১. ১০ জুন অপহরণের শিকার ইসলামী বক্তা আবু আদনান শুক্রবার (১৮.০৬.২১) ফিরে এসেছেন। অথবা শুক্রবার তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। উনি কোথায় ছিলেন, কীভাবে ছিলেন, কেন ছিলেন? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর আপাতত অন্ধকারে। এর আগে যারা ফিরে এসেছেন তারা আর কখনো মুখ খোলেননি। আবু আদনানও হয়তো এ বিষয়ে আর কথা বলবেন না। আবার কথা বলতেও পারেন। তবে নিকট অতীতে গুম থেকে ফিরে আসা মানুষদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে অপহরণ বিষয়ে তার কথা না বলার সম্ভাবনাই বেশি। আমরা তা দেখার অপেক্ষায় থাকলাম।
৩. কিন্তু বাংলাদেশে গুম হয়ে যাওয়া সবার ভাগ্য কি আবু আদনানের মতো? অবশ্যই না। হারিয়ে যাওয়া সিংহভাগ মানুষের ভাগ্য আবু আদনানের মতো নয়। সাবিকুন্নাহারের মতো সবাই সৌভাগ্যবতী নন। সবার স্বামীরা ঘরে ফিরে আসে না। সব মা-বাবারা তাদের সন্তানকে ফিরে পান না। সব সন্তানেরা তাদের বাবাকে ফিরে পায় না। কেউ কেউ লাশ ফিরে পায়। কারো কারো কপালে লাশ দেখারও সুযোগ হয় না। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানিও এক সময় শুকিয়ে যায়। তারপর মানুষ ভুলে যেতে থাকে। কারো কারো মনে থাকেনা যে বাসা থেকে, রাস্তা থেকে, গাড়ি থেকে, বাজার থেকে, অফিস থেকে কাউকে কাউকে ধরে নেয়া হয়েছিল যারা আর কখনো ফিরে আসেনি। ওরা কিন্তু মানুষ ছিল। একই দেশের নাগরিক ছিল!
৪. মনে আছে গত ১৩ বছরে গুমের শিকার হওয়া ৬০৪ জন মনুষ্য সন্তানের কথা? এ সংখ্যার ভেতরে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১১ জন মানব সন্তানও আছেন। এ মানুষগুলো ব-দ্বীপের বিভিন্ন এলাকায় জন্মগ্রহণ করলেও বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কেউ কেউ সরকারকে বড় অঙ্কের ট্যাক্স দিচ্ছিলেন, মানুষের কর্মসংস্থান করছিলেন। বিভিন্ন নামে উনাদের আলাদা পরিচিতি থাকলেও একটি পরিচয় অনেকটা প্রকট। এবং সে পরিচয়টি হচ্ছে বর্তমান সরকারের সাথে তাদের আদর্শিক বা রাজনৈতিক একটা মতপার্থক্য ছিল। ৬০৪ জন গুমের শিকার হওয়া এ মানব সন্তানদের ৭৮ জন পরিবারকে নিজেদের লাশ উপহার দিয়ে জাতিকে বলে গেছেন যে আমরাও মানুষ ছিলাম, আমাদের বেঁচে থাকার অধিকার ছিল। কিন্তু আপনাদের নীরবতা আমাদের বাঁচতে দেয়নি। গুমের শিকার হওয়া ৫৭ জন অলৌকিকভাবে বা বিশেষ ব্যবস্থায় ফিরে এসেছেন। ফিরে আসার পর কেউই আর মুখ খোলেননি। সৌভাগ্যবান কেউ কেউ দেশান্তরিত হয়েছেন। এরপরেও তারা স্তব্ধ হয়ে আছেন। কেউ কথা বলছেন না। অথবা তাদেরকে বলা হয়েছে যে, তারা যেন কথা না বলেন। ৮৯ জনকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তার দেখিয়েছে। বাকি লোকগুলো কোথায়? উনারা কি বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন? নিজেকে নিজে প্রশ্ন করি। কারণ অন্যকে এ প্রশ্ন করলে উত্তর পাবো না। অতীতে পাওয়া যায়নি। এখনো পাওয়া যাবে না।
৫. যেমনটা উত্তর পাওয়া যায়নি গুম হয়ে যাওয়া ব্যারিস্টার আহমেদ বিন কাসেমের (আরমান) উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন করে। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আরমানকে মিরপুর ডিওএইচএসের নিজ বাসা থেকে সাদা পোশাকধারী কিছু লোক ( যারা নিজেদেরকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বলে পরিচয় দিচ্ছিল) ০৯ আগস্ট ২০১৬ সালের রাতের বেলা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায়। তাকে প্রস্তুত হবার জন্য মাত্র পাঁচ মিনিট সময় দেয়া হয়েছিল। কোন ওয়ারেন্ট ছিল না। কোন অভিযোগ ছিল না। তরুণ এ ব্যারিস্টারকে রাতের আঁধারে বাসা থেকে যখন ধরে নেয়া হয় তখন চিৎকার করে তার দুই মেয়ে আয়েশা তাকওয়া (চার বছর) এবং মারিয়াম বুশরা (আড়াই বছর) আব্বু আব্বু বলে পেছন থেকে ডাকছিল। ব্যারিস্টার আরমানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার অসহায়ের মতো তার স্বামীর চলে যাওয়া দেখছিলেন। উনিও কাঁদছিলেন। তবে আশা ছিল যে, যেহেতু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ধরে নিয়ে যাচ্ছে নিশ্চয়ই তাকে ছেড়ে দেবে। তাহমিনা আক্তার এবং তার দুই সন্তানের চোখের পানি মুছিয়ে দেয়ার জন্য রাষ্ট্র কি এগিয়ে এসেছিল?
৬. ব্যারিস্টার আরমানের স্ত্রী তানিয়া আক্তারের সে আশা পূরণ হয়নি। তিনি তার স্বামীকে ফিরে পাননি। আয়েশা এবং মারিয়াম তাদের বাবাকে ফিরে পায়নি। বরাবরের মত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যারিস্টার আরমানকে গ্রেপ্তারের খবর অস্বীকার করেছে।
৭. তবে তাদেরকে ধরে নিয়ে গেল কারা?
৮. ইসলামী বক্তা আবু আদনান ফিরে আসলেন নাকি কেউ ফিরিয়ে দিয়ে গেল তা হয়তো কখনোই জানা যাবে না। তবে তিনি জীবিত ফিরে এসেছেন, পরিবারের জন্য এটি সবচেয়ে বড় পাওয়া। শুধু তিনি ফিরে আসেননি, তার তিন সঙ্গীও ফিরে এসেছেন। রংপুরের পুলিশ বলছে, ব্যক্তিগত কারণে তারা সকলেই একসঙ্গে গত ৮ দিন থেকে আদনানের এক বন্ধুর বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন। অবিশ্বাস্য এ কাহিনীর রহস্য ভেদ করার জন্য স্বয়ং শার্লক হোমসকে আবার কবর থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে।
৯. আবু আদনান এবং তার সফরসঙ্গীদের ফিরে আসাকে অথবা ফিরিয়ে দেয়াকে অভিনন্দন জানাই।
হারিয়ে যাওয়া এ চারজনের পরিবারের সদস্যদের কান্না এবং অসহায়ত্ব হয়তো কিছুটা এখন কমেছে। কিন্তু বাকিদের কী হবে?
১০. গুগল ম্যাপ দিয়ে ঢাকার সূত্রাপুরের সেলিম রেজা পিন্টু, ধানমন্ডি থেকে হারিয়ে যাওয়া কানাডার ম্যাগগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইশরাক আহমেদ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মীর আহমেদ বিন কাসেম আরমান, সাবেক সাংসদ ইলিয়াস আলী, সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলমদের অবস্থানটি নির্ণয় করা যায় না?
১১. পৃথিবীর কিছু ভাষা সার্বজনীন। স্থান, কাল, পাত্র ভেদে এর কোন পরিবর্তন হয়না। চোখের পানির একই ভাষা। বাবা ফিরে আসবে সেই আশায় সন্তানদের পথ চেয়ে বসে থাকা, প্রিয় সন্তান ফিরে আসবে সে জন্য মা-বাবার অন্তরের হাহাকার, প্রিয় স্বামী ফিরে এসে দরজায় কড়া নাড়বে সেই আশায় প্রিয়তমার চোখ মোছা, একই রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ প্রিয় ভাই ফিরে আসবে সেই আশায় আশাহত বোনের অসীমের পানে চেয়ে থাকা- সবই একই ভাষা, একই অভিব্যক্তি।
১২. সেই সার্বজনীন ভাষাকে বুঝার ক্ষমতাও আমরা হারিয়ে ফেলেছি? আমরা মানুষ তো?
১৩. ব্যারিস্টার আরমানের ছোট দুই মেয়ের বয়স এখন নয় (আয়েশা) এবং সাড়ে সাত বছর (মারিয়াম)। ওরা একসময় বড় হবে এবং রাষ্ট্রকে কঠিন একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেবে। আমার বাবাকে গুম করলো কারা? কেন তাকে গুম করা হলো? দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব যাদের হাতে তারা সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন তো?
—
ডা: আলী জাহান
সাবেক পুলিশ সার্জন, যুক্তরাজ্য পুলিশ।
Leave a Reply