১৯ বছর আগের সেপ্টেম্বরে এ যুদ্ধের শুরু। আর ২০২০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর কাতারের দোহায় একই প্রতিপক্ষরা বসেছে যুদ্ধের বদলে শান্তির খোঁজে। ইতিহাসের নির্মম কৌতুকই বলতে হয় একে। কোনো এক অনাগত ইতিহাস এ রকম যুদ্ধবাজ আর কপট শান্তিবাদীদের নিশ্চয়ই হাজার হাজার বেসামরিক মানুষের খুনের দায় নিতে বলবে। তারপরও সাধারণ আফগানরা এখনই শান্তি চায়। কিন্তু তালেবান কী পারবে সেটা দিতে? বন্দুক হাতে পাহাড়ের ফাঁকফোকর থেকে বিদেশি প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেয়েও কঠিন এক চ্যালেঞ্জের মুখে এবার তারা। আলোচনার টেবিলে ন্যাটো জেনারেলরা নেই এখন। এবার স্বদেশি ভিন্নমতাবলম্বীদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে তাদের। যুক্তিতর্ক আর আশ্বাসে নিজ দেশের বিভিন্ন মহলকে আশ্বস্ত করতে পারলেই কেবল কাবুলে ক্ষমতার ভাগ পাবে তারা।
‘তালেবান’ অর্থ ‘শিক্ষার্থী’ হলেও দোহায় ২১ সদস্যের যে দলটি দর-কষাকষি করতে এল, তাতে তরুণ কেউ নেই। ২০১৬ সালে কাবুল দখলের সময় ‘তালেব’দের এ দলের নেতৃত্বে তরুণেরাই ছিল। পাঁচ বছর পর ন্যাটোর আগ্রাসনের মুখে ক্ষমতা হারিয়ে এবং ১৯ বছর গেরিলাযুদ্ধ শেষে নেতৃত্বের সবাই এখন বেশ বয়স্ক। দোহায় এ ‘টিম-তালেবান’কে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের কথিত ‘প্রধান বিচারপতি’ আবদুল হাকিম ইসহাকজাই। উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের দারুল উলুম হাক্কানিয়ার এ স্নাতকেরও বয়স ষাটের কোঠায়।
তাঁর দল আলোচনায় মোকাবিলা করবে সমবয়সী সাবেক গোয়েন্দা মোহাম্মদ মাসুমের নেতৃত্বে ২০ সদস্যের আফগান আলোচক দলকে। দোহায় ওই আলোচনাকক্ষের আশপাশেই পাওয়া যাবে ইরান, রাশিয়া, পাকিস্তান এবং ভারতের অঘোষিত প্রতিনিধিদেরও। যুদ্ধের মতো শান্তিতেও আফগানিস্তানে এদের সবার গভীর স্বার্থ আছে। আর যুক্তরাষ্ট্র তো থাকছেই। সর্বাধুনিক অস্ত্র তাদের জেতাতে পারেনি আফগানিস্তানে। মুখরক্ষার জন্য তাই এখন শান্তির আড়াল দরকার। এ যুদ্ধে তাদের খরচ হয়েছে এরই মধ্যে ৮০০ বিলিয়ন ডলার।
যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে তারা এখন যে ছাড় পাচ্ছে, সেটা নভেম্বরের পর একই রকম না-ও পেতে পারে। ফলে নভেম্বরের আগেই শান্তি আলোচনাকে এক ধাপ এগিয়ে নিতে না পারলে পুরো বিষয়টি দীর্ঘ সময়ের জন্য ঝুলে যাবে
১৯ বছরের আফগান যুদ্ধে সরকারি হিসাবে বেসামরিক মানুষ মারা গেছে ৪৩ হাজার। এটা প্রত্যক্ষ সংঘাতের সরকারি হিসাব। বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি। যুদ্ধের পরোক্ষ কারণে নিহত মানুষের সংখ্যাও বিপুল। আফগান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, দীর্ঘ যুদ্ধে দুই-তৃতীয়াংশ নাগরিকই মানসিকভাবে অসুস্থ। প্রান্তিক অঞ্চলে স্বাস্থ্যব্যবস্থা অকার্যকর। অবকাঠামো বিপর্যস্ত। বিশুদ্ধ পানি ও পুষ্টির অভাবে মরছে মানুষ। ১০ লাখ আফগান দেশের ভেতরে উদ্বাস্তু। আরও ২৫ লাখ আছে আশপাশের দেশে।
এ রকম একটি সমাজ যে যুদ্ধ থেকে মুক্তি পেতে মরিয়া হবে, সেটাই স্বাভাবিক। তালেবান তৃণমূলের দল; জনগণের আকাঙ্ক্ষা না বোঝার কথা নয়। ফলে ‘দখলদার শক্তি’ হলেও ন্যাটোর সঙ্গে আলোচনায় বসেছে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি যে চুক্তি করেছে, তার ধারাবাহিকতায় এখন তাদের বসতে হয়েছে ন্যাটোর গড়া আফগান সরকারের সঙ্গে, যে সরকারের বৈধতাই একসময় তারা স্বীকার করত না।
আফগান সরকার ইতিমধ্যে পাঁচ হাজার তালেবান বন্দীকে মুক্তি দিয়েছে। তালেবানও তাদের হাতে আটক এক হাজার সরকারপন্থীকে ছেড়েছে। তবে উভয় পক্ষের জন্য মূল পরীক্ষা অপেক্ষা করছে সামনে। দোহা বৈঠকে ফয়সালা হবে কীভাবে তালেবানকে সঙ্গে নিয়ে বর্তমান সরকারের শরিকেরা একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করতে পারে। কীভাবে ভবিষ্যতে দেশটি শাসিত হবে। তারও আগে ঠিক করতে হবে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির শর্ত। ভবিষ্যতে তালেবান যোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পণও এক স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ।
এসব ছাপিয়ে অবশ্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এখন প্রধান আলোচনা চলছে ভবিষ্যৎ আফগানিস্তানে তালেবানের নারীনীতি নিয়ে। তালেবান নারীশিক্ষা নিয়ে অতি রক্ষণশীল ছিল; এবার তাতে ছাড় না দিয়ে উপায় থাকবে না। কিন্তু এ বিষয়ে আপস করামাত্র মাঠপর্যায়ে কট্টর কর্মীদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। দোহায় তালেবান আলোচকেরা ইঙ্গিত দিচ্ছেন, প্রেসিডেন্ট ও প্রধান বিচারপতির পদ ছাড়া অন্যান্য জায়গায় নারীদের দেখতে আপত্তি থাকবে না।
হাজারা, তাজিক, উজবেকসহ দেশটির সংখ্যালঘু জাতিসত্তাগুলোকে ক্ষমতাকাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে এক বড় চ্যালেঞ্জ। তালেবান পুরো দল পশতু প্রভাবিত। পশতুদের সঙ্গে হাজারা ও উজবেকদের সম্পর্ক সংঘাতময়। গত ১৯ বছরে ন্যাটো বাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় থেকে হাজারা, উজবেক ও তাজিকরা তাদের এলাকায় যে স্বায়ত্তশাসন ভোগ করেছে, তালেবানরা সেখানে আর হাত দিতে পারবে বলে মনে হয় না।
ভবিষ্যতের আফগানিস্তানে পাকিস্তান ও ভারতের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষাও তালেবানের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে। কাবুলের বর্তমান সরকারে ভারতের স্পষ্ট প্রভাব দেখা যায়, যা ইসলামাবাদের জন্য অসহনীয়। তালেবানকে সামনে রেখে পাকিস্তান চাইবে ভবিষ্যতের আফগানিস্তানে ভারতকে কোণঠাসা করতে। এ টানাপোড়েনে ভারসাম্য রাখা তালেবান নেতৃত্বের জন্য কঠিন হবে।
দোহা আলোচনায় তালেবানের মতোই জটিল অবস্থা তৈরি হয়েছে আফগান সরকারের জন্যও। এ সরকারে আছে অনেক উপদল। তালেবানকে ছাড় দেওয়ার সীমা নিয়ে সরকারের ভেতর রয়েছে অনেক মতভিন্নতা। এ দূরত্ব সামলাতে যুক্তরাষ্ট্রকে বারবার হস্তক্ষেপ করতে হবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিবিদদের জন্য চ্যালেঞ্জটি ভিন্ন। ট্রাম্পের স্বার্থে আগামী নভেম্বরের আগেই দোহা আলোচনা থেকে কিছু সুনির্দিষ্ট সফলতা বের করে আনতে হবে তাদের, যা ট্রাম্পকে নির্বাচনী যুদ্ধের প্রচারণায় এগিয়ে রাখবে। ট্রাম্প দেখাতে চাইছেন, দেশকে ১৯ বছরের যুদ্ধ থেকে মুক্তি দিচ্ছেন তিনি।
তালেবানের এ পরিস্থিতি অবোধগম্য নয়। তারা যে আপাতত ট্রাম্পের জন্য দোহায় আছে, সেটা গোপন নেই। এ অবস্থায় ঝুঁকি আছে। যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে তারা এখন যে ছাড় পাচ্ছে, সেটা নভেম্বরের পর একই রকম না-ও পেতে পারে। ফলে নভেম্বরের আগেই শান্তি আলোচনাকে এক ধাপ এগিয়ে নিতে না পারলে পুরো বিষয়টি দীর্ঘ সময়ের জন্য ঝুলে যাবে। এ জন্য তালেবানেরও বড় আকারে ছাড় দেওয়া জরুরি। কিন্তু তার সুযোগ নিতে পারে আফগান-আইএস। এমনকি তালেবানের মধ্যে আরও উগ্র উপদল তৈরি হতে পারে সমঝোতার বিরোধিতা করে।
● আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক
Leave a Reply