একাদশ সংসদ নির্বাচনের একবছরের মাথায় আগামী ১ ফেব্রুয়ারি হতে যাচ্ছে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন। মাঝখানে সময় আছে আর মাত্র তিন দিন। পক্ষকালব্যাপী তুমুল প্রচার-প্রচারণা শেষ হচ্ছে আগামীকাল বৃহস্পতিবার মধ্যরাতেই। লড়াইয়ের মূল প্লাটফর্মে আছে দুই প্রতীক নৌকা আর ধানের শীষ। এখন মূল প্রশ্ন হচ্ছেÑ ‘সুষ্ঠু ভোট হবে তো?’। নাকি ফিরে আসবে তিক্ত অতীত।
জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে না পারার ‘তিক্ত অভিজ্ঞতা’ ভুলতে না ভুলতেই নগরবাসীর দোরগোড়ায় এসেছে এই ভোট। ভোটের মাঠ সমান্তরাল আছে কি নেই, তা নিয়ে বিতর্ক লেগেই আছে। সরকারি দলের মূল প্রতিপক্ষ বিএনপির দুই প্রার্থী উত্তরে তাবিথ আউয়াল ও দক্ষিণে ইশরাক হোসেনের নির্বাচনী প্রচারণায় একাধিকবার হামলা হয়েছে। সরকারি দলের কাউন্সিলরদের প্রতাপে ভয়ভীতি, হামলার মধ্যেই প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা। আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বলছেন, বিএনপির প্রার্থীরা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। তবে নির্বাচনী মাঠে বড় ধরনের সহিংস কোনো ঘটনা এখনো ঘটেনি বলেই অনেকের মত।
দক্ষিণে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ফজলে নূর তাপস এবং উত্তরে আতিকুল ইসলাম অনেকটা ফুরফুরে মেজাজেই রয়েছেন। দুই প্রার্থীই দাবি করেছেন, তাদের বিজয় সুনিশ্চিত। তাপস সংসদ সদস্যের পদ ছেড়ে এই নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়েরও পছন্দের প্রার্থী তাপস। সাঈদ খোকনকে বাদ দিয়ে তাপসকে প্রার্থী হিসেবে বেছে নেয় আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। তার প্রতিদ্বন্দ্বী উচ্চ শিক্ষিত ইশরাক হোসেন। বয়সে তরুণ হলেও নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে ইশরাক ইতোমধ্যে সাড়া ফেলে দিয়েছেন। তার সাহসিকতার প্রশংসা করছেন অনেকেই। দক্ষিণ সিটিতে তার বাবা মরহুম সাদেক হোসেন খোকার ভিত্তি অত্যন্ত মজবুত থাকায়, সেই ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার চেষ্টা করছেন ইশরাক। নির্বাচনের মাঠে নিজ দলের রাজনৈতিক কর্মী বাদেও বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের উষ্ণ আতিথেয়তা পাচ্ছেন তিনি।
অন্য দিকে উত্তর সিটিতে ব্যবসায়ী আতিকুল ইসলামের প্রতিদ্বন্দ্বী আরেক ব্যবসায়ী ও তরুণ রাজনীতিবিদ তাবিথ আউয়াল। কয়েক দিন আগে ‘দারুণ তাল তুলে’ আতিকুল ইসলামের গান গাওয়ার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এতে করে তার ফুরফুরে মেজাজের একটি পরিচয় পাওয়া গেছে। যদিও ডেঙ্গু মোকাবেলায় তার ব্যর্থতা সাধারণ ভোটারদের মধ্যে দাগ কেটে আছে। আনিসুল হকের মৃত্যুর পর তার বাকি সময়ের জন্য আতিকুল ইসলাম মেয়র নির্বাচিত হন। তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন এক বছর। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ঢাকাকে আরো আধুনিক ও বাসযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার। আতিকুলের প্রতিদ্বন্দ্বী তাবিথ আউয়াল ২০১৫ সালের সিটি নির্বাচনে আনিসুল হকের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। ওই নির্বাচন বিএনপি বর্জন করলেও কয়েক ঘণ্টার ভোটে তাবিথ তিন লাখের মতো ভোট পান। তাই অনেকের ধারণা ভোটের মাঠে এবার আতিকুলের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী তাবিথ আউয়াল।
ধানের শীষ ও নৌকার লড়াই জমে গেছে। এখন চলছে ভোট নিয়ে নানা সমীকরণ। কী হবে ১ ফেব্রুয়ারি। ইভিএমে হচ্ছে এবার ভোট। ইভিএম নিয়েও রয়েছে বিএনপিতে শঙ্কা।
ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবেÑ ভোটের মাঠে এ প্রচারই বেশি করছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীন দলটির নেতারা বলছেন, বিএনপির নেতারা ভোট চাওয়ার চেয়ে ভোটকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছেন। ফলে তাদেরও জোর দিতে হচ্ছে ভোট সুষ্ঠু হবে বলে ভোটারদের কেন্দ্রে নেয়ার প্রচারে। আওয়ামী লীগ সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, ভোটের মাঠ দখলে রাখতে দলীয় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী প্রচারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ভোটের অন্য হিসাব-নিকাশ আমাদের কারো জানা নেই। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করছেন। ভোটের মাঠের দলীয় আর কোনো সিদ্ধান্ত কারো জানা নেই। তিনি আরো বলেন, সিটি ভোটের জয়-পরাজয় জাতীয় রাজনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে, আওয়ীমী লীগের লাভক্ষতি কী হবেÑ সবই বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে।
সম্প্রতি ভোট নিয়ে যে নেতিবাচক ধারণা জন্ম নিয়েছে দেশের মানুষের কাছে তা ইতিবাচক করে তোলার চেষ্টা করছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব। ঢাকা সিটির ভোটে এটিকে ইতিবাচক করা ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, ঢাকা সিটিতে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট করতে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন। এবার হবেও তাই। ভোট নিয়ে কোনো বিতর্ক সরকার কাঁধে নিতে চায় না। তবে এতসব আশ্বাসেও কাজ হচ্ছে না। ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচারে প্রশ্নের মুখে পড়েছেন আওয়ামী লীগের দুই মেয়রপ্রার্থী উত্তরের আতিকুল ইসলাম ও দক্ষিণের শেখ ফজলে নূর তাপস। ভোট কতখানি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে ভোটাররা তার নিশ্চয়তা চাইছেন ক্ষমতাসীন দলের দুই মেয়রপ্রার্থী ও তাদের প্রচারের দায়িত্বে থাকা নেতাদের কাছে। ভোট চাইতে অলিগলি ও ঘরে ঘরে যেখানেই যাচ্ছেন ঘুরেফিরে ভোটারদের একই প্রশ্নের মুখে পড়ছেন তারাÑ ভোট হবে তো? কারচুপি হবে না তো? দুই সিটিতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীরাও প্রচারে একই প্রশ্নের মুখে পড়ছেন। ভোটারদের এই প্রশ্ন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দিচ্ছে বলে প্রচারে থাকা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা জানিয়েছেন।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি নির্বাচনে জয় নিশ্চিতে শেষ মুহূর্তের হিসাব মেলাতে ব্যস্ত বিএনপি। ধানের শীষের জয়ের লক্ষ্যে নানা কৌশল ও তা বাস্তবায়নে কাজ করছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। তাদের মতে, ভোটে জিততে হলে অন্তত চারটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। এগুলো হচ্ছেÑ ভোটের দিন প্রতিটি বুথে পোলিং এজেন্টের উপস্থিতি নিশ্চিত করা, নেতাকর্মীদের মাঠে থাকা, ভোটারদের কেন্দ্রে আনা এবং যে কোনো পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত ভোটে থাকা। এসব মোকাবেলায় ব্যর্থ হলে ফল নিজেদের ঘরে তোলা কঠিন হবে বলে মনে করছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ প্রসঙ্গে বলেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হলে ধানের শীষের প্রার্থী বিপুল ভোটে জয়লাভ করপ্রণ। কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে শঙ্কা, ভোট আদৌ নিরপেক্ষ হবে কি না। তিনি বলেন, ভোটাররা কেন্দ্রে এসে ভোট দেয়ার সুযোগ পেলে তারা ধানের শীষেই ভোট দেবেন। ক্ষমতাসীনরাও সেটা জানেন। তাই তারা চাইবে যেকোনো মূল্যে ভোটাররা যাতে কেন্দ্রমুখী না হন। ভোটারদের প্রতি আমাদের আহ্বান, অধিকার রক্ষায় তারা যেন কেন্দ্রে আসেন এবং পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেন।
Leave a Reply