বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এ দেশে যখন কোভিড ১৯-এর সংক্রমণ শুরু হয় তখন এ বিষয়টিকে অনেকেই হেলাফেলা করেছেন। মানুষের নানাবিধ আচরণ, কোভিড ১৯-এর ভয়াবহতা সম্পর্কে জনসচেতনতার অভাব, জনগোষ্ঠীর বিরাট একটি অংশের স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলা, অপ্রতুল চিকিৎসাব্যবস্থা এবং ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আনাড়িপনা পরিস্থিতিকে জটিল থেকে জটিলতর করে তুলেছে।
ঢাকা শহর থেকে যারা গ্রামের বাড়ি গেছেন, তারা অনেকেই মাস্ক ব্যবহার করছিলেন। গ্রামের লোকজন তাদের মশকরা করে বলেছে, ‘গরুর কাপাইরের মতো এটা কি পরেছিস? তোদের দেখে হাসি পাচ্ছে।’ এ ঘটনা যখন ঘটেছিল তখন গ্রামাঞ্চলে কোভিড ১৯-এর দৃশ্যমান কোনো প্রকোপ ছিল না। শহরেও বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় একই ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে।
ঢাকায় কোভিড সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর খেটে খাওয়া মানুষ বিশেষ করে রিকশাচালক এবং দৈহিক শ্রমের ওপর নির্ভরশীল অনেকেই মাস্ক পরত না। তারা বলত, কোভিড ধনীদের রোগ, গরিবের নয়। যারা কঠোর দৈহিক পরিশ্রম করে তাদের ধারে কাছে কোভিড ঘেঁষতে পারে না। এ জনশ্রুতিকে ভিত্তি করে লোকপ্রিয় এক ধরনের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক তত্ত্ব দাঁড়িয়ে গেল।
অনেকেই বলতে শুরু করল, যারা কঠোর দৈহিক পরিশ্রম করে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আরামপ্রিয় লোকদের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। তাই গরিব মানুষরা আক্রান্ত হয় না। গরিব মানুষরা যে আক্রান্ত হয় না এ চিন্তাটিও ছিল ভ্রান্ত। কারণ গরিব মানুষরা একটি সংখ্যা মাত্র। সংবাদপত্র ও মিডিয়াতে যাদের মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হতো তারা ছিলেন দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তি।
এসব মানুষদের হারিয়ে আমাদের জাতীয় জীবনে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। এখনো বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মৃত্যু অব্যাহত আছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর মোহাম্মদ আলী এবং তার স্ত্রী প্রফেসর ড. খালিদা হানমের মৃত্যু, বাংলা একাডেমির ডিজি শামসুজ্জামান খানের মৃত্যু, অধ্যাপক ভুইয়া ইকবালের মৃত্যু, গায়ক ইন্দ্র মোহন রাজবংশীর মৃত্যু, আমার অত্যন্ত প্রিয়ভাজন গণসংগীত শিল্পী ফকির আলমগীরের মৃত্যুসহ অনেক নামিদামি মানুষের মৃত্যু করোনার ভয়াবহতাকে গা শিউরে ওঠার মতো আতঙ্কে পরিণত করেছে।
এ করোনাকালে এমন কথাও শোনা যায়, করোনার সূচনার পর থেকে অনেকে ঘর থেকে এক দণ্ডের জন্যও বের হননি। তাদের মধ্যে অনেকে করোনার মরণ ছোবল থেকে আত্মরক্ষা করতে পারেননি। এক কথায় বলা যায়, করোনা আমাদের অচিন্তনীয় ত্রাসের মুখোমুখি করে তুলেছে। ত্রাস হবেই না বা কেন? করোনা রোগীকে অতি আপনজনেরাও বেদনাদায়কভাবে সংক্রমণের ভয়ে এড়িয়ে চলেছে। এমন খবরও গণমাধ্যমে বেরিয়েছে যে, করোনাক্রান্ত জন্মদায়িনী মাকে ছেলেপেলেরা জঙ্গলে নিক্ষেপ করে নিরুদ্দেশ হয়েছে। মানবিকতার এমন ধরনের মৃত্যু করোনা অবধারিত করে তুলেছে।
করোনায় যখন মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে শুরু করল, তখন মৃতদের শেষকৃত্য করাটাও অত্যন্ত কঠিন ছিল। মৃতের আপনজনেরা তার মরদেহের ধারেকাছে ঘেঁষতে চাইত না সংক্রমণের ভয়ে। চতুর্দশ শতাব্দীতে ইউরোপে প্লেগ মহামারি যা ‘ব্ল্যাক ডেথ’ নামে পরিচিত, সে সময় অনুরূপ বেদনাবিধুর ঘটনা ঘটেছিল। ’৭৬-এর মন্বন্তরের সময় বঙ্গদেশে শুধু মন্বন্তর নয়, ভয়াবহরূপে ‘গুটিবসন্ত’ দেখা দিয়েছিল। এখন পৃথিবী থেকে গুটিবসন্তের অবসান ঘটেছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায় তার ‘আনন্দ মঠ’ উপন্যাসে ’৭৬-এর মন্বন্তরের করুণ চিত্র এঁকেছেন। ‘আনন্দ মঠ’ উপন্যাসটি সম্পর্কে প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ আছে।
কিন্তু বঙ্কিম বাবু যেভাবে মন্বন্তর ও গুটিবসন্ত মহামারির ছবি এঁকেছেন, তা দেখে হৃদয়ে চরম বেদনাবোধ জাগ্রত হয়ে ওঠে। বঙ্কিম বাবু যা লিখেছেন আমি তা নিজের ভাষাতেই প্রকাশ করতে চাই। তার বর্ণনা থেকে জানা যায়, গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে সৌম্য কান্তি পুরুষ এবং সুন্দরী রমণী নিজ গৃহে পচে-গলে মরেছে। তাদের লাশ সৎকারের জন্য কাউকে পাওয়া যায়নি। লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুতে বঙ্গভূমি বিরাণ প্রান্তরে পরিণত হয়েছিল। নবাবের নায়েব নাজিম রেজা খাঁ শেষ কপর্দক পর্যন্ত খাজনার নামে আদায় করে বাংলার কৃষকদের সর্বস্বান্ত করে ফেলেছিল। অন্যদিকে অনাবৃষ্টির ফলে খেত-খামারে নতুন ফসলও ফলানো সম্ভব হয়নি। মন্বন্তর বা দুর্ভিক্ষ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।
প্রজাকুলের ওপর এ অত্যাচার ও শোষণ করা হয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে তুষ্ট করার জন্য। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষুধা ছিল উদগ্র। একবিংশ শতাব্দীর এই দিনে ’৭৬-এর মন্বন্তরের মতো ব্যাপক হারে ট্র্যাজিক ঘটনা না ঘটলেও কী করে ভুলে যাই প্রফেসর আনিসুজ্জামানকে, কী করুণভাবে আজিমপুর গোরস্তানে শেষ শয্যা নিতে হয়েছিল! তার দাফন-কাফনের সঙ্গে জড়িত ছিল লাশ দাফনকারী একটি সংস্থা।
এ করোনাকালে আল মারকাজুল ইসলামী, আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম এবং আরও দু-একটি সংগঠন মৃতের শেষকৃত্যে অত্যন্ত প্রশংসনীয় ভূমিকা সাহসের সঙ্গে পালন করে যাচ্ছে। তারা যুগপৎ মানবিক ও ইসলামি দায়িত্ব পালন করে চলেছে। তাদের কাছে জাতির ঋণ অশেষ। করোনায় মৃত্যু না হয়ে স্বাভাবিক সময়ে যদি প্রফেসর আনিসুজ্জামানের মৃত্যু হতো, তাহলে তার ভক্তরা শহিদ মিনার ও বাংলা একাডেমিতে তার লাশ ফুলে ফুলে ছেয়ে দিত। শুধু তাই নয়, তার জানাজায় রাষ্ট্রপতিসহ বহু বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত থাকতেন। করোনা এমনই ভয়ের ব্যাপার ছিল যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে তার জানাজা হলো না, যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অনেক অবদান রেখেছেন।
করোনা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় কী? এখন পর্যন্ত আমরা যা বুঝতে পারছি, এ থেকে শতকরা ১০০ ভাগ নিরাপদ থাকার কোনো উপায় নেই। করোনা থেকে আত্মরক্ষার অন্যতম উপায় হলো কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। এগুলোর মধ্যে রয়েছে মাস্ক পরা, একে অপরের কাছ থেকে নিরাপদ দৈহিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং নিয়মিত সাবান দিয়ে ২০ সেকেন্ডব্যাপী হাত ধোয়া।
এ ছাড়া বিশেষজ্ঞরা গণসমাগম না করতে এবং গণসমাগম এড়িয়ে চলতে উপদেশ দেন। অনেক দুঃখজনক দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে থাকা সত্ত্বেও এখনো মনে হচ্ছে আমরা যেন বুঝেও বুঝতে চাইছি না। ভ্যাকসিন বা টিকা গ্রহণ সংক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার অন্যতম প্রধান উপায়। নতুন মহামারির বিরুদ্ধে টিকা আবিষ্কার সময়সাপেক্ষ। পৃথিবীর অনেক সংক্রামক ব্যাধির জন্য টিকা আবিষ্কারে ৫-৬ বছর সময় লেগেছে। যেহেতু করোনা পেন্ডেমিক আকারে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে সে কারণে বাজারে টিকা আনতে তুলনামূলকভাবে অনেক কম সময় ব্যয় করা হয়েছে।
আমরা যেসব টিকার কথা জানি, তার মধ্যে রয়েছে অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার বায়োএনটেক, মডার্না, জনসন, সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাক। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগ মানুষকে টিকা দিতে পারলে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করা সম্ভব। তবে যেহেতু কোভিড বিশ্বব্যাপী পেন্ডেমিকে পরিণত হয়েছে সে জন্য বিশ্বের সব দেশকে হার্ড ইমিউনিটির আওতায় আনতে হবে।
কোনো দেশ যদি স্বার্থপরের মতো মনে করে তারা তাদের দেশের সব মানুষকে টিকা দিয়ে অভীষ্টে পৌঁছে গেছে, তাহলে তারা বড় ভুল করবে। যুক্তরাজ্য সে দেশের বৃহৎ সংখ্যক মানুষকে টিকার আওতায় আনার পর লকডাউনসহ নানাবিধ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। কিন্তু দেখা গেল, যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন। তার নৈকট্যে আসার জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে সঙ্গনিরোধ গ্রহণ করতে হয়েছে। সোজা কথায় করোনা রোগটি খুবই আনপ্রেডিক্টেবল (Unpredictable).
বাংলাদেশে কোভিডের টিকা দান শুরু হয় এ বছরের ২৭ জানুয়ারি। গণহারে টিকাদান শুরু হয় এ বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি। ২৪ জুলাই পর্যন্ত বৃহত্তর সিলেট, ময়মনসিংহ ও বৃহত্তর বরিশাল বিভাগে ৪ শতাংশেরও কম টিকা দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম, রংপুর এবং দিনাজপুর বিভাগে ৪-৫ শতাংশ ব্যক্তিকে টিকা দেওয়া হয়েছে। খুলনা বিভাগে ৫-৬ শতাংশ ব্যক্তিকে টিকা দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা বিভাগে ৬ শতাংশেরও বেশি ব্যক্তিকে টিকা দেওয়া হয়েছে। তবে এসব তথ্য এটা বোঝায় না যে, এ মানুষগুলো টিকার দুটি ডোজ পেয়েছেন। এ তথ্যের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিরা অন্তত ১টি ডোজ টিকা পেয়েছেন। টিকাদান কর্মসূচির জন্য ১৪ হাজার কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গণটিকাদান কর্মসূচি আরও অনেক বেগবান হতো, যদি ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে অগ্রিম অর্থের বিনিময়ে প্রতিশ্রুত টিকা বাংলাদেশে রপ্তানি করা হতো।
কিন্তু ভারত সরকার ভারতে ভয়াবহ ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের বিস্তার দেখে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। ভারতে লাখ লাখ লোকের মৃত্যু ঘটেছে। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট খুব দ্রুত সংক্রমণ ঘটায় এবং আক্রান্ত ব্যক্তিকে বোঝার সময় দেয় না যে সে আক্রান্ত হয়েছে। ভারতে মৃত্যুর বিভীষিকা এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল যে, মৃতদেহের সৎকারের জন্য শ্মশানে জায়গা ও দাহের জন্য লাকড়ি-খড়িও পাওয়া যাচ্ছিল না।
মুসলমানদের গোরস্তানের চিত্রও ছিল প্রায় একই ধরনের। বহু মৃতদেহ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার কিছু অংশ বাংলাদেশের পদ্মাতেও দেখা গেছে। এ সংক্রমণ ঘটার আগে হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকার কুম্ভ মেলায় বিশাল জমায়েত অনুষ্ঠিত হতে দিয়েছে। অতি উৎসাহী হিন্দুত্ববাদীরা গো-মূত্র পান এবং গায়ে গোবর মাখাকে করোনা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় হিসাবে প্রচার করেছে।
বিজ্ঞানের এ যুগে মানুষ এত কুসংস্কারাপূর্ণ হতে পারে ভাবা যায় না। হিন্দুত্ববাদ ভারতের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে কমপক্ষে কয়েক দশক পিছিয়ে দিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে ভারত একটি গুরুত্বহীন দেশে পরিণত হবে। বিশ্বমঞ্চে তার তেমন কোনো প্রভাব থাকবে না। আমাদের দেশে যেসব রাজনৈতিক দল ভারতের আশীর্বাদে ক্ষমতায় যাওয়ার খোয়াব দেখছে, ইতিহাস তাদেরও ছুড়ে ফেলবে।
বিশ্ববিখ্যাত ভারতীয় রেডিক্যাল বুদ্ধিজীবী অরুন্ধতী রায় গার্ডিয়ান পত্রিকায় এক নিবন্ধে দাবি করেছেন, ভারতে প্রকৃত মৃতের সংখ্যা সরকার ঘোষিত সংখ্যার ৩০ গুণ হবে। তিনি বিভিন্ন শ্মশান ও গোরস্তানের অবস্থা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। পরিস্থিতি আসলে যে কত ভয়াবহ তা অরুন্ধতী রায়ের বক্তব্য থেকে আঁচ করা যায়।
বাংলাদেশেও ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের ঢেউ আছড়ে পড়েছে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এত বিশাল যে, মানুষের আসা-যাওয়ার মধ্য দিয়ে করোনার সবচেয়ে ভয়াবহ ভ্যারিয়েন্টটি বাংলাদেশে যে মারাত্মক বিপদ ঘটাতে পারে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশে অতি সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত ১,১৮,৪৯,০৯৭ ব্যক্তি টিকার জন্য নিবন্ধিত হয়েছেন। তার মধ্যে ৭৩,৪৮,৯৯৭ অর্থাৎ ৬২.০২ শতাংশ ব্যক্তি অন্তত ১ ডোজ ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না, অথবা অ্যাস্ট্রাজেনেকা অথবা সিনোফার্মের টিকা পেয়েছেন। ৪,৩০২,৭৭১ অর্থাৎ ৫৮.৫৫ শতাংশ যারা প্রথম ডোজ পেয়েছেন, তারা পুরোপুরি টিকা পেয়েছেন।
ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের ভূমিকায় হতাশ হয়ে বাংলাদেশ রাশিয়ান স্পুটনিক-ভি (Sputnik-V) এবং চীনা BBIBP-COR.V টিকাগুলোর জরুরি ব্যবহারের জন্য এপ্রিলের শেষ দিকে টিকার অপ্রতুল সরবরাহের কারণে জরুরি অনুমোদন দেয়। বাংলাদেশ জরুরি ব্যবহারের জন্য ফাইজার বায়োএনটেক কোভিড-১৯ টিকা কো-ভ্যাক্সের অংশ হিসাবে বিতরণের অনুমোদন দেয়।
২৬ জুলাই ২০২১-এ নতুন সংক্রমণ ছিল ১৫,২৯২, ১৯ জুলাই ২০২১-এ নতুন সংক্রমণের ঘটনা ছিল ১৩,৩২১ এবং পূর্ববর্তী ৭ দিনের গড় হলো ১১,৭৬৫। কত লোক সংক্রমিত তা নির্ভর করে টেস্টের সংখ্যার ওপর। অতি সাম্প্রতিক সময়ে আক্রান্তের হার ৩০ শতাংশেরও ঊর্ধ্বে চলে গেছে, যা অত্যন্ত বিপজ্জনক।
করোনা সংক্রমণ রোধ করার জন্য বিভিন্ন সময়ে নিষেধাজ্ঞা, কঠোর নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি জারি করা হয়েছে। একটি নিষেধাজ্ঞাও যদি
নিশ্ছিদ্রভাবে ৩ সপ্তাহের জন্য কার্যকর করা সম্ভব হতো, তাহলে বারবার নিষেধাজ্ঞা জারির প্রয়োজনীয়তাই থাকত না। মানুষেরও হয়রানি কম হতো এবং সত্যিকার অর্থে সুফল পাওয়া যেত।
ঈদুল আজহার পর থেকে জনগণের মধ্যে টিকা নেওয়ার উৎসাহ বেড়েছে। টিকা কেন্দ্রগুলোতে দীর্ঘ লাইন সৃষ্টি হচ্ছে। সে কারণেই সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড ভিত্তিতে টিকা দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। সংক্রমণ গ্রামে ছড়িয়ে পড়ার ফলে মানুষ এখন টিকার গুরুত্ব উপলব্ধি করছে। এটা শুভ লক্ষণ। তবে জনগোষ্ঠীর মধ্যকার সব রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারলে অনেক বেশি সুফল পাওয়া সম্ভব হতো।
বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে বিবেচনায় নিয়ে টিকা সংগ্রহের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। যেটুকু সংগ্রহ হয়েছে, তা সামগ্রিক প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য। মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা সঙ্গিন হয়ে পড়ছে। বেকারত্ব এবং আয়ের উৎস অনেকাংশে সঙ্কুচিত হওয়ার ফলে দেশে অতিরিক্ত দুই থেকে আড়াই কোটি লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার ফলে শিক্ষার প্রচণ্ড ক্ষতি হচ্ছে। এ ক্ষতির ফলে মানবসম্পদের সংকট জাতিকে দীর্ঘকাল সমস্যাভারাক্রান্ত করবে। এমনিতেই বাংলাদেশের শিক্ষার মান খুবই হতাশাব্যঞ্জক। আগামী দিনে আরও বেশি করে হতাশার মুখোমুখি হতে হবে।
কোভিড-১৯ শিশু, বালক, কিশোর, যুবক ও পরিণত বয়স্ক মানুষসহ সবাইকে মানসিকভাবে রুগ্ণ করে ফেলছে। কারণ সামাজিক মেলামেশার সুযোগ নেই বললেই চলে। প্রায় সব দেশের জনগোষ্ঠী এক ধরনের Morbid, Frustrated, Aimless I Insect like existence-এর দিকে পরিচালিত হবে। সামনে কেমন সমাজ আসছে? এ সমাজ মানবিকতাবোধহীন এক ধরনের নৈরাজ্যপূর্ণ সমাজে পরিণত হবে।
আমি শঙ্কিত এ কারণে যে, পাশ্চাত্যে বলা হচ্ছে কোভিড ১৯-এর সংক্রমণ নানা রূপে ২০২৪ সাল অবধি অব্যাহত থাকবে। তাহলে ভাবুন, পৃথিবীটা কেমন হবে! বিল গেট্স জনান্তিকে হাজার হাজার কোটি ডলার টিকা বিক্রি করা আয় থেকে কী করবেন? তার বিরুদ্ধে পাশ্চাত্য দেশে অভিযোগ উঠেছে তিনি নাকি কোভিড-১৯ এর নাটের গুরু। এটার নাম পুঁজিবাদ। হয়তো পুঁজিবাদের ভস্ম থেকে নতুন ধরনের কোনো সমাজের জন্ম হবে। আমাদের ভাবনার পাখাগুলোকে বিস্তার করে ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে হবে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ
Leave a Reply