দেশে মিঠা পানির প্রাকৃতিক জলাশয়ে আফ্রিকান জেব্রা সিক্লিড মাছ (জেব্রা তেলাপিয়া) পাওয়া গেছে। আগ্রাসী ও সর্বভুক প্রকৃতির এই মাছটি ছড়িয়ে পড়লে দেশীয় জলজ জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির কারণ হতে পারে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বলে মন্তব্য করেছেন দেশীয় রেকর্ডে প্রাকৃতিক জলাশয়ে নতুন এই বহিরাগত মিঠা পানির মাছটি শনাক্ত করা চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ড. মোহাম্মদ আরশাদ-উল-আলম।
ড. আরশাদ নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর জেব্রা তেলাপিয়া আক্রমণাত্মক আচরণের জন্য পরিচিত। ছোট অবস্থায় তারা তেমন আক্রমণাত্মক নয়, তবে পরিণত হওয়ার সাথে সাথে তাদের আক্রমণাত্মক আচরণ বৃদ্ধি পায়। আগ্রাসী ও সর্বভুক প্রকৃতির এই মাছটি পরিবেশে ছড়িয়ে পড়লে দেশীয় জলজ জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির কারণ হতে পারে।
মাছটির প্রাকৃতিক আবাস পশ্চিম আফ্রিকার গিনি-বিসাউ (গেবা ও করুবল নদী) থেকে পশ্চিম লাইবেরিয়া (সেন্ট জন নদী) পর্যন্ত। বহিরাগত প্রজাতি হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ফ্লোরিডা, হংকং ও থাইল্যান্ডে এর উপস্থিতি রয়েছে।
তিনি জানান, এই মাছটির বৈজ্ঞানিক নাম হেটারোতিলাপিয়া বুট্টিকোফেরি (ঐবঃবৎড়ঃরষধঢ়রধ নঁঃঃরশড়ভবৎর)। পার্চিফর্মিস বর্গভুক্ত সিক্লিডি পরিবারের এই নবীন বয়সী মাছটির দেহ আয়তাকার ও পার্শ্বীয়ভাবে বেশ চাপা, গায়ে আটটি কালচে খাড়া ব্যান্ড আছে। প্রথম ব্যান্ডটি চোখ বরাবর মাথার ওপর থেকে নিচের দিকে নেমে গেছে। শেষ দু’টি ব্যান্ড লেজের গোড়ায় অবস্থিত। গাঢ় ব্যান্ডগুলো অন্তর্বর্তী অংশের চেয়ে প্রশস্ত এবং পৃষ্ঠপাখনায় ও পায়ুপাখনায় বিস্তৃত। পুচ্ছপাখনায় একটি সরু অর্ধচন্দ্রাকার ব্যান্ড আছে। পুচ্ছপাখনার প্রান্ত সমান। বক্ষপাখনা বর্ণহীন। সিক্লিড পরিবারের বৈশিষ্ট্যসূচক চরিত্র একজোড়া নাসাছিদ্র দেখা যায়। পৃষ্ঠপাখনা সংযুক্ত। মুখ কিছুটা সঙ্কোচন-প্রসারণক্ষম। চোখ তুলনামূলক বড়।
বিভিন্ন প্রকাশনার রেকর্ডে জানা যায়, কালো ডোরাগুলো তরুণ বয়সে সুস্পষ্ট থাকে, বয়স বাড়ার সাথে ডোরাগুলো ফিকে হয়ে আসে। সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ৪০ সেমি পর্যন্ত রেকর্ড রয়েছে। অনেক অ্যাকুয়ারিস্ট এই মাছগুলো রাখতে পছন্দ করেন, কারণ এগুলো খুব বুদ্ধিমান ও আকর্ষণীয় আচরণ করে। বর্ণবিন্যাস একই হওয়ায় এবং অন্য কোনো দৃশ্যমান পার্থক্য না থাকায় স্পনিংয়ের সময় ছাড়া স্ত্রী ও পুরুষ আলাদাভাবে চেনা যায় না। এরা সর্বভুক, খাবারের পছন্দ বেশ বিস্তৃত।
ড. আরশাদ বলেন, মাছটি চট্টগ্রামের বিভিন্ন অ্যাকুয়ারিয়াম ফিসের দোকানে পাওয়া যায়। অ্যাকুয়ারিয়াম ফিস সেন্টারগুলোয় এই মাছটি বাটার ফিস (মাছ) নামে পরিচিত। অ্যাকুয়ারিয়াম ফিস সেন্টারগুলোর অ্যাকুয়ারিয়ামে এই মাছগুলোকে উজ্জ্বল ও নাদুসনুদুস দেখা যায়। মাছটি পরিবেশে ছড়িয়ে না পড়ার জন্য আকুয়ারিস্টদের সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।
ড. আরশাদ জানান, চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজে বিজ্ঞানমেলায় প্রদর্শনের জন্য ‘অ্যাকুয়ারিয়াম ফিস হিসেবে দেশীয় মাছ প্রচলন’, ‘জীববৈচিত্র্য অনুসন্ধান প্রকল্প’ ও ‘সামুদ্রিক মৎস্যবৈচিত্র্য অনুসন্ধান ও স্পিসিস প্রোফাইল তৈরি’ প্রকল্পগুলোর প্রস্তুতি ও নমুনা সংগ্রহ চলছিল। বিভাগের প্রথম বর্ষ সম্মান শ্রেণীর শিক্ষার্থী শতরুপা সুশীল, মোহাম্মদ রিয়াদ হোসেন ও নাজমুল হোসেন শুভর অ্যাকোয়ারিয়াম ফিস হিসেবে দেশীয় মাছ প্রচলন প্রকল্পের নমুনা সংগ্রহ অভিযানে চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা এলাকায় এই বিদেশী অ্যাকুয়ারিয়াম মাছটির সন্ধান পাওয়া যায়।
সরকারি সিটি কলেজ প্রাণিবিদ্যা বিভাগের মিউজিয়ামে মাছটি সংরক্ষিত আছে এবং কলেজের বিজ্ঞানমেলায় তা প্রদর্শন করার কথা জানান তিনি।
উল্লেখ্য, ড. আরশাদ এর আগে দেশীয় রেকর্ডে একাধিক মাছ যুক্ত করেন, এর মধ্যে শিংওয়ালা কার্প (ঝপযরংসধঃড়ৎুহপযড়ং হঁশঃধ) উল্লেখযোগ্য। পার্বত্য সাঙ্গু নদীর রেমাক্রি অঞ্চল থেকে ড. আরশাদ বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এই কার্প মাছটি অন্য দু’টি সমগণভুক্ত প্রজাতিসহ সংগ্রহ করেন। ঝপযরংসধঃড়ৎুহপযড়ং হঁশঃধ ভারতের ওয়েস্টার্ন ঘাট বায়োডাইভার্সিটি হটস্পট ও কৃষ্ণা নদীর উচ্চভূমির এন্ডেমিক প্রজাতি হিসেবে বিবেচিত।
Leave a Reply