‘খেলা হবে’। ভোটমুখী ওপার বাংলায় এবার এই দুটি শব্দই মাঠ মাতিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে বাংলাদেশের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের এই বুলি পশ্চিমবঙ্গবাসী প্রথম শুনেছিল বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত ম-লের মুখে। তারপরই তৃণমূল নেতা দেবাংশু ভট্টাচার্য এ নিয়ে একটি গান লেখেন, যা রাতারাতি ভাইরাল হয়ে যায়। তারপর থেকেই ভোটের মাঠ মাতিয়ে রেখেছিল ‘খেলা হবে’ সেøাগান। তৃণমূল নেত্রী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো অবশ্যই, সেইসঙ্গে তার দলের নেতারাও প্রচারে গিয়ে প্রতিপক্ষের দিকে মুহুর্মুহ বাণ ছুড়েছেনÑ খেলা হবে, ভয়ঙ্কর
খেলা হবে। এক সমাবেশে মমতা বলেছিলেন, ‘আসুন খেলা হবে, আমি থাকব গোলরক্ষক। দেখতে চাই কটা গোল তারা (বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস) মারতে পারে।’ জবাবে খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ বিজেপি নেতারা ‘দিদির খেলা শেষ’ সেøাগান নিয়ে পাল্টা বাণ ছুড়তে ভোলেননি। কিন্তু গত ২৭ মার্চ থেকে শুরু হওয়া আট দফার এই বিধানসভা নির্বাচনে সত্যিই মারাত্মক খেলা হলো। তাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা পা নিয়েও বিজেপিকে ল্যাঙ মেরে একতরফাভাবে জিতে শেষ হাসি হেসেছেন শুধুই মমতা। এর মধ্য দিয়ে ভেস্তে গেল পশ্চিমবঙ্গ দখলে নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি সভাপতি অমিত শাহর সব প্রয়াস। ফলে পশ্চিমবঙ্গে টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে চলেছে তৃণমূল।
অবশ্য হারের মধ্যেও বিজেপির একমাত্র সান্ত¡না পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম। প্রথমে তুমুল আলোচিত এই আসনে মমতা জিতছেন বলে আভাস ছিল। কিন্তু নানা নাটকীয়তা শেষে দেখা যায় মমতার প্রতিদ্বন্দ্বী ও তার একসময়ের শিষ্য বিজেপির শুভেন্দু অধিকারীই সেখানে জিতেছেন। দীর্ঘ টানাপড়েনের মধ্যে প্রথমে এই আসনে ভোট পুনর্গণনার কথা বলা হলেও রাতে নির্বাচন কমিশন শুভেন্দুকেই বিজয়ী ঘোষণা করে। রিটার্নিং অফিসারের তথ্য অনুযায়ী, নন্দীগ্রামে ১ লাখ ৯ হাজার ৬৭৩ ভোট পেয়েছেন শুভেন্দু। অন্যদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পেয়েছেন ১ লাখ ৭ হাজার ৯৩৭ ভোট। তবে হারের পর মমতা বলেছেন, তিনি নন্দীগ্রামের ফল নিয়ে চিন্তিত নন বরং বাংলার জয় ভারতকে বাঁচাল।
নিজে হারলেও দলের বিপুল এই জয়ের গোটা কৃতিত্বই মমতাকে দিয়েছেন ভারতের রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে বিশ্লেষকরা। আক্ষরিক অর্থেই গোলপোস্ট আঁকড়ে রেখে তিনি একাই সামলেছেন সব ঝড়-ঝাপ্টা। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ টুইট করে মমতাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। নরেন্দ্র মোদি টুইটে বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে জয়ের জন্য আপনাকে অভিনন্দন মমতা দিদি। মানুষের স্বপ্নপূরণে এবং কোভিড মহামারী মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে সব রকমের সহায়তা করবে।’ এ ছাড়া দেশটির প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের সভাপতি সোনিয়া গান্ধী ফোন করে অভিনন্দন জানান মমতাকে। দলটির আরেক শীর্ষ নেতা রাহুল গান্ধীও টুইট করে অভিনন্দন জানিয়েছেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং টুইটে লেখেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তার দলের বিপুল জয়ের জন্য অভিনন্দন। তার পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনের জন্য আমার শুভেচ্ছা।’ কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন এক টুইটে লিখেছেন, ‘আরও একবার বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করার জন্য মমতা দিদি এবং তৃণমূলকে শুভেচ্ছা। আপনাকে আপনার সরকারের পরবর্তী মেয়াদের জন্য শুভকামনা জানাই।’ প্রখ্যাত কংগ্রেস নেতা ও সাংসদ শশী থারুর এক টুইটে বলেন, ‘সাম্প্রদায়িকতা এবং অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই অসাধারণ জয়ের জন্য তাকে অভিনন্দন। বাংলা এবং বিশেষ করে নন্দীগ্রামের ভোটাররা বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাদের মনের যোগাযোগ কার সঙ্গে। বাংলায় হেরে বিজেপি বুঝেছে কাদের সঙ্গে লড়তে এসেছিল।’ বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব টুইটে লিখেছেন, ‘মমতাজিকে এই ঐতিহাসিক জয়ের জন্য আন্তরিক শুভেচ্ছা। সব রকম প্রতিবন্ধকতাকে পার করে এই জয়। আমি পশ্চিমবঙ্গের জনগণকেও অভিনন্দন জানাতে চাই। যারা বিজেপির অপপ্রচারের ফাঁদে না পড়ে দিদির ওপর আস্থা রেখেছেন।’ শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহও। মমতাকে জয়ের অভিনন্দন জানিয়ে তিনি লিখেছেন, বিজেপি ও নির্বাচন কমিশনের শত চেষ্টাতেও আপনি অটুট ছিলেন।
আট দফার নির্বাচন শেষে গতকাল রবিবার এই নির্বাচনের ফল ঘোষণা করা হয়। এ নিয়ে সকাল থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ছিল তুমুল উত্তেজনা। যদিও বিভিন্ন বুথফেরত জরিপে মমতারই জয়ের আভাস ছিল। কিন্তু তার পরও ভোটের গণনায় হিসাব পাল্টে যেতে পারে বলে আশায় ছিল বিজেপি। ভোট গণনার শুরুতে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাসও ছিল। কিন্তু বেলা যত গড়িয়েছে ততই স্পষ্ট হয়েছে তৃণমূলের জয়ের চিত্র। পশ্চিমবঙ্গের শীর্ষ বাংলা পত্রিকা আনন্দবাজারের খবর বলছে, গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত রাজ্যে ভোট হওয়া মোট ২৯২ আসনের মধ্যে তৃণমূল ২১৪টিতে এবং বিজেপি জিতেছে মাত্র ৭৬টি আসনে। রাজ্যের এক সময়কার প্রভাবশালী দল সিপিএম জিতেছে মাত্র একটি আসনে। কংগ্রেসসহ অন্যান্য দল জিতেছে ২টি আসনে। প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে ২টি আসনে ভোট হয়নি।
দুর্দান্ত প্রতাপের এই জয়ের পর ভোটার ও সমর্থকদের অভিনন্দন জানিয়ে কোভিডবিধি মেনে এখনই বিজয় মিছিল করতে মানা করেছেন মমতা। তৃণমূলের জয়ের খবর ছড়িয়ে পড়তেই দল বেঁধে তারা ভিড় করেছিলেন কলকাতার কালীঘাটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির সামনে। সেখানে কোভিডবিধি উপেক্ষা করেই চলেছে সবুজ আবির মাখামাখি ও মিষ্টি বিতরণ। বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, চব্বিশ পরগনাসহ রাজ্যের অন্য জেলাগুলোতেও তৃণমূল কর্মীদের বিজয় উদযাপনের খবর পাওয়া গেছে। সন্ধ্যায় নিজের বাড়িতে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে মমতা বলেন, ‘এই নির্বাচনে দুটি সেøাগান খুব কাজে লেগেছে, আমার ছোট ছোট ভাইবোনেরা দিয়েছেন খেলা হবে আর জয় বাংলা। সত্যিই খেলা হয়েছে এবং খেলা শেষে আমরা জিতেছি। এ জন্য আমি তাদের অভিন্দন জানাব এবং আমি নিজে ৫০ হাজার ফুটবল গ্রাম-বাংলার বুকে আমাদের দলের পক্ষ থেকে গরিব ক্লাবগুলোকে দেব।’ মমতার ভাই কার্তিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘আমরা সবাইকে বলবÑ দ্রুত যেন বাড়ি চলে যাওয়া হয়। তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হয়ে মানুষের আবেগকে আটকে রাখা শক্ত। আমরা সেটা চেষ্টা করছি। এই উচ্ছ্বাস বাইরে থেকে নেতাদের নিয়ে এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানোর বিপরীত উচ্ছ্বাস।’ কিন্তু তৃণমূল সমর্থকদের বিজয় উদযাপন ভালোভাবে নেননি কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম। তিনি বলেছেন, ‘জিতলেও এই জয় আবেগের নয়। এই জয় হবে দায়িত্বের। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই চিত্র দেখা যাচ্ছে না।’
এদিকে হারের পর মুষড়ে পড়েছে রাজ্যের বিজেপি নেতা-সমর্থকরা। কলকাতায় এখন খাঁ খাঁ করছে বিজেপির মিডিয়া সেন্টার। ভোটের আগে রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ দাবি করেছিলেন, তার দল অন্তত ২০০টির কাছাকাছি আসন পাবে। কিন্তু ফল ঘোষণার পর উল্টো চিত্র দেখে হতবাক তিনিও। তবে হার মেনে নিয়েই এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছেন, ‘আমরা মাত্র ৩ আসনে জিতেছিলাম ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে। সে জায়গায় ৫ বছরে যেখানে পৌঁছেছি তা কম নয়। এটা ঠিক, যে লক্ষ্য আমরা নিয়েছিলাম তার তুলনায় আমাদের সাংগঠনিক ক্ষমতা কম।’
তবে দিলীপ ঘোষ ও রাজ্য বিজেপিকে এই হারের জন্য এত সহজে ছাড় দিচ্ছে না দলের কেন্দ্রীয় কমান্ড। চূড়ান্ত অপমানের এই হারের কারণ নিয়ে দলের মধ্যে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। কারণ পশ্চিমবঙ্গকে আয়ত্তে আনতে যা যা করার প্রয়োজন, তার সবই করেছিল বিজেপি। চরম কোভিড পরিস্থিতি ও সমালোচনার মধ্যেও খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বারবার রাজ্যে এসে সভা-সমাবেশ করেছেন। তার পরও এই হার তাই পোড়াচ্ছে বিজেপিকে। ইতোমধ্যে রাজ্য বিজেপির কাছে হারের কারণ ব্যাখ্যা করতে বলেছেন দলের সভাপতি অমিত শাহ। রাজ্য বিজেপির কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাশ বিজয়বর্গীয় বলেছেন, ‘ভোটের পূর্ণাঙ্গ ফল পাওয়ার পর বিজেপি নেতৃত্ব তা নিয়ে পর্যালোচনা করবে। বাংলার মানুষ হয়তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চান, এটা আমাদের বিশ্লেষণ করতে হবে।’
অন্যদিকে পরিস্থিতির জন্য কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দিকে আঙুল তোলা শুরু করে দিয়েছেন রাজ্য বিজেপি নেতাদের একাংশ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহদের দিকে নাম করে আঙুল না তুললেও তাদের ইঙ্গিত স্পষ্ট। আনন্দবাজার পত্রিকাকে রাজ্যের এক শীর্ষ নেতা বলেছেন, জেলায় জেলায় অন্য রাজ্য থেকে আসা পর্যবেক্ষকরা স্থানীয় নেতৃত্বের প্রতি অবিশ্বাস দেখিয়েছেন। এখানকার রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা না থাকলেও নিজেদের রাজ্যের অভিজ্ঞতা বাংলায় প্রয়োগ করতে চেয়েছেন। বারবার বলেও কাজ হয়নি। যে ফল হতে চলেছে তাতে এটা স্পষ্ট যে, সেটা ঠিক হয়নি। সেনাপতি হয়েছিলেন যারা জিতলে তারা কৃতিত্ব নিতেন। এখন হারের দায়ও নিতে হবে।
Leave a Reply