মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা নিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী। করোনা মহামারী ও মিয়ানমারের অনীহায় প্রায় এক বছরের মতো বন্ধ থাকা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা সম্প্রতি পুনরায় শুরু হয়েছে। সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আবার ঝুলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। অবশ্য বাংলাদেশ আশা করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখবে মিয়ানমার।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, দেশের স্বার্থেই নেপিদোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো উচিত ঢাকার। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গেই সামরিক কূটনৈতিক তৎপরতা চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন তারা। প্রায় এক বছর পর ১৯ জানুয়ারি চীনের উদ্যোগে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করে বাংলাদেশ। বৈঠক শেষে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, আমরা চলতি বছরের প্রথম
প্রান্তিকে প্রত্যাবাসন শুরুর প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু ব্যবস্থাপনার জন্য আরও কিছুটা সময় লাগবে বলে জানিয়েছে মিয়ানমার। তাই আমরা দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রত্যাবাসনের কথা বলেছি। তারা এতে সম্মত হয়েছে। চলতি ফেব্রুয়ারি মাসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে গঠিত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক হওয়ার সিদ্ধান্তও হয়। কিন্তু মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের চলতি মাসের মিটিং হবে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়বে কিনা এমন প্রশ্নে সাবেক রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক হুমায়ুন কবীর বলেন, আমি মনে করি এটি দুর্ভাগ্যজনক। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকে সরে যাওয়া কখনো প্রত্যাশিত নয়। প্রতিবেশী হিসেবে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের থাকতে হবে এটাই বাস্তবতা। যে সরকারই থাকুক তাদের সঙ্গে কাজ করার জন্য বাংলাদেশের প্রস্তুত থাকা উচিত।
সেনা অভ্যুত্থান রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার ওপর প্রভাব সম্পর্কে সাবেক এ রাষ্ট্রদূত বলেন, মিয়ানমারের এ মুহূর্তে অগ্রাধিকার রোহিঙ্গা ইস্যু নয়। অগ্রাধিকার হলো তারা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সামলানো। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এসব দেশ ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে সামলানো। সে বিবেচনায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে ব্যস্ত থাকবে। সুতরাং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুর গুরুত্ব এখন কিছুটা কমবে। আমি মনে করি, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার আলোচনা সাময়িক অনিশ্চয়তায় পড়ল এটা বলা যায়। তবে এতদিন যে আলোচনা হয়েছে তার পুরোটা যে নষ্ট হয়ে যাবে বিষয়টি তেমন নয়। আমাদের চুক্তি মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে। আগামী এক বছর সেনা সরকার থাকবে বলছে। সুতরাং আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলব। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন, আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। কিছুদিন যাক। তারা কী করতে চায় দেখা যাক। তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহাব এনাম খান এ বিষয়ে বলেন, মিয়ানমারের যে সরকারই আসুক না কেন রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া উচিত। কারণ অতীতে প্রত্যাবাসনের পুরো বিষয়টি সেনাবাহিনীকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। দেশটির পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেনাবাহিনীর দখলে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে অং সান সু চি সেনাবাহিনীর বাইরে গিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেননি। সুতরাং পুরো বিষয়টি আগেও সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভরশীল ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। বর্তমানে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুটি জিনিসের ওপর জোর দিতে হবে। এক নম্বর হলো সামরিক কূটনীতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। এ বিষয়ে অতীতে আমরা জোর দিইনি। দ্বিতীয়টি হলো চীনের সম্পৃক্ততা বাড়ানো। ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় চীনের আরও সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের সুবিধা হলো মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এমনিতেই এক ধরনের প্রেসার তৈরি করবে। তবে এটাও মনে রাখা উচিত মিয়ানমারের সামরিক জান্তারাও জানে সেনা অভ্যুত্থান হওয়ায় তাদের ওপর বিভিন্ন বিধিনিষেধ আসবে। এসব হিসাব-নিকাশ করেই তারা এমন পদক্ষেপ নিয়েছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে এক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এখন রোহিঙ্গা ইস্যু নির্ভর করছে চীনের ওপর। মিটিংগুলো হয়তো এ মুহূর্তে হবে না। কিন্তু সব কিছু নির্ভর করছে চীন ও মিয়ানমারের সদিচ্ছার ওপর।
২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর গত সাড়ে তিন বছরেও একজন রোহিঙ্গাকেও রাখাইনে ফেরত পাঠানো যায়নি। ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত পাঠাতে মিয়ানমারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করে বাংলাদেশ। দুই দফা তারিখ ঠিক করেও রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরানো যায়নি। প্রথম দফায় ২০১৮ সালের নভেম্বরে এবং দ্বিতীয় দফায় ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট এ উদ্যোগ ভেস্তে যায়। করোনার কারণে প্রায় এক বছর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা বন্ধ থাকার পর গত ১৯ জানুয়ারি চীনের উদ্যোগে সর্বশেষ ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়।
Leave a Reply