ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন কার্যকর না করে নতুন আইন করে শাস্তি বাড়িয়ে কোনো লাভ হবে না। এমন মন্তব্য আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সাবেক নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজার। কঠোরতায়ও কেন ধর্ষণ থামছে না- এমন প্রশ্নে গতকাল আমাদের সময়কে তিনি এ কথা বলেন।
ধর্ষণের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ চলছেই। এ ঘৃণ্য অপরাধ ঠেকাতে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হয়েছে। প্রশাসনও সোচ্চার। তার পরও থামছে না ধর্ষণের ঘটনা। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও নির্মম পাশবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে নারী-শিশু। করোনা ভাইরাস মহামারীর মধ্যে চলতি বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে স্বামীকে বেঁধে নববধূকে গণধর্ষণ করে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। এর পর পরই ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে বিবস্ত্র করে নির্মম নির্যাতনের চিত্র।
গত ২ সেপ্টেম্বর বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের খালপাড় এলাকায় মোবাইল ফোনে ধারণ করা নির্মম এ নির্যাতনের ঘটনা ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে তা নাড়া দেয় গোটা দেশকে। জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তিসহ সব ধর্ষণের বিচার নিশ্চিতের দাবিতে বিক্ষোভ-আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে রাজধানী। মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল ও সড়ক অবরোধ করে প্রতিবাদ সমাবেশ হচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও।
এর মাঝেই গত মঙ্গলবার জরুরি বিবেচনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে ধর্ষণের শাস্তি বাড়িয়ে মৃত্যুদ-ের বিধান রেখে অধ্যাদেশে সই করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। এ অধ্যাদেশের মধ্য দিয়ে মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত আইনটি কার্যকর হলো। আগের আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড। এখন সর্বোচ্চ শাস্তি হবে ‘মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’। ধর্ষণ ঠেকাতে সরকার কঠোর থেকে কঠোরতর পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও থামছে না এ ঘৃণ্য অপরাধ।
তথ্য বলছে, ২০১৭-২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯-২০২০ সালে সারাদেশে ধর্ষণ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী- ২০১৬ সালে দেশব্যাপী ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ৭২৪টি, ২০১৭ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮১৮। পরের বছর ঘটে ৭৩২টি। ২০১৯ সালে ধর্ষণ হয় এক হাজার ৪১টি। আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ৯৭৫টি। এর মধ্যে মার্চে ঘটে ৬৭টি। করোনার মধ্যে এপ্রিলে ঘটে ৭৬টি। মে মাসে ৯৪টি। মার্চের প্রায় তিনগুণ ধর্ষণ হয় জুনে- ১৭৬টি। একই পরিস্থিতি বজায় থাকে জুলাই ও আগস্টে। এ দুই মাসে ধর্ষণের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৪০ ও ১৪৮টি। সেপ্টেম্বরে ঘটে ৮৬টি। গত ৯ মাসে সারাদেশে গণধর্ষণের শিকার হন ২০৮ জন। ধর্ষণের পর খুন হন ৪৩ জন। আত্মহত্যা করেন ১২ নারী। যৌন হয়রানির শিকার ১৬১ জন। যৌন হয়রানির কারণে আত্মহত্যা করেন ১২ জন। আর যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করে খুন হন ৩ নারী ও ৯ পুরুষ। আসকের এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৯ ও ২০২০ সালে সারাদেশে দৈনিক গড়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪ নারী। যেখানে ২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ছিল গড়ে দুজন।
চলতি মাসের গত ১৫ দিনে সারাদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪৫ জন। গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১২ জন। গত বৃহস্পতিবার রাতেও রাজধানীর মহাখালীতে সরকারি তিতুমীর কলেজের উল্টো দিকের গলির একটি গ্যারেজে এক কলেজছাত্রীকে প্রায় পৌনে দুই ঘণ্টা আটকে রেখে তার বন্ধুর সামনে শ্লীলতাহানি করে ৭ থেকে ৮ বখাটে। তারা দুজনের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয় সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। গত শুক্রবার ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী বনানী থানায় এ ব্যাপারে অভিযোগ জানিয়েছেন। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের অধ্যাদেশ জারির দিনই রাজধানীর পল্লবীতে ধর্ষণের শিকার হয় সাড়ে পাঁচ বছরের এক শিশু। মৃত্যুদ-ের বিধান যোগ করে সংশোধিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন অধ্যাদেশ-২০২০ এর অধীনেই এ মামলা হয়। ধর্ষণের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনের মধ্যেই গত শনিবার রাতে মিরপুরের কালশীর একটি মেসে গণধর্ষণের শিকার হন এক তরুণী। গত ৪ অক্টোবর সবুজবাগ থানাধীন বাসাবোয় ধর্ষিত হন এক তরুণী। গত ৬ ও ৭ অক্টোবর চকোলেটের লোভ দেখিয়ে খিলগাঁও উত্তর গোড়ান এলাকায় ৬ থেকে ৯ বছর বয়সী ৪ শিশুকে ধর্ষণ করে সজল মোল্লা (৫৫) নামে এক নরপশু। শেরেবাংলা নগর থানার তালতলায় গৃহকর্মীর ৮ বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে গত ৩ অক্টোবর শাহ জালাল (৩৫) নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। রাজধানীর ৬০ ফিট এলাকায় নিজ বাসায় এক তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগে গত ১ অক্টোবর গ্রেপ্তার হন ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সবুজ আল সাহবা। সে দিনই দুই জা’কে ধর্ষণের অভিযোগে মনিরুল ইসলাম মনির নামের এক ট্যাক্সিচালককে হাজারিবাগ থানা পুলিশে দিয়েছেন ভুক্তভোগী দুই গৃহবধূ।
এ ছাড়া রাজধানীর কুড়িলে টানা ১১ দিন ৪ কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে হৃদয় নামে এক তরুণকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে গত ২৮ সেপ্টেম্বর। পূর্ব ধানম-ির ভূতের গলি এলাকায় এক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে তার সৎবাবাকে ২৫ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ২২ সেপ্টেম্বর শ্যামপুরে পাঁচ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। ২০ সেপ্টেম্বর মিরপুর-১১ নম্বরের একটি বাড়িতে পূত্রবধূকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে তার শ্বশুরের বিরুদ্ধে। ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে নানিবাড়ি থেকে নিজ বাসায় যাওয়ার পথে আদাবরের নবোদয় হাউজিং এলাকায় ধর্ষণের শিকার হয় এক কিশোরী গার্মেন্টকর্মী। ১৪ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ীর মোমিনবাগে ১৬ বছরের এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে তিন যুবকের বিরুদ্ধে। ২৪ সেপ্টেম্বর বিরিয়ানি খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে হাতিরঝিল থেকে এক ভিক্ষুকের ৩ সন্তানকে তুলে নেওয়ার পর গাড়িতেই তার ৪ বছরের মেয়ে আর আড়াই বছরের ছেলের সামনে ৯ বছরের মেয়েকে একাধিকবার ধর্ষণ করে রাস্তায় নামিয়ে দেয় বিল্লাল হোসেন (২৬) নামে যৌন বিকারগ্রস্ত এক নরপশু। ২৮ আগস্ট পল্লবীর ১২ নম্বর সেকশনের বালুরমাঠ কুর্মিটোলা বস্তিতে ১৩ বছর বয়সী এক কিশোরীকে গণধর্ষণ করে ৩ বখাটে। তৃতীয় শ্রেণির ওই শিক্ষার্থীকে পাশবিক নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হয়নি ধর্ষকরা। বর্বরোচিত কাণ্ডের পুরো দৃশ্য মোবাইল ক্যামেরায় ধারণ করে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে মেয়েটিকে ফের ধর্ষণের হুমকি দেয় তারা। ১৫ আগস্ট রাতে মিরপুরের কল্যাণপুরের একটি স্কুলের পেছনে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী এক তরুণী ধর্ষণের শিকার হন। এসব ঘটনা ছাড়াও গত দুমাসে আরও বেশ কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে রাজধানীতে। সারাদেশের অবস্থা আরও ভয়াবহ।
আইন কার্যকর না হলে শাস্তি বাড়িয়ে কোনো লাভ হবে না বলে মন্তব্য করেছেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সাবেক নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা। কঠোরতায়ও কেন ধর্ষণ থামছে না- এমন প্রশ্নে গতকাল আমাদের সময়কে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ধর্ষণের ক্ষেত্রে প্রচলিত যে আইন ছিল (সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড) সেটি কি কম? কিন্তু ধর্ষণের ঘটনায় আগের সাজাই আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। সমস্যা ছিল আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে, বিচারব্যবস্থায়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ধর্ষকরা ছিল বেপরোয়া। অপরাধ করেও পার পেয়ে যায় তারা। ফলে একের পর এক বেড়েই চলেছে ধর্ষণ। এখন ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে; কিন্তু এই দ-েই ধর্ষণ কমবে না। মৃত্যুদণ্ডের আইন করেও যদি সেটি কার্যকর করা সম্ভব না হয়, তা হলে আইন সংশোধনের মধ্য দিয়ে কিছু আশা করা যায় না। আইনের সঠিক প্রয়োগ ও অপরাধীদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা না গেলে সমস্যার উত্তরণ অসম্ভব। তাই আইন নয়, আইনের প্রয়োগ হলেই কমবে ধর্ষণ-নির্যাতন।
তিনি বলেন, সাধারণ যে নারীটা ধর্ষণের শিকার, নতুন আইন হওয়ার পর তার জন্য কি সব সহজ হয়ে গেছে? তিনি কি থানায় গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে সঠিক সেবাটা পাচ্ছেন? পুলিশ কি সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে? না। কিছুই হবে না। আমার মনে হচ্ছে, এটা একটা অকাজের কাজ হচ্ছে, কোনো মানে নেই। আইন কার্যকর না হলে এই নরপশুদের কিছু আসবে-যাবে না। আসল কথা হলো- যারা অপশক্তি, তাদের আটকাতে হবে। এই অপশক্তিকে আটকাতে হলে রাষ্ট্রকেই কাজ করতে হবে। প্রতিটা সিস্টেমের মধ্যে সেটা নিয়ে আসতে হবে। মন-মানসিকতা, আচরণ, ক্ষমতার ব্যবহার; বদলাতে হবে সবকিছু। ধর্ষণের শিকার যারা ভয়ে থানায় যায় না, তারা কেন ভয় পায় সেটি খুঁজতে হবে। সে বিষয়গুলো ক্লিয়ার করতে হবে আগে। দেখতে হবে থানা তাকে কী সার্পোট দেয়। এটা মনিটর কেউ করছে কিনা? কোর্ট কত সময়ের ভেতরে অপরাধীর বিচার করছেন। তা ছাড়া আইনের অনেক সমস্যা আছে; অনেক রকম বিষয় আছে। আমরা যদি দেখতাম, পুরনো আইনে হাজার হাজার বিচার কার্যকর হয়েছে; তার পরও ধর্ষণ ঠেকানো যাচ্ছে না- তখন ভাবতাম নতুন আইন লাভ বয়ে আনতে পারে; কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের অপরাধে ১০ শতাংশ মানুষও বিচার পাচ্ছে না। বিচারহীনতার কারণে বিরক্ত হয়ে নারীর মুক্তির জন্য মানুষ আজ রাস্তায় নেমেছে। কাজেই সব অপশক্তিকে উপেক্ষা করে এখন যদি কয়েকটা বিচার দ্রুত করা যায়, তা হলেই অপরাধীরা ভয় পাবে। আইনের প্রতি আস্থা ফিরে আসবে মানুষের। অনেকটা কমে আসবে ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনা।
Leave a Reply