আটলান্টিক মহাসাগরের পশ্চিমে পাশে আমেরিকা মহাদেশ আর পূর্বে ইউরোপ। আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার অধিকাংশই ইউরোপের অধিবাসী। ঐতিহ্যগতভাবে তারা দীর্ঘদিনের মিত্র। তবে বিগত বছরগুলোতে ইউরোপের অধিকাংশ দেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে চিড় ধরে।
চার বছর পর সেই রুদ্ধশ্বাস অধ্যায়ের পালা শেষ হয়েছে। ইউরোপীয় রাজনীতিকেরা এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সেই ১৯৫৩ সালে ইইউ জোট গঠনের প্রাথমিক পর্যায় থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপের দেশগুলোর অর্থনৈতিক সম্পর্কের শুরু। সেই থেকেই সম্পর্ক উন্নয়নে উভয় পক্ষের প্রতিনিধিরা ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলসে দপ্তর খোলেন। শুধু কূটনৈতিক সম্পর্ক নয়, ইইউ প্রতিনিধিরা যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানীতে অবস্থিত অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর, যেমন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘে পর্যবেক্ষক পদমর্যাদায় একজন প্রতিনিধি প্রেরণ করে। ১৯৯০ সালে আটলান্টিকের উভয় পাশের দুই অংশীদারের মধ্যে একটি ট্রান্সআটলান্টিক ঘোষণাপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এরপর থেকে ইইউ কমিশন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টরা নিয়মিত শীর্ষ সম্মেলনে একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য আলোচনায় বসতেন। ১৯৯৫ সালে মাদ্রিদে ইউরোপীয়-আমেরিকান শীর্ষ সম্মেলনে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগিতার জন্য বড় পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তৎকালীন ইইউ কমিশনের সভাপতি জ্যাক সান্টার এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন সেই নতুন চুক্তিগুলো স্বাক্ষর করেছিলেন।
ট্রাম্প জামানার আগপর্যন্ত এই সম্পর্কের ক্রমেই উন্নয়ন হয়েছে।
২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ট্রান্সআটলান্টিক উন্নয়ন সৌহার্দ্যের চুক্তিগুলো অবিশ্বাস আর সংশয়ে ডুবতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের তিন দিন আগে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পেনসিলভানিয়া রাজ্যের নিউটনে এক নির্বাচনী সমাবেশে বলেছিলেন, জার্মানিসহ ইউরোপের বেশ কিছু দেশ আসন্ন নির্বাচনে তার পরাজয়ের জন্য অপেক্ষা করছে।
‘আমেরিকাই প্রথম’—এই দর্শনে বিশ্বাসী ট্রাম্প আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সমন্বয়ের গুরুত্ব না বুঝেই অনেক চুক্তি প্রায় একতরফাভাবে বাতিল করেন। তাঁর এই নীতি ইউরোপীয় মিত্রদের অনেককেই ক্রুদ্ধ করে। শুধু নিজের দেশকে অর্থনীতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে একের পর এক ঐতিহ্যবাহী অর্থনৈতিক, সামরিক, সামাজিক চুক্তিগুলো বাতিল ও যখন-তখন বিভিন্ন দেশকে নিয়ে বিদ্রূপ ও কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত লাগামহীন কথাবার্তা তাঁকে প্রায় বিশ্বভাঁড়ে পরিণত করে।
ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি ছিল অনেকটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক। বিশ্বনেতাদের সঙ্গে নিজের সম্পর্কের ভিত্তিতেই চলত তাঁর পররাষ্ট্রনীতি। ট্রাম্পের ‘আমেরিকাই প্রথম’ বিষয়টি একটি চতুর ও জনপ্রিয়তাবাদী স্লোগান। নইলে একই গ্রহে, একই জল-বাতাসের মানুষ হয়ে কেউ যদি বলে যে জলবায়ু রক্ষায় আমার কোনো দায়িত্ব নেই— বিষয়টি কোনো রাষ্ট্রনায়কসুলভ কথা নয়।
ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর ইউরোপ থেকে তৈরি গাড়ি, ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানির ওপর শুল্ক চাপানো, ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি বাতিল, জেরুজালেমে মার্কিনদের দূতাবাস স্থানান্তর এবং জলবায়ু ও পরিবেশসংক্রান্ত প্যারিস চুক্তি থেকে বের হয়ে যাওয়া, ন্যাটো সামরিক জোটে পর্যাপ্ত অর্থ প্রদান না করা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মতো সিদ্ধান্তের বিষয়ে ইউরোপীয় পুরোনো মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলেছে কয়েক বছর থেকেই।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকেই অধিকাংশ সাবেক ইউরোপীয় মিত্রদের বিরুদ্ধে নির্বাচনের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত বিষোদ্গার করেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ক্ষয়িষ্ণু জোট ও সময়ের বিবর্তনে তা ভেঙে পড়ার কথা তিনি প্রায়ই বলে থাকেন। মূলত ইইউভুক্ত ২৭ দেশকে নিয়ে বিদ্রূপ করতেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের এহেন আচরণে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ প্রায়শই ইউরোপীয় নিয়ন্ত্রণ ও আত্ম-অধিকারের কথা বলে আসছেন। তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর জন্য গঠিত প্রতিরক্ষা তহবিলের (ইডিএফ) বা প্রস্তাবিত ইউরোপীয় সেনাবাহিনীর প্রবক্তা।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে জো বাইডেনের বিজয়ের সংবাদের কয়েক ঘণ্টা পরই ইউরোপীয় রাজনীতিকেরা তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল দুই দেশের মধ্যে আবার নিবিড় সম্পর্ক ও ‘ট্রান্সআটলান্টিক বন্ধুত্বের’ প্রত্যাশার কথা বলেছেন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ জো বাইডেন ও তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, ‘আজকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের অনেক কিছু করার আছে। আসুন আমরা একসঙ্গে কাজ করি।’ ইইউ কমিশনের সভাপতি ভন ডের লেইন জো বাইডেনকে অভিনন্দন জানিয়ে চিঠিও লিখেছেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিসের ঐতিহাসিক সাফল্যের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন। ইইউ পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট ডেভিড সাসোলিও জো বাইডেনকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ট্রান্সআটলান্টিক সম্পর্কের পুনরুজ্জীবনের আহ্বান জানিয়েছেন। জার্মানির প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্ক-ভাল্টার স্টাইনমায়ার জো বাইডেনের উদ্দেশে লিখেছেন, ‘আসুন আমরা আমাদের ইউরোপীয় প্রতিবেশীদের সঙ্গে ট্রান্সআটলান্টিক অংশীদারত্ব নবায়ন করি।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘জার্মানি আরও শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়ভিত্তিক বিশ্বের জন্য আপনার পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত।’
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে জো বাইডেনে জয়লাভে ইউরোপীয় রাজনীতিকেরা সবাই আবারও ট্রান্সআটলান্টিক বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক নিয়ে আশার আলো দেখছেন। যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইউরোপের অনেক শহরের জনগণ ট্রাম্পের পতনে আনন্দ-উল্লাস করেছেন। লন্ডন, প্যারিস, বার্লিন, মিউনিখ, এডিনবার্গ প্রভৃতি শহরে শনিবার রাতে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। কোনো কোনো শহরে আতশবাজি হয়। প্যারিসের একটি গির্জা থেকে ঘণ্টি বাজানো হয়।
আগামী দিনে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক কতটা সহজভাবে একে অপরের অংশীদার হতে পারবে বা ন্যাটো জোট নিয়ে কতটা কাছে আসতে পারবে, তা নির্ভর করবে উভয় পক্ষের সদিচ্ছার ওপর। তবে আশার কথা এই, ট্রান্সআটলান্টিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আগে যেমন আলোচনার পরিবেশ প্রায় রুদ্ধ হয়েছিল, বাইডেনের আমলে সেই রুদ্ধ পরিবেশের অবসান হবে।
সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি
Leave a Reply