ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরের সঙ্গে উপজেলা নবীনগরের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ নেই। এ অবস্থায় সড়কপথে যোগাযোগে ২০ কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মাণ করছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর। কিন্তু প্রকল্প মেয়াদের শেষ দিকে এসে জানা যায়, ত্রুটিপূর্ণ ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয়েছে প্রকল্পে। এ জন্য কাজ করা যাচ্ছে না। তাই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ মামলা এবং প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্ত করতে বলা হয়। শুধু তা-ই নয়, দায়িত্বে অবহেলায় সওজের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের কাছে ব্যাখ্যা তলব করতে নির্দেশ দিয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, ‘নবীনগর-আশুগঞ্জ সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প’টির ডিপিপি সংশোধনের জন্য প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয় মন্ত্রণালয়ে। সেখানে ধরা পড়ে এই জেলাসড়ক নির্মাণকাজের ত্রুটিপূর্ণ দশা। সড়কটি নির্মাণে যে পরিমাণ জমি ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। প্রশস্তকরণ মাপজোখও ভুল। তা ছাড়া সড়কের ডিজাইনে ত্রুটির পাশাপাশি প্রস্তাবিত কালভার্ট, সেতু, ড্রেন নির্মাণের বিবরণ কোনো কিছুই সঠিক নেই। ত্রুটি ধরা পড়ে সড়ক রক্ষাপ্রদ বাঁধ নির্মাণেও। এ ছাড়া পরিসেবা সংযোগ স্থানান্তর ও নির্মাণকালীন রক্ষণাবেক্ষণ টাকার সংস্থানও ভুল।
সাম্প্রতিক প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটির (পিএসসি) সভায় এত ভুল দেখে সংশ্লিষ্ট পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘সয়েল অ্যান্ড ফাউন্ডেশন ইঞ্জিনিয়ার্স কনসালটিং ফার্ম’-এর বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ মামলার নির্দেশ দিয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। সওজের প্রধান প্রকৌশলীকে লেখা এ সংক্রান্ত চিঠিতে মন্ত্রণালয় উল্লেখ করেছে, প্রয়োজনে ওই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে। পরামর্শক প্রতিবেদনটি ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে প্রকল্প প্রণয়নের ক্ষেত্রে দায়িত্বে অবহেলার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের কাছে ব্যাখ্যা তলবের কথাও বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অবহেলার প্রমাণ পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে মন্ত্রণালয়কে জানাতেও বলেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। এই প্রকল্পের অভিযুক্ত পরামর্শকের বিরুদ্ধে সওজ কী ব্যবস্থা নিয়েছে তাও জানাতে বলা হয়েছে। এর পর উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশোধনের প্রস্তাব নিয়ে পরবর্তী পিএসসি সভা আহ্বান করা হবে। গত সভায় প্রকল্পের সংশোধনসহ মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানোর কথা বলা হয়। ত্রুটিপূর্ণ ডিজাইনের কারণে প্রকল্পের মেয়াদ শুধু বাড়ছে না, আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রাষ্ট্র। সরকারি অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন এ প্রকল্পটিতে আরও ২৭৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা খরচ বাড়াতে প্রস্তাব করে সওজ।
এ বিষয়ে সওজের কুমিল্লা জোনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রানা প্রিয় বড়–য়া বলেন, প্রকল্পটির সংশোধন করতে হবে। ভূমির পরিমাণ বাড়বে। তা ছাড়া মেয়াদও বাড়াতে হচ্ছে। এটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক বিভাগের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
ত্রুটিপূর্ণ সমীক্ষায় মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রকল্পটি গ্রহণকালে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কেন যথাযথভাবে পরিমাণ বলতে পারেনি তা নিয়ে মন্ত্রণালয় নির্দেশনা দিয়েছে। তা ছাড়া ডিপিপি প্রণয়নকালে যেসব প্রকৌশলী ছিলেন, তারা বিষয়টি খেয়াল করেননি কেন তা জানতে চাওয়া হয়েছে।
সূত্রমতে, বর্তমানে নবীনগর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যেতে হয় নৌপথে। তাই ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সঙ্গে নবীনগর হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সংযোগ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে নবীনগর উপজেলা থেকে রাজধানী বা অন্য কোনো শহরে যেতে কুমিল্লার কোম্পানীগঞ্জ, মুরাদনগর উপজেলা হয়ে ৫৬ কিলোমিটার ঘুরে বা বাঞ্ছারামপুরের আঁকাবাঁকা ৫৪ কিলোমিটার জেলা সড়ক হয়ে নারায়ণগঞ্জের ভুলতা পথে যেতে হয়। প্রস্তাবিত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে নবীনগর উপজেলার সঙ্গে আশুগঞ্জ উপজেলা হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এতে নবীনগরের সঙ্গে ঢাকাসহ সারাদেশের অন্য অঞ্চলের দূরত্ব কমবে। প্রকল্পটি ৪২১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৮ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত মেয়াদ। মূল ডিপিপি অনুমোদন হয়েছে ২০১৮ সালের ১৪ আগস্ট। প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুত প্রকল্প এটি।
ডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ১৮ দশমিক ৭৩ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। ক্ষতিপূরণসহ এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা। আর সড়কটি নির্মাণে প্রায় সাড়ে নয় লাখ ঘনমিটার মাটির কাজ করতে হবে। পাশাপাশি সড়ক বাঁধ প্রশস্ত করা হবে। আর নয়টি ছোট সেতু ও নয়টি কালভার্ট নির্মাণ করতে হবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, ভূমি অধিগ্রহণে দরকার ৩৪ দশমিক ৯৬ হেক্টর। এতে ভূমি অধিগ্রহণ ব্যয় বাড়ছে। প্রকল্পে ১২ হাজার ৬০০ মিটার ব্রিক টো-ওয়াল অন্তর্ভুক্ত, এর দাম ধরা আছে ৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। কিন্তু বাস্তবে ৯ হাজার ৬৫২ মিটার ব্রিক টো-ওয়াল কাজ করতে হবে। এতে ব্যয় হবে ৫ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। আবার প্রকল্পে ১২ লাখ ৬ হাজার সিসি ব্লকের কাজের সংস্থান আছে; খরচ ধরা ৩১ কোটি ৫০ লাখ। বাস্তবে লাগবে ১ কোটি ১৬ লাখ ১১৮ বর্গমিটার সিসি ব্লক। তাই খরচও বাড়বে ২ কোটি ১৭ লাখ টাকা। প্রকল্পের সড়ক এলাইনমেন্ট বরাবর পার্শ্বনদী এবং গভীর পুকুর থাকায় ১ হাজার ৫২০ মিটার রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করতে হবে। এটি নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাই খরচও ধরতে হচ্ছে ৩ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। একইভাবে ৫৫০ মিটার আরসিসিইউ ড্রেন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এর খরচ ৬০ লাখ টাকা। কিন্তু বাস্তবে নবীনগর পৌর এলাকায় পানি নিষ্কাশনের জন্য সড়কের উভয় পাশে ২ হাজার ৪০০ মিটার আরসিসিইউ ড্রেন নির্মাণ করা প্রয়োজন। এ জন্য অতিরিক্ত ২ কোটি ৭২ লাখ টাকা দরকার। ড্রেনের জন্য আরও খাত নতুন করে যুক্ত করতে হচ্ছে। এ প্রকল্পে ইউটিলিটি শিফটিং বাবদ ৭ লাখ ৬০ হাজার টাকার সংস্থান আছে। কিন্তু সড়কের পাশে বৈদ্যুতিক খুঁটি, টিঅ্যান্ডটির খুঁটি, গ্যাসলাইন বিদ্যমান থাকায় বাস্তবে ১০ কোটি টাকা দরকার। নির্মাণকালীন রক্ষণাবেক্ষণে ৪ লাখ টাকা ধরা আছে। কিন্তু আসলে পাঁচ কিলোমিটার সড়ক জরুরি মেরামত না করলে যানবাহন চলাচল সম্ভব নয়। তাই অতিরিক্ত ১ কোটি টাকা দরকার। প্রকল্পে নয়টি কালভার্টের কথা বলা থাকলেও দরকার আরও ১৪টি কালভার্ট। তাই খরচ ৪ কোটি ৯৬ লাখ টাকা বাড়বে। এ রকম প্রতিটি খাতেই ত্রুটি ধরা পড়ছে। কিছু প্যাকেজের অধীনে নির্মাণকাজ চলছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করতে গিয়ে দেখছে এসব অসঙ্গতি। মূল ডিপিপিতে দুটি মৌজার জমির পরিমাণ বাদ পড়ে। সংশোধিত ডিপিপিতে তা অন্তর্ভুক্ত করতে হচ্ছে। এতে জমির দাম দেড় গুণ থেকে তিন গুণে ঠেকছে। কারণ নতুন নিয়মে, বর্তমান বাজারদরের তিন গুণ মূল দিতে হবে অধিগ্রহণ করতে হলে। আবার স্থাপনার খরচও দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। তাই এ খাতেই খরচ বেড়ে ৩৪৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা হতে যাচ্ছে। এ ছাড়া সড়ক বাঁধ প্রশস্তকরণ, ফ্লেক্সিবল পেভমেন্ট নির্মাণেও জটিলতা দেখা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সওজের রেইট শিডিউল ২০১৯-এর কারণে খরচ বাড়ছে। রক্ষাপ্রদ বাঁধ, সড়ক নিরাপত্তা, সেতু, কালভার্টসহ নতুন অন্তর্ভুক্তিতেও ঠিকাদারের উদ্ধৃত দরের কারণে ব্যয় বাড়বে। সব মিলিয়ে ৪২১ কোটি ৪৪ লাখ টাকার প্রকল্প এখন ৬৯৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা ধরতে হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হবে নবীনগর উপজেলা।
Leave a Reply