যত শত্রু তত মর্যাদা, পুরোনো এই জার্মান প্রবাদকে কাজেকর্মে ফলিয়ে তুলছে তুরস্ক। ইরান ও আজারবাইজান ছাড়া আর সব প্রতিবেশীর সঙ্গে শত্রুতা তার। একসময় অনেকগুলো ফ্রন্টে একসঙ্গে যুদ্ধ চালাবার তাকদ দেখিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তুর্কি সুলতানের উচ্চাভিলাষ সেই পর্যায়ে না গেলেও লক্ষণ সে রকমই।
২০০৩ সালে প্রথম ক্ষমতায় আসেন তুর্কি একেপি পার্টির নেতা রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান—আরবি উচ্চারণে রজব তৈয়ব রিদওয়ান। ক্ষমতার ১৭ বছরে এসে তিনি বদলে দিয়েছেন এক পুরোনো রুশ কৌতুকের অর্থ। এক গ্রাম্য ইহুদি তরুণ যুদ্ধ যাচ্ছে। ছেলেকে বিদায় দেওয়ার সময় মা তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলছে, ‘বাবা, বেশি পরিশ্রম করবি না। একটা করে তুর্কি মারবি আর জিরিয়ে নিবি।’
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর ইউরোপে এমনই ছিল তুরস্কের ভাবমূর্তি। ওই গ্রামীণ বৃদ্ধাও সেটা জানতেন। অবক্ষয়িত অটোমান সেনাদের হত্যাকে মনে করেছিলেন এমনই ডালভাত। তাই বলছেন, ‘একটা করে তুর্কি মারবি আর জিরিয়ে নিবি।’। ছেলেটা তখন মাকে বলে, ‘কিন্তু তুর্কিরা যদি আমাকে মারে?’ মা তো অবাক, ‘তোকে মারবে কেন, তুই তাদের কী ক্ষতি করেছিস?’ এই ছিল সে সময়ের গড়পড়তা ইউরোপীয় মনস্তত্ত্ব।
আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার তাজা যুদ্ধে সরাসরি আজারবাইজানের পক্ষে তুরস্ক। ফলে তুরস্কের সামনে তৈরি হয়ে গেল নতুন আরেকটা ফ্রন্টলাইন: ককেশাস। এর আগে ভূমধ্যসাগর ও কৃষ্ণসাগরের পারের গ্রিস ও গ্রিক–সাইপ্রাসের সঙ্গে বিবাদ প্রায় সামরিক সংঘর্ষের পর্যায়ে গিয়ে থামলেও বন্দুকের বারুদ ও ব্যারেল এখনো উত্তপ্ত। সিরিয়া ও ইরাকে কখনো আসাদ বাহিনী, কখনো কুর্দি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে তুরস্ক। লিবিয়ায় তারা থামিয়ে দিয়েছে ফ্রান্স ও রাশিয়া-সমর্থিত বিদ্রোহী জেনারেল হাফতারের বাহিনীকে।
সিরিয়ায় সেনাঘাঁটির পর লিবিয়ায়ও সামরিক ঘাঁটি বানানোর পথে তুরস্ক। আজারবাইজানেও তুর্কি ঘাঁটি হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র—ইতিমধ্যে তুর্কি বিমান-ড্রোন ও সামরিক উপদেষ্টারা সেখানে সক্রিয়। ফিলিস্তিন প্রশ্নেও ইসরায়েলের সঙ্গে বিবাদ তুরস্কের। জেনারেল সিসির মিসর সরাসরি তুরস্কের সঙ্গে শত্রুতা করে মন্ত্রণা দিচ্ছে গ্রিসকে। ফরাসি যুদ্ধজাহাজ লিবীয় তেলের জাহাজকে তল্লাশি করতে এসে দেখে, সেটাকে পাহারা দিচ্ছে তুর্কি ফ্রিগেট। কৃষ্ণসাগরেও নৌবাহিনীর পাহারায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান চালাতে হচ্ছে তুরস্ককে।
আগের সেই অবস্থা উল্টে দিতে তুরস্ক নিয়েছে সম্রাট বিসমার্কের জার্মানির স্লোগান: যত শত্রু তত মর্যাদা। সিরিয়ায় আসাদ বাহিনী, আইএস ও কুর্দিদের বিরুদ্ধে লড়ছে তুরস্ক। লিবিয়ায় মিসর ও রাশিয়া-সমর্থিত হাফতার বাহিনীকে ঠেকিয়ে রাজধানীতে জাতিসংঘ-সমর্থিত সরকারকে টিকিয়ে রাখার কৃতিত্বও এরদোয়ানের। ইরাকি কুর্দিদের বিরুদ্ধেও অভিযানে রয়েছে তর্কি সেনারা। রয়েছে গ্রিস, গ্রিক-সাইপ্রাস ও মিসরের সঙ্গে নিচু মাত্রার ঠোকাঠুকি। এখন তো নতুন ফ্রন্ট খোলা হলো আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে, যদিও এখানে ভায়া হলো আজারবাইজান। আখেরে এটা তুরস্কের জন্য ভালো কি মন্দ হবে, সেটা অন্য আলোচনা। তার আগে দেখা দরকার কেন এতগুলো সীমান্তে ফ্রন্ট খুলেছেন নতুন তুর্কি সুলতান। কেন তাঁর বাহিনীকে থাকতে হচ্ছে সদাজাগ্রত?
প্রতিটি যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তবতা একটা আরেকটার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। সিরিয়ায় কুর্দদের ঠেকাতে না পারলে প্রথমে তুরস্কের সীমান্তে এবং পরে পশ্চিমা সমর্থনে তুর্কি ভূখণ্ডের কিছু অংশে স্বাধীন কুর্দিস্তান প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। তা ছাড়া সিরিয়ায় শান্তি না এলে কীভাবে তুরস্কে আশ্রয় নেওয়া ২.৭ মিলিয়ন সিরীয় শরণার্থীর বোঝা থেকে তুরস্কের নাজুক অর্থনীতি মুক্ত হবে? অন্যদিকে রাশিয়া সিরিয়ায় ঘাঁটি করে থাকা মানে তুরস্কের নিরাপত্তা হুমকিতে থাকা। তুরস্কের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে তার দরকার লিবিয়ার তেল, সম্ভব হলে কয়েকটি তেলখনির দখল। আজারবাইজানের তেল-গ্যাস পাইপলাইন দিয়ে তুরস্ক আসে। কৃষ্ণসাগরের বিপুল তেলভান্ডার আবিষ্কার এবং লিবিয়া-সিরিয়া-ইরান-ইরাক ও আজারবাইজান থেকে আমদানি করা তেল-গ্যাসের নিশ্চয়তা তুরস্ককে জ্বালানির জন্য অতিমাত্রায় রুশ নির্ভরতরা থেকে বের করে আনবে।
আঞ্চলিক জ্বালানি পরাশক্তি হয়ে ওঠার তুর্কি বাসনা গোপনও নয়। দেশটা এই ভূমিকার জন্য সব দিক থেকেই সুবিধাজনক জায়গাতেই বসে আছে। রুশ বংশোদ্ভূত মার্কিন অধ্যাপক দিমিতার বেশেভের ভাষায়, ‘এর দুই পাশে তেল ও গ্যাস উৎপাদক মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ ককেশীয় অঞ্চল এবং জ্বালানির ক্রেতা ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো। এ অবস্থানগত সুবিধাই হলো তুরস্কের হাতের ট্রাম্প কার্ড। তবে তুরস্কের কৃষ্ণসাগরে বিরাট গ্যাস মজুত আবিষ্কার আসলেই খেলার নিয়ম বদলে দেবে।…কৃষ্ণসাগরে জ্বালানি গ্যাসের মজুত আবিষ্কার তুরস্কের দর-কষাকষির ক্ষমতাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।’
এই জটিল খেলা কেবল শক্তির নয়, ভূরাজনীতির নয়, বুদ্ধিরও। তা ছাড়া করোনায় বেসামাল অর্থনীতির কারণেও অজনপ্রিয়তা সারাতে একটা যুদ্ধ দরকার ছিল এরদোয়ানের। এ ব্যাপারেও তিনি সফল। পদ্ধতি নিয়ে সমালোচনা থাকলেও তাঁর বিরোধীরাও নাগরনো কারাবাখ প্রশ্নে এরদোয়ানের পক্ষে একযোগে খাড়া।
অর্থনীতি নয়, সামরিক শক্তিই এখন এরদোয়ানের একমাত্র হাতিয়ার। এখন পর্যন্ত কোথাও হেরে ফিরতে হয়নি তুর্কিদের। কখন থামতে হবে আর কখন চাপ বাড়াতে হবে, মনে হয় সেই নিয়মটা জানেন এই জনতুষ্টিবাদী প্রায়–একনায়ক। দূরের দিকে তাকিয়ে তুরস্কের সমরাস্ত্র কারখানাকে শক্তিশালী করেছেন তিনি। তুরস্ক এখন সশস্ত্র ড্রোন, যুদ্ধজাহাজ ও জঙ্গি হেলিকপ্টার বানাতে সক্ষম।
আজকে যা ন্যায্যতার দাবি, কালই তা হয়ে উঠবে উগ্র জাতীয়তাবাদের সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্ক্ষা। আমরা ব্রিটেন, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের উচ্চাভিলাষের সাম্রাজ্য দেখেছি। তাদের আগের সেই জোর আর নেই। মধ্যপ্রাচ্য থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছে ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্র। সেই শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসছে রাশিয়া, তুরস্ক, ইরান ও চীন। এখনো ভূখণ্ডের দিকে নয়, একচেটিয়া অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের দিকেই চীনের নজর। ইরান এখন মোটামুটি ঘর সামলাতেই ব্যস্ত, বিশেষ করে ইরাক ও লেবানন নিয়ে তার অবস্থা পেরেশান। সেই অবকাশে মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিযোগিতা কখনো বন্ধুত্ব আবার কখনো বিচ্ছিন্ন সংঘাতে জড়াজড়ি করে এগোচ্ছেন পুতিন আর এরদোয়ান। আর পুতিন এমনই প্রখর যে, শত্রুর মতো বন্ধুকেও তিনি শান্তিতে ঘুমাতে দেন না। সামরিক অভ্যুত্থান মোকাবিলায় তিনি ছিলেন এরদোয়ানের বন্ধু, আবার সিরিয়া থেকে লিবিয়া কিংবা নাগর্নো–কারবাখে হতে যাচ্ছেন সম্ভাব্য শত্রু।
তুর্কি সাম্রাজ্যের স্বপ্নে তো বটেই, পুতিনের চিন্তাতেও ঘুম নেই এরদোয়ানের। তুর্কি সুলতান মারাত্মক খেলাতেই নেমেছেন। আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক জয় তাঁকে দিনকে দিন আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলছে। একইসঙ্গে ডেকে আনছে নতুন নতুন শত্রুর সংঘে সংঘাতের ঝুঁকি। কোনো সন্দেহ নেই, সব মিলিয়ে তুর্কি সুলতান এরদোয়ানের সামনে রয়েছে আরও আরও বিনিদ্র বছর।
ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও লেখক।
Leave a Reply