নাম তার মো. আশরাফুল ইসলাম দিপু। মাত্র ২১ বছর বয়সেই অভিনব সব প্রতারণার মাধ্যমে কোটিপতি বনে গেছেন তিনি। মাত্র ১৪ বছর বয়সে ভোলায় ত্রাণের টাকা আত্মসাতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দিপুর প্রতারণা। এরপর ইউটিউব দেখে তিনি আয়ত্ত করেন প্রতারণার আরও কৌশল। কখনো নিজেকে পরিচয় দিতেন গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক, কখনো দুদকের উপ-পরিচালক আবার কখনো পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। বর্তমানে তার রয়েছে একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি, চড়েন নামিদামি ব্র্যান্ডের গাড়িতে। সকালের নাস্তা করতেন পাঁচতারকা হোটেলে। স্কুলের গ-ি না পেরুলেও তিনি নিজেকে দাবি করতেন স্নাতক পাস হিসেবে।
জানা গেছে, যখন যে পরিচয় প্রয়োজন হতো তাতেই আবির্ভূত হতেন দিপু। এর মধ্যে নোমান গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান, কখনো বা মার্কিন নাগরিক পরিচয় দিয়ে প্রতারণার জাল বিছিয়েছিলেন তিনি। এসব করেই রাষ্ট্রীয় সব দপ্তরের নামে ভুয়া প্রজ্ঞাপন বানিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। স্কুলে নিয়োগ, এনএসআইতে চাকরি দেওয়া, করোনাকালে মানুষকে সহযোগিতায় ‘মানবিক টিম’ নামে ফেসবুক পেজ খুলেও প্রবাসীদের পাঠানো লাখ লাখ টাকা আত্মসাত করতেন। অর্থাৎ বিভিন্ন প্রলোভনে যাকে যেভাবে বশে আনা সম্ভব সেটাই করতেন দিপু। সাধারণ মানুষতো বটেই, তার প্রতারণার হাত থেকে রেহাই পাননি সরকারি কর্মকর্তারাও।
পুলিশ জানায়, প্রতারণার জন্য দিপু ব্যবহার করতেন ফেসবুক। যেখানে নিজের ভুয়া পরিচয় দিয়ে নিয়মিতই আসতেন লাইভে। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক পরিচয়ে চাকরি দেওয়ার নামে কয়েকজনের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। দিপুর বিরুদ্ধে গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর ভাটারা থানায় মামলা করেন লেকশো অটো লিমিটেডের গাড়িচালক মীর সুজেল। ওই অভিযোগের ভিত্তিতেই গত শনিবার সকালে রাজধানীর পল্লবী থেকে দিপুকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। এ সময় তার কাছ থেকে প্রতারণায় ব্যবহৃত মোবাইল ফোন, সিমকার্ড, চাকরি হয়েছে সংবলিত সরকারি গেজেটের প্রিন্টেড কপিসহ অন্যান্য আলামত জব্দ করা হয়। পরবর্তীতে দিপুকে জিজ্ঞাসাবাদে উঠে আসে তার প্রতারণার নানা কাহিনি। আদালতের নির্দেশে বর্তমানে ৩ দিনের রিমান্ডে রয়েছেন দিপু।
ডিবির ওয়েব বেজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের ইনচার্জ এডিসি আশরাফ উল্লাহ জানান, দিপু বড় ধরনের প্রতারক। যাতায়াতের জন্য ভাড়া করা গাড়ির চালকের স্ত্রীকে সরকারি চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ৩০ থেকে ৬০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। এছাড়াও ওই চালকের গাড়ি ভাড়া করে ৩০ হাজার টাকা ভাড়া মেরে দেন। পরে প্রতারণার বিষয়টি টের পেয়ে ওই চালক ভাটারা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন। ওই মামলার তদন্তে নেমে দিপুকে গ্রেপ্তার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে দিপু একাধিক প্রতারণায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। তার দুটি বিলাসবহুল বাড়ির তথ্য পাওয়া গেছে। দিপুর বাবার নাম আব্দুল জলিল ফরাজী ওরফে মতু। গ্রামের বাড়ি ভোলার দক্ষিণ আইচা থানার উত্তর চর কলমি এলাকায়। দিপুর মতো প্রতারকদের বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন এডিসি আশরাফ।
জানা গেছে, দিপুর প্রতারণার ফাঁদে পড়ে পুলিশের ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানানো দেখে যে কেউই মনে করতেন তিনি প্রশাসনের কোনো বড় কর্মকর্তা। ভোলা, কিশোরগঞ্জ, সিলেটে সরকারি প্রটোকলে এভাবেই সফর করেছেন তিনি। এমনকি সৌদি সরকারের ডাকে হজও করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নামে ভুয়া প্রজ্ঞাপন ছেপে তিনি নিজেকে তুলে ধরেছেন মেজর জেনারেল পদমর্যাদার গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে, যার পদায়ন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। এভাবেই সরকারি সফরের নির্দেশনা পাঠিয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে প্রতারণা করতেন সরকারি লোকজনের সঙ্গে। কেউ-কেউ আবার তার মাধ্যমে নিয়োগ চান প্রশাসনে। তখন ভুয়া প্রজ্ঞাপন বানিয়ে হাতিয়ে নিতেন লাখ লাখ টাকা। কেবল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই নয়, পুলিশ সদর দপ্তর এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নামেও নকল প্রজ্ঞাপন বানিয়ে চালাতেন প্রতারণা। এমন একজন ব্যক্তি কিভাবে সরকারি দপ্তরকে বোকা বানালো তা গুরুত্ব সহকারে তদন্তের পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, প্রতারণার অংশ হিসেবে পোশাক তৈরি প্রতিষ্ঠান নোমান গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পাওয়ার খবর জানাতে সম্প্রতি রাজধানীর একটি পাঁচতারকা হোটেলে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন দিপু। ফেসবুক লাইভে জানান, গুলশান ওয়েল ফেয়ার ক্লাবে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। নোমান গ্রুপের হেড অব প্রটোকল মাজহারুল ইসলাম চৌধুরী জানান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিওটি ভাইরাল হলে তা তাদের নজরে আসে। দিপু নামে ওই প্রতারকের বিরুদ্ধে থানায় জিডি করেছেন তারা। এছাড়া গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার বিভাগেও অভিযোগ জানিয়েছে নোমান গ্রুপ।
Leave a Reply