ভয় একটি ভয়ানক রোগ। এ রোগে আমরা সবাই কমবেশি আক্রান্ত। এ রোগ যদি একবার কাউকে পেয়ে বসে তবে তার জীবন থেকে শান্তি ও স্বস্তি বিদায় নেয়। এমন কি বিচার-বুদ্ধিও। কোনো কাজেই তার মন বসে না। জীবন হয়ে পড়ে বন্ধ্যা-নিষ্ফলা এবং অর্থহীন। মানুষের মনে ভয় বিনা কারণে জাগে না। এর একটা কার্যকারণ সম্পর্ক তো নিশ্চয়ই আছে। কোনো দেশে বিরাজমান সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতি এবং দেশের জনগণের প্রতি শাসক শ্রেণীর আচরণ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণ ইতিবাচক না হলে মনে যেমন ভয়ের উদ্রেক ঘটে; ঠিক তেমনি তা অনুকূল হলে নির্ভয় জীবন যাপনের আশ্বাস দেয়। রাজ ভয়ে লোকজন অতীতে যেমন ঠিক তেমনি আজো দেশ ছাড়ছে। ব্যাপারটি একটি প্রাচীন চীনা গল্প দিয়ে ব্যাখ্যা করছি।
এক বন্যপ্রাণী শিকারি গভীর অরণ্যে প্রবেশ করে দেখেন, এক নিঃসঙ্গ মধ্যবয়সী মহিলা বিলাপ করছেন। শিকারি তাকে জিজ্ঞেস করেন- ‘তুমি কাঁদছ কেন’? মহিলা উত্তরে বলল- ‘আমি আমার স্বামী ও দুই সন্তানকে নিয়ে এই গহীন অরণ্যকে নিরাপদ আশ্রয় ভেবে এখানে এসেছিলাম। তিন দিন আগে বাঘ এসে আমার এক সন্তানকে খেয়ে ফেলে। এর পর দিন আমার আরেক সন্তানকে। এর পর দিন গতকাল আমার স্বামীকে। আজ বাঘ এসে আমকে খেয়ে ফেলবে। সেই ভয়ে কাঁদছি’। শিকারি বলল, ‘তুমি লোকালয়ে ফিরে যাচ্ছ না কেন’? মহিলা ভয়ে শিউরে উঠে বলল, ‘আরে বাপরে বাপ! এখানে বাঘ এসে আমার দুই সন্তানকে এক এক করে দু’জনকে দু’দিনে এবং আমার স্বামীকে কাল এসে খেয়ে ফেলল। বনের হিংস্র বাঘ এই তিন দিনে তিনজনকে গিলে খেয়েছে। আজ আমাকে খাবে। এই নিয়ে চারজনকে চার দিনে খাবে। লোকালয়ে যে স্বৈরশাসক ক্ষমতায়, সে এক দিনেই আমাদের চারজনকে সাবাড় করত। তাই সেখানে যাবো না’। লোকালয়ের স্বৈরশাসক বনের বাঘের চেয়েও ভয়ঙ্কর। মহিলা এটাই বোঝাতে চাইলেন।
ইতিহাস ঘাঁটলে এ ধরনের হত্যার নজির আমাদের দেশেও খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কথা কমবেশি সবারই জানা। সেদিন ভোরে রচিত হলো একটি স্বাধীন দেশে একটি বিখ্যাত পরিবারকে নিশ্চিহ্নহ্নহ্নহ্ন করে দেয়ার ইতিহাস। পরিবারটি ছিল সে সময়ের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের। রাষ্ট্রপতি ও তার ১০ বছরের শিশুপুত্রসহ প্রায় সবাই সে রাতে নিহত হন। প্রাণে বেঁচে যান রাষ্ট্রপতির দুই কন্যা যারা তখন বিদেশে ছিলেন। দেশে থাকলে তারাও নিহত হতেন। উপর্যুক্ত চীনা গল্পটির সাথে এই ঘটনার তফাত এই যে, চীনা গল্পটিতে আছে সাধারণ মানুষের কথা এবং এখানে আছে ক্ষমতাসীন এক সরকারপ্রধান ও তার পরিবারের কথা।
স্মর্তব্য, চিলির প্রেসিডেন্ট আলেন্দে ক্ষমতাসীন অবস্থায় নিজ অফিসের চেয়ারে বসে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র পিনোশেটের লেলিয়ে দেয়া সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্কের গোলার আঘাতে নিরস্ত্র অবস্থায় নিহত হন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিহত হয়েছেন তার দেহরক্ষীদের গুলিতে। মধ্যপ্রাচ্যের লিবিয়া, ইরাক, মিসরসহ কয়েকটি দেশের নাম উল্লেøখ করা যায় যেখানে যুক্তরাষ্ট্র সেসব দেশের রাষ্ট্রনায়কদের ও নাগরিকদের নির্বিচারে হত্যা করেছে। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যসহ সারা দুনিয়ায় ভয় এবং ‘ভাইস ভার্সা’।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড একটি স্বাধীন দেশের জনমনে ভয়ের আবহ সৃষ্টি করেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জানান দিলো, এ দেশে রাষ্ট্রপতি ও তার ১০ বছর বয়সী শিশু সন্তানের মতো নাগরিকদেরও নিরাপত্তা নেই। সাধারণ লোক যারা প্রতিনিয়ত নিরাপত্তার অভাবে এবং কোন্দলপ্রিয় মানুষের স্বভাবের কারণে নিহত হচ্ছেন তাদের কথা নাইবা তুললাম। এরপর এলো ১৯৮১ সালের ৩০ মে’র ঘটনা- দেশের আরেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হলেন চট্টগ্রামে। এভাবে এ দেশে একটি ভয়ের আবহ ঘনীভূত হয়। যে দেশে রাষ্ট্রপতির ১০ বছরের শিশুসন্তানের নিরাপত্তা নেই, সে দেশে এক রাষ্ট্রপতির জীবনের নিরাপত্তা কোথায়? সে দেশের সাধারণ মানুষেরই বা জীবনের নিরাপত্তা কোথায়? সে দেশে কারো প্রতি কারো কোনো মায়া মমতা আছে বলে মনে হয় না। দেশে ভয়যুক্ত একটি ইনডিভিজ্যুয়ালিস্টিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠছে- যে দেশে কারো প্রতি কারো শ্রদ্ধা নেই, ভক্তি নেই। সে দেশে কারো প্রতি কারো কোনো প্রেম নেই, প্রীতি নেই, ভালোবাসা নেই। যেখানে রাজনৈতিক মানুষের হৃদয়ে শুধুই আছে ঘৃণা-বিদ্বেষ আর অর্থলিপ্সু চোখের হিস্রতা, সেখানে সাধারণ মানুষের জীবনের দাম কোথায়? ভয়ে লোকজন দেশ ছাড়ছে। এর সবই সেই ভয়েরই আবহের কার্যকারণের ফল। সব কিছুই যেন লাভ-লোকসানের নিক্তিতে মাপা লেনদেন।
একটি প্রবাদবাক্য এরূপ- ‘প্রীতির সম্পর্ক উবে গেলে জেগে ওঠে ভীতির সম্পর্ক’। এই পাপপঙ্কিল পৃথিবীতে আজ চলছে ভঙ্গুর ভালোবাসা আর বিশ্বাসের ভিতের ওপর পণ্য উৎপাদন ও পণ্য বিপণনের সম্পর্কের খেলা। মুহূর্তেই জেগে ওঠে মুনাফা বণ্টনের ভিতের ওপর পারস্পরিক অবিশ্বাস; পরে পারস্পরিক কলহ, একে অপরকে ঠকিয়ে জেতার হীন চক্রান্ত, খুন, গুম জাতীয় ঘটনা। এটা রূপকার্থে বা বাস্তবিক অর্থেই হোক- ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে, পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে কিংবা রাজনীতির ক্ষেত্রেই হোক না কেন, সর্বত্রই জেগে ওঠে ভয়। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে চায় না।
পারস্পরিক সম্পর্কের উষ্ণ সাগরে ভেসে উঠে হিম-শীতল সম্পর্কের আইসবার্গ। সে পরিস্থিতিতে আক্ষেপ করে প্রায় সবাই বলতে বাধ্য হয়, ‘সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু, অনলে পুড়িয়া গেল/ অমিয় সাগরে সিনান করিতে সকলই গরল ভেল’। তখন একে অপরকে আর প্রীতির চোখে দেখে না, ভীতির চোখে দেখে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতির ক্ষেত্রে এ এক অমোঘ সত্য। নইলে দেশে এত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন আর রাহাজানি কেন? অন্তত যদি দেশের বর্তমান আইন-কানুনেও বিচার থাকত, মানুষে মানুষে সম্প্রীতির ভাব থাকত, তবে এমনটা হতো না। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এ পৃথিবীতে এটাই মানুষের বিধিলিপি। ভয় আর ভয়। হারানোর ভয়। না পাওয়ার ভয়, পেয়ে হারানোর ভয় এবং আমরা সবাই এই বস্তুগত সমাজে ভীতু। এ ভয় থেকেই একেশ্বরবাদী রবিঠাকুর লিখেছেন ‘ওরে ভীরু, তোমার হাতে নেই ভুবনের ভার’। সত্যি, আজ আর মানুষের হাতে ভুবনের ভার নেই, আছে দানবের হাতে।
এ ভয় থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আপদমস্তক অস্ত্রে সজ্জিত। চীন ও পাশ্চাত্যের দেশগুলোও দু’একটি ব্যতিক্রম বাদে তাই। এশিয়ার জাপানও প্রায় তেমনই একটি ব্যতিক্রম। পাঁচ বছর স্থায়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ সময়ের দিকে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে যুক্তরাষ্ট্রের পৃথক দু’টো পারমাণবিক বোমার আঘাতে শহর দু’টি প্রায় ধ্বংস হয়ে গেলে জাপান তো বটেই, সমগ্র বিশ্বও তাতে প্রচন্ড আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। ১৯৬২ সালে কিউবা সঙ্কটকালে সোভিয়েত ও যুক্তরাষ্ট্র, এই দেশ দু’টি পারমাণবিক যুদ্ধের মুখোমুখি হয়ে পড়ে। এটা দেখে ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল তখন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ ও মার্কিন নেতা জন এফ কেনেডির কাছে কয়েকটি চিঠি লিখেছিলেন। শান্তির পক্ষের রাসেলের সেই ডাকে সোভিয়েত নেতা সাড়া দিয়ে যুদ্ধ থেকে পিছু সরে আসেন। ফলে পৃথিবী একটি ভয়ানক যুদ্ধ থেকে রেহাই পায়। এ সংক্রান্ত তথ্য রাসেলের ‘আনআর্মড ভিক্ট্র’ পুস্তকে বিস্তৃতরূপে পাওয়া যায়। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত সীমান্তবিরোধ নিয়ে দু’টি দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। আজ দুনিয়াজুড়ে সর্বত্রই ভয়ের ভিতের ওপর গড়ে উঠেছে ‘সমরাস্ত্রের কুতুবমিনার’। ভয় শুধু ভয়, কে কাকে কখন আক্রমণ করে বসে; কে কাকে অস্ত্রের প্রতিযেগিতায় পরাজিত করে ফেলে। সে ভয়- এক অন্তহীন ভয়।
এ ছাড়াও ভয় লুকিয়ে আছে আমাদের প্রতিদিনের খাবারে। কোন পণ্যটি আছে এ দেশের বাজারে, যাতে ভেজাল নেই? বোতলজাত খাবার পানি থেকে শুরু করে মাছ-তরকারি-ফলমূল, কোনোটাই ভেজালমুক্ত নয়। প্রতিদিন আমরা জেনে হোক আর না জেনেই হোক, এসব খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করছি; তাতে বাড়ছে অকালে মৃত্যুর ভয়। নগরে-বন্দরে ইমারত গড়ছি ঠাসাঠাসি করে। নির্মাণসামগ্রী যে নির্ভেজাল সে নিশ্চয়তা কে দেবে? সঠিক নির্মাণ কোড মেনে এসব তৈরি হচ্ছে, তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়? লোকে পথ চলছে আন্তঃজেলা বাসে বা লঞ্চে চড়ে বা ট্রেনে। যথাসময়ে বা অক্ষত অবস্থায় কিংবা জীবিত অবস্থায় গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে তো যাত্রীরা? সবখানেই উঁকি দিয়ে আছে ভয়। কোথায় ভয় নেই? ঈদের আনন্দযাত্রায়ও ভয়।
রোগ-শোকে পড়লে ভয়- ডাক্তার সুচিকিৎসা দেবেন তো? নাকি রোগী ধরে রাখার ফন্দি আঁটবেন? ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পী নচিকেতা তো এ প্রসঙ্গে একটি বাস্তবভিত্তিক গানই ফেঁদেছেন- ‘ও ডাক্তার’। ভয় জাগে, বার্ধক্যে পৌঁছলে যখন নিজে রোজগার করার সামর্থ্য থাকবে না, তখন সন্তান সন্ততিরা লালনপালনের ভার বইবে তো? নাকি নাতি-নাতনি ও সন্তানরা বৃদ্ধাশ্রমের নিরানন্দ ও নিস্তরঙ্গ জীবনের দিকে ঠেলে দিয়ে ‘দায় সারবে’? এখানেও ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পী নচিকেতার ‘বৃদ্ধাশ্রম’ গানটির কথা মনে পড়ে। এ জাতীয় নানা প্রকার ভয় নিয়েই আমাদের জীবন।
আরো আছে পরকালের ভয়। বার্ধক্যে পৌঁছলে মনে জাগে ভয়, পারলৌকিক পাথেয় সঞ্চয় করেছি তো? নাকি হাবিয়াহ বা রৌরব নরকই হবে শেষ ঠিকানা? সীমিত সময়ের এ পৃথিবী ছেড়ে সেখানে অনন্তকাল কাটাতে হবে। তবে বিধাতার আশ্বাস, সব ভয় ছেড়ে দিয়ে ‘কেবল আমাকে ভয় করো’; তাতেই সর্বকালের তথা ইহকাল-পরকালের যাবতীয় ভয় থেকে মুক্তি। নাস্তিকদের অবশ্য ইহলৌকিক ভয় থাকলেও পারলৌকিক ভয় নেই। কারণ তারা পরকালে বিশ্বাসীই নয়! আমরা আস্তিকরা প্রায় সবাই ইহকাল ও পরকালের ভয়ে চিড়েচ্যাপ্টা। বার্ধক্যে পৌঁছে তাই মনে হয়। আরেকটি ভয় হলো অজ্ঞতাকে ভয়। অজ্ঞ লোকেরা সাধারণত দাম্ভিক ও কূটতার্কিক হয়ে থাকে। এদেরও ভয় করে চলতে হয়। সর্বত্রই ভয় আর ভয়।
লেখক : অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবং ভাইস প্রিন্সিপাল, কুমিল্লা মহিলা সরকারি কলেজ
Leave a Reply