রবীন্দ্রনাথের একটা গান আছে- ‘পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায়/ ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।’ এরই বিপরীত আর ডি বর্মণের একটি গানের কলি- ‘কি হবে আর পুরোনো দিনের কথা আজ তুলে/ কিছু ভুলেছ তুমি, আমিও গেছি ভুলে।’ দুটোই ঠিক। স্মৃতির আঙ্গিনায় যা জ্বলজ্বল করে ঘুরপাক খাচ্ছে তারই খানিক এখানে তুলে ধরছি। কারণ সে দিন আজ অনেক বদলে গেছে। সে সময়ের অনেকেরই জীবনে যারা গ্রামে থাকতেন, এ অভিজ্ঞতা কম বেশি আছে। কারণ আমাদের দেশটার প্রায় সবটাই এক রকম। সময়টা ১৯৫০-এর দশক। জন্মের পর থেকে গ্রামে ছিলাম প্রায় ছয় বছর। এর পর স্কুল ছুটির সময়ে ঢাকা থেকে প্রায়ই গ্রামে যেতাম। সে বয়সে অন্যান্য বিনোদনের সাথে মাছ ধরা ছিল এর একটি। সেকালে পুকুর খাল বিল নদী নালা ডোবায় প্রচুর মাছ ছিল। কত মাছ ছিল সেটি আজকের গ্রামীণ প্রজন্মকে বিশ্বাস করানো কঠিন হবে। আমরা নানাভাবে মাছ শিকার করেছি। বড়শিতে, টেঁটাতে, ওচায়, পলোতে, হাতিয়ে ইত্যাদি বিভিন্নভাবে ছেলে থেকে শুরু করে বয়স্করাও। মাছ ধরা হতো পুকুর ডোবা সেচ করেও। আজ টের পাই এ নিরিবিলি বার্ধক্যে এসে সেকালটা কেমন ছিল। যারা কোনো সময়ই গ্রামে ছিলেন না তাদের কাছে মাছ ধরার এ কাহিনী রূপকথার মতো মনে হতে পারে।
আমাদের গ্রামের বাড়ির দীঘির পুব পাড় ঘেঁষে ডোবা আর খাল। ডোবা কচুরিপানা ও ঝরা ঘাসে ঠাসা। এসব ঘাস ও কচুরি পানার নিচে প্রচুর শিং মাছ। গ্রীষ্মকালে ডোবার পানিতে নেমে কচুরিপানা আর ঘাস সরিয়ে গোল করে একটু জায়গা সাফ করতাম। এটি ডোং। ডোংয়ের ভেতর পানির নিচের শেওলা ময়লা ভালো করে ছাফ করা হতো যেন বড়শির সুতা কোনো কিছুতে আটকে না যায়। ডোবার ডোংয়ের ভেতর বড়শিতে ছোট চিংড়ির পোনা গেঁথে পড়ন্ত বিকেলে বড়শি ফেলে শিং মাছ ধরেছি। সরু বেত ভাঁজ করে খোলা অংশ ছোট্ট এক টুকরো দু’মুখ খোলা বাঁশের সরু নলে ঢুকিয়ে দিয়ে বেতের ভাঁজ করা গোল অংশ হাতের তালু দিয়ে আস্তে নলের ভেতর দিকে চাপ দিলে নলের অপর প্রান্তে বেতের খোলা অংশ বেরিয়ে যায়। বেরিয়ে পড়া বেতের খোলা অংশ ধরে রেখে নলের অপর প্রান্তের গোল অংশে হাতের আঙুল ঢুকিয়ে সুবিধামতো সাইজ দেয়া যায়। বেতের এই গোল অংশটি ফাঁদ। শিকারিরা কী চতুর!
বড়শিতে লাগা শিং মাছ তুলে আস্তে করে ফাঁদে লেজ ঢুকিয়ে নিচের দিকে তার শরীর নামিয়ে দিয়েছি। পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে বেতের খোলা মাথা শক্ত করে মাটিতে চেপে ধরে বাম হাতে বাঁশের নল শিংয়ের পেট বরাবর ঠেসে চেপে ধরেছি শিং যাতে মাথা নেড়ে হাতে কাঁটা ফোটাতে না পারে। শিংয়ের দু’পাশে ছড়ানো কাঁটা দু’টি নলের উপর আটকে থাকত। নল আর বেতের ফাঁদে শিংয়ের মাথা স্থির হয়ে যেত। লেজের দিকটা কেবল মাটির উপর আছড়াত। আস্তে করে ফাঁদে আটকা শিংয়ের মুখ থেকে বড়শি খুলেছি। নল আর বেতের ফাঁদে আটকে পড়া শিং আস্তে করে মাছ রাখার পাত্রে ঢুকিয়ে বেতের এক মাথা ধরে টান দিয়ে নল থেকে বেত খুলে ফেলেছি। ফাঁদমুক্ত শিং পাত্রের ভেতর পড়েই এক ঝাটকা মারে। পাত্রে পানি রাখা থাকত শিং যেন ‘জিয়ল’ থাকে। শিংয়ের ঝাটকা পাত্রের পানির ছিটেফোঁটা বেরিয়ে গায়ে মুখে লাগত। অল্পক্ষণের মধ্যেই শিং পাত্রে স্থির হয়ে যেত। পাত্রের পানিতে শিং ভাসতে থাকে। মাঝে মাঝে নজর দিতাম। দেখতাম। কী সুন্দর!
খাল আর ডোবার পুবে বিস্তৃত ফসলের মাঠ। মাঠের পরে গ্রাম। এই গ্রামকে দ্বিখণ্ডিত করে পুবদিকে ত্রিপুরা থেকে আসা গোমতী নদী দক্ষিণে চলে গিয়ে আমাদের সেকালের থানা সদর দাউদকান্দির কাছে মেঘনায় মিশেছে। যে সময়ের কথা বলছি, তখন আমাদের অঞ্চল ব্রিটিশ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্গত। গোমতী নদীর উৎস বর্তমান ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরও বেশ কিছুকাল পূর্ব পাকিস্তানে ত্রিপুরার অংশ ‘ত্রিপুরা’ নামেই পরিচিত ছিল। পরে পূর্ব পাকিস্তানের ত্রিপুরার অংশ ‘কুমিল্লা জেলা’ হয়। যা হোক, আজ আর সেই পানি নেই। অবশ্য গোমতী নদীতে পাকিস্তান আমলেও তেমন পানি থাকত না। ছোটবেলায় বর্তমান তিতাস উপজেলার আমাদের গ্রাম রতনপুরের পুব বরাবর অংশ শুকনা মৌসুমে নদীটি ওড়া-কোদাল নিয়ে শ্রমিকদের খনন করতে দেখেছি। এ নদীর অন্যান্য অংশেও তাই হতো সম্ভবত। বর্ষা মৌসুমে ভাটিতে গ্রামের লোকদের এ নদীতে পলো দিয়ে মাছ ধরতে দেখেছি; বড়শি দিয়ে অনেকে বাইম মাছও ধরত। আমিও বড়শি দিয়ে বাইম মাছ ধরার চেষ্টা করেছি কিন্তু পাইনি।
বর্ষাকালে পাট কাটা শেষ হলে জমি পড়ে থাকত। বর্ষার পানিতে এসব জমিতে নানা প্রকার শেওলা জমত।
শাপলা-শালুক হতো। নৌকা নিয়ে সেখানে মাছ ধরতে যেতাম। কিছুটা জায়গা ছাফ করে বড়শি দিয়ে এর মধ্যে ফলি মাছ ও কই মাছ ধরা যেত। নৌকা নিয়ে বড়শি দিয়ে ফলি ও কই মাছ ধরতে গেছি। ফলি মাছ আমার ভাগ্যে জোটেনি। তবে একবার একটা কই মাছ বড়শিতে পেয়েছিলাম। সে আনন্দ এক করুণ কাহিনীতে রূপ নিলো। কই মাছ পেয়ে দারুণ খুশি। নৌকার মাচার তলায় অল্প পানি ছিল। খেয়াল করিনি। কই মাছ বড়শি থেকে খুলে নৌকার ভেতর ফেলেছি। এক দিক দিয়ে কই মাছ নৌকায় ফেলেছি, আরেক দিক দিয়ে ঝট করে নৌকার পানিতে ঝাটকা মেরে লাফিয়ে নৌকার বাইরে পানিতে পড়ে গেল। কই মাছ, জানতাম, কানকোয় হেঁটে চলে। লাফাতেও জানে তা জানা ছিল না। জানলাম। জীবনে এই একটি কই মাছই নিজে ধরেছিলাম। রাখতে পারিনি। পরবর্তী জীবনেও দেখেছি, সুযোগ একবারই এসেছে। বারবার আসেনি। তাই বলি, কই মাছ জীবনে একবারই পাওয়া যায়। পারলে রাখো; নইলে লাফিয়ে চলে যাবে। একলা জলায় শোল মাছের লাল রঙের পোনা ঝাঁক বেঁধে ভেসে বেড়াত। মা শোলটি থাকত পেছনে লুকিয়ে। শিকারিরা সুতায় বোনা জাল দিয়ে এ পোনা ধরার চেষ্টা করত। কখনো সফল হতো, কখনো হতো না।
আমাদের বাড়ির পুবে একটি দীঘি। অগ্রহায়ণ পৌষ মাসে দীঘির মাছ জেলেদের কাছে বিক্রি করে দেয়া হতো। দীঘিতে মাছ পড়ত নানা প্রকার। ছোটর মধ্যে পুঁটি পাবদা খলসে মেনি কই শিং মাগুর নলা প্রভৃতি। বড়র মধ্যে শোল বোয়াল রুই কাতল চিতল আড়। চান্দা মাছ দীঘির কিনারে লাফালাফি করত। মনে আছে, ফ্রক পাজামা পরা আমার বালিকা বয়সের ছোট খালা একই থানার ভিন গাঁ মনাইকান্দির নানাবাড়ি থেকে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসে দীঘির উত্তর কিনারে এসব চান্দা মাছের লাফালাফি দেখে পানির কাছে আনন্দে লাফালাফি করেছেন। সে এক আনন্দের দিন ছিল। আজ তা নেই। এসব মাছ প্রথমে বেড় জাল দিয়ে জেলেরা ধরত। যে মাছ লাফাতে জানে যেমন নলা বোয়াল ইত্যাদি বেড় জাল দীঘির দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর পাড়ের কাছাকাছি এলে লাফিয়ে জাল ডিঙ্গিয়ে দক্ষিণের পানিতে পড়ে যেত। জালে মাছ ধরা শেষ হলে এর পর দীঘির পানি সেচে গর্তের ভেতরে লুকিয়ে থাকা শিং মাগুর শানকি দিয়ে জেলেরা বের করে এনে তা খালুইয়ে ভরত। জেলেদেরকে চেনার উপায় থাকত না। সারা শরীর কর্দমাক্ত। মুখ অবধি। সেচা দীঘির উপরে সোনালি ছাদ। উড়ন্ত চিলের মেলে দেয়া সোনালি ডানার ছাদ। এত চিল ওড়ে। দীঘির পাড়ে দর্শক আমরা ছোটরা বড়রা। কে নয়? সবাই সেচা দীঘির কাদায় জেলেদের মাছ ধরা দেখছে। গ্রাম যেন দীঘির পাড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। জেলেদের মাছ ধরা শেষ হলে মনে হতো, এক আনন্দের মেলা শেষ হয়ে গেল। কিছু মাছ আমাদের বাড়ির লোকেরা জেলেদের কাছ থেকে কিনে রাখত। যে দীঘিতে ছয় ঋতুতেই পানি আর মাছ থাকত, সে দীঘি এখনো আছে। তবে তাতে না আছে পানি আর না আছে মাছ। শীতের সকালে নৌকা নিয়ে বেরিয়ে গেছি সমবয়সী এক খুদে জ্ঞাতি ভাইয়ের সাথে দীঘির উত্তরের জলায় টেঁটা দিয়ে মাছ ধরতে।
সকালের রোদ তেতে ওঠার আগে বিলের পানিতে ঝাঁকে ঝাঁকে পুঁটি মাছ ভেসে বেড়াত। একজন পেছনের গলুইয়ে বসে নৌকা চালাতাম, আরেকজন পালাক্রমে সমুখের গলুইয়ে বসে সেই ভেসে বেড়ানো পুঁটির ঝাঁকে টেঁটা ছুড়ে মারতাম। এভাবে বেশ কিছু মাছ ধরতে ধরতে সকালের রোদ যখন উঠে যেত পুঁটির ঝাঁকগুলো পানির নিচে তলিয়ে যেত আর আমরা মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। এমনটা হয়তো বাংলাদেশের অনেকখানেই ছিল। আজ সে জলায় বর্ষায়ও পানি নেই, মাছ তো দূরের কথা। এখন আছে খামারের বিস্বাদ মাছ। ভরবর্ষার ধানক্ষেতে দিনের বেলায় যখন বাতাস থাকত না তখন কোচ দিয়ে বড় মাছ শিকারিরা ক্ষেতের ভেতর নৌকা নিয়ে চুপচাপ অপেক্ষায় থাকত, ধানক্ষেতের কোন অংশের ধানের পাতা নড়ে। যে অংশের ধানের পাতা নড়ে উঠত সেখানে বড় মাছের অস্তিত্ব আছে অনুমান করে শিকারি কোচ ছুড়ে মারত। এভাবে রুই বোয়াল কাতল প্রভৃতি মাছ তারা শিকার করত। বর্ষার সেই ধানক্ষেত কি এখন আর আছে? আমাদের গ্রামের কোড়া শিকারি আনু তাঁতি তার পোষা কোড়াটি নিয়ে বর্ষার ধানক্ষেতে চলে যেত কোড়া শিকার করতে। সে দিন আর নেই।
আমাদের বাড়ির মসজিদের দক্ষিণটা বর্ষাকালে জলায় পরিণত হতো। সেখানে প্রচুর শেওলা ও বিভিন্ন ধরনের জলজ উদ্ভিদ জন্মাত। বর্ষার পানিতে যখন টান ধরত, মাছ শিকারিরা পুবে-পশ্চিমে এক সারিতে ২০-২৫টি ওচা উত্তর দিকে মুখ করে পাতত। এরপর কাঁচা পাটের ছাল দিয়ে মজবুত করে দড়ি বানিয়ে মাছ শিকারিরা তা উত্তর দিক থেকে হুররে হুররে ডাক তুলে পায়ে শেওলা ও জলজ উদ্ভিদ আন্দোলিত করে মাছগুলোকে তাড়া করে ওচার দিকে নিয়ে যেত। এর পর দড়িটি ছেড়ে দিয়ে ওচার সামনে হুররে হুররে করে পা আন্দোলিত করতে করতে তড়িঘড়ি করে ওচাগুলো সামনের বাঁট ধরে তুলে ফেলত। এ মাছের মধ্যে পুঁটি, চান্দা, খলসে, বইচা জাতীয় মাছ ধরা পড়ত। এ পর্ব বেশ কয়েকবার চলত। সেখানে বাড়ি ঘর উঠে গেছে। আজকের শিশু যারা সেকালের আমাদের বয়সী, তাদের কাছে এ এক রূপকথা ছাড়া আর কী? মাছ ধরেছি খালে বাঁশের শলার বাঁধ দিয়ে। এই বাঁধের পেছনে নৌকা পেতেছি। স্রোতের সাথে ভেসে আসা মাছ শলায় ধাক্কা খেয়ে লাফিয়ে নৌকায় পড়েছে। এ মাছও পুঁটি। রুপালি পুঁটি। যে শিশু এসব পুঁটি ধরেছে তাদের হাসি মুখের কচি সফেদ দাঁতের মতোই সফেদ। ভরবর্ষায় নৌকা নিয়ে ধানক্ষেতের ভেতর চলে গেছি। ধানের পাতা থেকে মাকড়শার কচি বাচ্চা নিয়ে তা দিয়ে বাড়ির পাশের জলায় বড়শি দিয়ে দাড়িকানা ও কাটারি মাছ ধরেছি। এ কাহিনী বড় দীর্ঘ। এখন সে ‘রামও নেই আর সে অযোধ্যাও নেই’। ফারাক্কা বাঁধ অগস্ত্য মুনির মতো সব পানি শুষে নিয়েছে। আছে পাশের দেশের দুয়ারে পানির জন্য নিষ্ফল ধরনা আর তোষামোদ করা।
লেখক : অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর ও ভাইস প্রিন্সিপাল, মহিলা সরকারি
কলেজ, কুমিল্লা।
Leave a Reply