ব দেন মোল্লা ওমর, যিনি ওই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদ লাভ করেন। তখন পাকিস্তানের ক্ষমতায় ছিলেন জিয়াউল হক। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই তালেবানদের জিহাদি মতাদর্শ এবং অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে।
সশস্ত্র উগ্রবাদী গোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও প্রথমে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী এবং পরে আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে প্রধানত পাকিস্তানের সীমান্তসংলগ্ন অঞ্চলে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মধ্যে তালেবানরা জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তারা এতটাই শক্তি অর্জন করেন যে, ১৯৯৬ সালে নজিবুল্লাহর সরকারকে হটিয়ে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে নেন। তালেবানরা শরিয়া আইনকে তাদের নিজেদের মতো ব্যাখ্যা করে কট্টর শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন।
সেখানে নারীদের অধিকার কেড়ে নেওয়া, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করা, পুরুষদের এক মুঠো দাড়ি রাখা বাধ্যতামূলক করার মতো ইসলামি শাসন কাঠামোর নামে জবরদস্তিমূলক অনেক কিছু প্রবর্তন করা হয়। তালেবানরা ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠীকে আফগানিস্তানে আশ্রয় দিতে থাকেন। বিন লাদেনের সঙ্গে তালেবান নেতা মোল্লা ওমরের আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সৌদি বংশোদ্ভূত এ জঙ্গি নেতা আফগানিস্তানে বসবাস করতে থাকেন। ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। বিমান হামলায় নিউইয়র্কে অবস্থিত টুইন টাওয়ার ধুলায় মিশে যায়।
হোয়াইট হাউজ ও পেন্টাগনে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে জঙ্গিরা। যুক্তরাষ্ট্র হামলার জন্য আল কায়দাকে দায়ী করে জঙ্গিগোষ্ঠীর নেতা ওসামা বিন লাদেনকে মোস্টওয়ান্টেড ঘোষণা করে। মোল্লা ওমরের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন তালেবান সরকার বিন লাদেনকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিতে অস্বীকার করে। তখনই আফগানিস্তানে মার্কিন হামলা শুরু হয়। ওই হামলায় আফগানিস্তানের ক্ষমতা থেকে তালেবানের পতন ঘটে।
আফগানিস্তানে ক্ষমতার মসনদে বসে যুক্তরাষ্ট্র্রের সমর্থনপুষ্ট সরকার। পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রিত সরকারের সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের মিত্র ন্যাটোও সৈন্য দিয়ে সহায়তা করে। তালেবানরা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকেন। যুদ্ধক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সৈন্যের সঙ্গে আফগানিস্তানের সরকারের সেনারাও যোগ দেন। যুদ্ধ চলাকালে মোল্লা ওমর মারা যান। পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ থেকে ওসামা বিন লাদেনকে ধরে নিয়ে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও মার্কিন সেনারা পাকিস্তানে সামরিক ঘাঁটি করে আফগানিস্তানে হামলা চালিয়ে ছিল।
তালেবান, আল-কায়দা এবং অপরাপর জঙ্গিগোষ্ঠী পাকিস্তানের ভূখণ্ড ব্যবহার করেছে। পাকিস্তান থেকে বিন লাদেনকে গ্রেফতার তারই প্রমাণ বহন করে। ওসামা বিন লাদেন কখনো যুক্তরাষ্ট্রের পুতুল ছিলেন না। বিশ বছর যুদ্ধের পর চলতি ২০২১ সালের আগস্টে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তান ত্যাগ করে। কাতারের রাজধানী দোহায় তালেবান নেতাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ধারাবাহিক আলোচনার মাধ্যমে অনেকটা নিরাপদে মার্কিন বাহিনী প্রস্থান ঘটে।
তালেবানরা একে একে সব প্রাদেশিক রাজধানী দখলের পর অনেকটা বিনা বাধায় রক্তপাত ছাড়া দেশটির রাজধানী কাবুল দখল করে নেন। পালিয়ে দেশত্যাগ করেন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয় পরাশক্তি তথা বিদেশি শক্তি আফগানিস্তানে যুদ্ধে কার্যত পরাজয়বরণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের ফিরে যাওয়া শুধু যুদ্ধে পরাজয় নয়; বরং এর কৌশলগত কিছু দিক আছে।
মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সফরকালে এসব স্পষ্ট হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধনীতি থেকে আপাতদৃষ্টিতে সরে আসতে চাইছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকেও দৃষ্টি ঘুরিয়ে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের বাণিজ্যিক আগ্রাসন মোকাবিলায় মনোযোগী হচ্ছে। ফলে একদিকে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রত্যাহার হলেও ট্রাম্পের শাসনকালে বিযুক্ত হওয়া ট্রান্স এশিয়া পার্টনারশিপে আরও গভীরভাবে যুক্ত হচ্ছে। কমলা হ্যারিসের সফরে সেটাই দেখা যাচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ কী, তা নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো এক ধরনের ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় নেমেছে। আফগানিস্তানে যুদ্ধ বাবদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুই ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে বলে স্বীকার করেছে। আমার ধারণা, প্রকৃত ব্যয় তার চেয়েও বেশি। যুদ্ধে গোয়েন্দা তৎপরতা এবং সোর্সমানিসহ অনেক গোপন ব্যয় থাকে, যে ব্যাপারে রাষ্ট্র কখনো প্রশ্ন করে না। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সৈন্য প্রাণ হারিয়েছেন।
আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়া ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের আর কোনো বিকল্প ছিল না। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য প্রত্যাহার শর্তযুক্ত। দোহায় তালেবান নেতাদের কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্র অঙ্গীকার আদায় করেছে যে, তালেবান ক্ষমতায় গেলে দেশটিতে আন্তর্জাতিক কোনো সন্ত্রাসীকে আশ্রয় দিতে পারবে না। শর্ত মেনে তালেবান কাবুল দখল করে চরকি কারাগার খুলে দিলেও আইএস জঙ্গিদের মুক্তি দেয়নি।
তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ তার মিত্রদের সবচেয়ে বড় ভয় হলো, তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী চীন আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তার করে বসে কিনা। চীন একদা নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করলেও এখন তারা এ অঞ্চলে প্রভাব বলয় সৃষ্টি করতে মরিয়া। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে চার দেশ যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত যৌথভাবে কোয়াড নামের সামরিক জোট গঠন করেছে। চীন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) নামে দেশে দেশে অবকাঠামো উন্নয়নে বিপুল বিনিয়োগ করেছে। পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে অর্থনৈতিক করিডোর দেশ দুটিকে বড় কৌশলগত অংশীদারে পরিণত করেছে।
এসব কারণে চীনও একটা প্রভাব বলয় সৃষ্টি করছে। তালেবানদের প্রতি চীন শর্তযুক্ত সমর্থন দিয়েছে। আফগানিস্তানের সঙ্গে চীনের সীমান্ত প্রদেশ শিনজিয়ানে সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলমানরা তালেবানদের কোনো মদদ পাবে না।
তালেবানরা এরই মধ্যে বলেছে, উইঘুর মুসলমানদের ওপর কোনো নির্যাতন হচ্ছে না। তাদের ভাষ্য, পশ্চিমারা অহেতুক প্রচার চালাচ্ছে। তালেবানের কাবুল দখলের পর চীন স্পষ্ট সমর্থন ব্যক্ত করেছে। তালেবান ক্ষমতা গ্রহণের পর পশ্চিমা দেশগুলো নিরাপত্তার আশঙ্কায় কাবুলে দূতাবাস বন্ধ করে স্টাফদের ফিরিয়ে নিলেও রাশিয়া বন্ধ করেনি; বরং রাশিয়া বলছে, তারা নিরাপত্তাহীন মনে করছে না।
প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান ও ইরান এখনই তালেবানকে স্বীকৃতি না দিলেও নমনীয় মনোভাব পোষণ করছে। তালেবানদের ব্যাপারে ভারত খুবই সতর্ক। আফগানিস্তানে মার্কিন সমর্থনপুষ্ট সরকার থাকাকালে ভারত বিপুল বিনিয়োগ করেছিল। এ সময় প্রায় ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে ভারত। কাবুলের বাইরেও জালালাবাদ, কান্দাহার, মাজার ই শরিফ ও হেরাতে ভারতের কনস্যুলেট রয়েছে।
তালেবান নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর কাবুলে দূতাবাসসহ সব কনস্যুলেট বন্ধ করেছে ভারত। ভারতের জন্য পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ থাকা স্বাভাবিক। তবে ভারতের বিপুল বিনিয়োগ থাকায় এবং প্রতিদ্বন্দ্বী চীন-পাকিস্তান যুক্ত থাকায় ভারতও সাময়িক বিরতির পর আফগানিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হবে বলে মনে হচ্ছে। তুরস্ক ন্যাটোর মতো নয়; নিজেদের মতো চিন্তা করছে। তালেবানদের প্রতি পাকিস্তানের সহজাত সমর্থন থাকলেও বড় উদ্বেগ অনুপ্রবেশ নিয়ে।
আগের তালেবান সরকারের আমলেও বিপুল সংখ্যক আফগান শরণার্থী পাকিস্তানে অনুপ্রবেশ করেছিলেন। তাদের অনেকেই আফগানিস্তানে ফিরে যাননি। বর্তমানে আফগান সীমান্তে পাকিস্তান কাঁটাতারের বেড়া দিলেও শরণার্থীর ঢল ঠেকাতে পারেনি। শুধু পাকিস্তান নয়; উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, ইরান, চীনসহ আফগানিস্তানের সঙ্গে সীমান্তবর্তী সব দেশ শরণার্থীর ঢল ঠেকাতে তাদের স্থল সীমান্ত সিল করে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র যেসব দেশে যুদ্ধ করেছে; যুদ্ধের পর ওই সব দেশের অবস্থা এক রকম নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানে আণবিক বোমা ফেললেও এখন দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বন্ধু। ভিয়েতনামের সঙ্গে এখন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো। অপরদিকে ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া গৃহযুদ্ধকবলিত। মধ্যপ্রাচ্যে তেল সম্পদের কারণে এমন পরিস্থিতি বলে অনেকে মনে করেন। আপাতদৃষ্টিতে আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা কম।
তালেবানরা এবার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর বিজয় উদযাপন করেনি। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মিলিত সরকার গঠনের লক্ষ্যে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। নারী স্বাধীনতাসহ কৌশলগত বিভিন্ন বিষয়ে মডারেট ফেস নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। যদিও তারা বলছে, শরিয়া কাঠামোর বাইরে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তারা বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করছে। বিশেষ করে সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই, জ্যেষ্ঠ নেতা আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহ ও ধর্মীয় নেতা গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের সমন্বয়ে গঠিত ‘হাই কাউন্সিল ফর ন্যাশনাল রিকন্সিলিয়েশন’-এর সঙ্গে আলোচনা মূলত বহির্বিশ্বে স্বীকৃতি পাওয়ার লক্ষ্যে তালেবানের প্রচেষ্টার অংশ বলে মনে হচ্ছে।
তবে বাস্তবে নতুন তালেবান কতটা মডারেট হতে পারবে, সেটা ভবিষ্যৎ বলতে পারবে। আপাতত মনে হচ্ছে, ২০ বছর আগের আফগানিস্তান আর আজকের আফগানিস্তান এক নয়। বিশেষ করে মার্কিনিরা দেশটির রাজধানী কাবুলসহ শহরাঞ্চলে নারী অধিকার, সামাজিক উন্নয়ন এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে উদার ভাবধারা নিয়ে এসেছে। তার ওপর আফগানিস্তানে পাকিস্তানের সীমান্তঘেঁষা দক্ষিণাঞ্চলে তালেবানের প্রভাব থাকলেও উত্তরে প্রভাব কম।
আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলের সীমান্ত মধ্য এশিয়ার সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোর সঙ্গে হওয়ায় তারা ধর্মীয় দিক থেকে গোঁড়া নয়। নর্দান অ্যালায়েন্সে উদার ভাবধারা বিদ্যমান। ফলে তালেবানের দেওয়া নতুন নাম ‘ইসলামিক এমিরাটস অব আফগানিস্তান’-এর চেহারা কী হবে, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে আফগানিস্তানের সমাজ ট্রাইবাল নেতা বিশেষ করে পাঠানদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ফলে নয়া তালেবানের অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকারে ইসলামি কাঠামোর পাশাপাশি ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিশেল থাকবে বলে আপাতত মনে হচ্ছে।
বাংলাদেশের জনগণের সম্পর্কে আফগানিস্তানের জনগণের ভালো ধারণা রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সত্ত্বেও বাংলাদেশ আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠায়নি। দুই মুসলিম দেশের মানুষের মধ্যে সম্পর্কটা কৌশলগত স্বার্থ দ্বারা বিবেচনা করা যাবে না। এসব কারণে দুই দেশের জনগণ পরস্পরের বিশ্বস্ত বন্ধু। কিন্তু পারস্পরিক সহযোগিতার মাত্রা খুবই নগণ্য। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বলতে ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড।
গত ১৯ বছরের বেশি সময় ধরে দেশটিতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কমিউনিটির উন্নয়ন, করোনাভাইরাস প্রতিরোধ সংক্রান্ত সহায়তা, মানবিক সহায়তা এবং খাদ্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত সেবা দিয়ে আসছে ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনাল। দেশটির ১০টি প্রভিন্সে প্রায় তিন হাজার ব্র্যাক কর্মী কাজ করেছেন। ব্র্যাকের কার্যক্রম আফগানিস্তানে খুবই প্রশংসিত। তালেবানরা কখনো ব্র্যাক কর্র্মীদের টার্গেট করেননি। কিছু ব্র্যাক কর্মী বিভিন্ন সময়ে অপহরণের শিকার হলেও এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। চাঁদাবাজির অংশ হিসাবে তাদের জিম্মি করা হয়। ব্র্যাক কখনো আফগানিস্তানে টার্গেট ছিল না।
ব্র্যাকের বাইরে আফগানিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা নেই বললেই চলে। বর্তমানে উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে বাংলাদেশ দূতাবাস আফগানিস্তানের বিষয়াদি দেখাশোনা করে। ঢাকায় আফগানিস্তানের দূতাবাস আছে। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবানের শাসনকালে বাংলাদেশে নজিবুল্লাহ সরকারের পাঠানো ‘চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স’ (সিডিএ) ঢাকায় আফগানিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
তৎকালীন তালেবান সরকার নতুন কোনো রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশে প্রেরণ করেনি। বাংলাদেশ সরকার কাবুলে দূতাবাস খোলার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে। কিন্তু নিরাপত্তাজনিত কারণে তা চালু করতে পারছে না বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে বলা হচ্ছে। যদিও কাবুলে পৃথিবীর অনেক দেশেরই দূতাবাস রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে কেউ রাষ্ট্রদূত হয়ে আফগানিস্তানে যেতে রাজি হচ্ছেন না।
তবে বিলম্বে দূতাবাস চালু করলে অনেক সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে বাংলাদেশ। বিশেষ করে আফগানিস্তানে হামিদ কারজাই, আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহ, গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার সমন্বয়ে গঠিত রিকন্সিলেশন কাউন্সিলের মাধ্যমে রাজনৈতিক সংহতি প্রতিষ্ঠিত হলে দেশটির সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মিলতে পারে।
সেক্ষেত্রে, টানা ২০ বছরের যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত আফগানিস্তানের রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অবকাঠামোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুনর্গঠনে বিপুল অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া সামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দক্ষতা বিশ্বে চ্যাম্পিয়ন। ব্র্যাকের কিছু কার্যক্রমের মাধ্যমে সেটা আফগানিস্তানের জনগণও প্রত্যেক্ষ করেছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মানবসম্পদ উন্নয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ প্রভৃতি বিভিন্ন কাজে বাংলাদেশের জন্য সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। আফগানিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক সৃষ্টির সম্ভাবনাও ব্যাপক।
আফগানিস্তানের জনগণ যুদ্ধ ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্য কোনো পথ পায়নি। কৌশলগত স্বার্থে দেশগুলো আফগান জনগণের হাতে নানা জুজুর ভয় দেখিয়ে অস্ত্র তুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ আফগানিস্তানের জনগণের প্রকৃত নিঃস্বার্থ বন্ধু। তাই আমরাই পারি, বন্ধুপ্রতিম জনগণকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ঘটিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে, যার জন্য প্রয়োজন বাণিজ্য জোরদার করা।
আফগানিস্তানে উৎপন্ন আঙুর, বাদামসহ বিভিন্ন ধরনের ফল মাত্র তিন ঘণ্টার কার্গো ফ্লাইটে বাংলাদেশে আমদানি করা সম্ভব। বাংলাদেশ থেকে ওষুধসহ অনেক পণ্য আফগানিস্তানে রপ্তানি করা যায়। এভাবে দেশটির জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটালে তারা যুদ্ধ থেকে সরে স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তন করবেন। এসব কিছু করার জন্য দ্রুততম সময়ে কাবুলে বাংলাদেশের দূতাবাস চালু করা প্রয়োজন। যদিও এই মুহূর্তে এটি চালু করা খুবই চ্যালেঞ্জের; তবে এটাও ঠিক, পৃথিবীর অন্য দেশগুলো দূতাবাস চালু করতে পারলে বাংলাদেশও পারবে। কারণ, বাংলাদেশের জনগণ কিছুতেই আফগান জনগণের টার্গেট নয়, বন্ধু।
বাংলাদেশের সামনে আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো, আফগানিস্তানে তালেবান উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ ঠেকানো। পুলিশ বলেছে, নিষিদ্ধ ঘোষিত হরকাতুল জেহাদসহ উগ্রবাদী কেউ কেউ আফগানিস্তানে হিজরত করেছে, যাদের প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর আছে।
বাংলাদেশ একটি সমতল ভূমির দেশ। এখানে জঙ্গি উত্থান সহজ নয়। ভারত আমাদের চারপাশে থাকায় ইসলামের নামে জঙ্গিবাদকে তারা প্রশ্রয় দেবে না বলে ধারণা করা যায়। তার ওপর বাংলাদেশের জনগণ মধ্যপন্থা পছন্দ করেন। উগ্রবাদ সাধারণ জনগণ পছন্দ করেন না। আফগানিস্তানে বিদেশি আগ্রাসন ঠেকাতে উগ্র সংগঠনগুলোতে সাধারণ জনগণই প্রশ্রয় দিয়েছে, যা বাংলাদেশে মোটেও সম্ভব নয়।
তবুও বাংলাদেশে গোপনে জঙ্গিরা সক্রিয় থাকে। হলি আর্টিজানসহ অতীতের বেশ কিছু বড় বিস্ফোরণের ঘটনা তার প্রমাণ। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক কোনো ঘটনার প্রভাবে এখানে যাতে বিচ্ছিন্ন কিছু না ঘটে, সেদিকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ বিষয়ে সজাগ আছে। তারা এ নিয়ে নিশ্চয়ই কাজ করছে।
আফগানিস্তানে শরণার্থী সংকট সৃষ্টি হওয়া বাংলাদেশের জন্য অপর একটি চ্যালেঞ্জ। আফগান শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রস্তাব বাংলাদেশ যৌক্তিকভাবে নাকচ করেছে। বাংলাদেশ ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে এখন তা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। তবে আফগান শরণার্থী নিয়ে বিশ্বে নতুন আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এবং তাদের ব্যয়ভার বহনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যাতে উদাসীন না হয়ে পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের আসন্ন অধিবেশনে বরাবরের মতোই বিশেষভাবে আলোকপাত করবেন বলে আশা করি।
আফগানিস্তানের বিষয়ে বড় বড় শক্তিগুলো সক্রিয়। ফলে সবাই চাইবে বাংলাদেশ যেন তাদের বলয়ে অংশীদার হয়। কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বৈশিষ্ট্য হলো, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব; কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়। আমরা কোনো বলয়ভুক্ত হই না। ফলে আফগানিস্তানে নিরাপত্তার প্রশ্নে আমাদের দূরে থাকা সমীচীন। আমাদের লক্ষ্য হোক আফগানিস্তানের জনগণের আর্থসামাজিক উন্নয়ন। আমরা চাই, দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা এবং সমন্বিত উন্নয়ন।
মাসুদ করিম : প্রধান প্রতিবেদক, যুগান্তর
Leave a Reply