এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ১১টি নির্বাচন কমিশন সংবিধানের ১১৮–এ অনুযায়ী পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য নিয়োজিত হয়েছে। যার মধ্যে তিনটি কমিশন ছাড়া বাকি আটটি কমিশন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে একটি আবু সাঈদের নেতৃত্বের নির্বাচন কমিশন তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল কর্তৃক নিয়োজিত হলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে। পরবর্তী সময়ে অন্য দল ক্ষমতায় এলে পরবর্তী নির্বাচনগুলো কমিশন নিজস্ব গুণে গ্রহণযোগ্য করতে পেরেছিল।
উপরিউক্ত চারটি নির্বাচন কমিশন ছাড়া বাদবাকি নির্বাচন কমিশন নিজেদের অসহায়ত্বের কারণে জনগণের অনাস্থাভাজন প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছিল। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ অন্তত জনমনে, বিচারপতি আজিজ এবং হালের দুটি নির্বাচন কমিশন। বিচারপতি আজিজের নেতৃত্বে কমিশন কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারেনি, নানাবিধ কারণে জনগণের আস্থা হারিয়ে এক করুণ পরিস্থিতিতে বিদায় নিতে হয়েছিল। যা বহুল আলোচিত দশম কমিশনের ক্ষেত্রে হয়নি। আর বর্তমান কমিশনও পাঁচ বছর, মানে পূর্ণ সময় পার করার পথে।
২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত যে দুটি কমিশন গঠিত হয়েছিল দলীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে, তারাও জনগণের আস্থা ধরে তো রাখতে পারেনি বরং উল্টো নানাবিধ কর্মকাণ্ডের জন্য প্রতিনিয়ত বিতর্কিত হয়েছে এবং হচ্ছে। ২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়ে যত কম বলা যায়, ততই ভালো। এই নির্বাচন এবং পরবর্তী সময়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোর প্রেক্ষাপটে জনমনে নির্বাচন নিয়ে একধরনের নেতিবাচক মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছিল, যা একেবারে শূন্যের কোঠায় নেমেছে ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর। বলা নিষ্প্রয়োজন যে এরপর থেকে আজ পর্যন্ত যত নির্বাচন হয়েছে, তাতে এ দেশের একসময়কার অতি উৎসাহিত ভোটাররা গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় নির্বাচন নিয়ে কোনো ধরনের আগ্রহ প্রকাশ করছেন না। এমনকি কবে কোথায় নির্বাচন, তাতে কী ফলাফল, এসব নিয়ে সাধারণ জনগণ মাথা ঘামায় বলে মনে হয় না।
বর্তমানের নির্বাচন কমিশনের নানাবিধ অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ডের কারণে প্রতিনিয়তই নাগরিক সমাজ নানা ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য বিশ্লেষণ ও যে ধরনের বক্তব্য রাখেন, তা রাষ্ট্রের একটি অন্যতম স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের জন্য সুখকর নয়। বেশির ভাগ সময় এর জন্য দায়ী খোদ নির্বাচন কমিশন। হয়তো তারা ভুলে গেছে যে নির্বাচন কমিশন জনগণের কাছে, বিশেষ করে ভোটার এবং রাজনৈতিক দলের এবং গণতান্ত্রিক সমাজের কাছে দায়বদ্ধ। কাজেই তাদের কর্মকাণ্ড জনগণের নজরদারিতে থাকবেই। সে কারণেই বর্তমান প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশনকে স্বচ্ছ হতেই হবে।
যেখানে নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করার জন্য ২০১০-১১ সালে ওই সময়কার কমিশন যেসব সুপারিশ রেখে এসেছিল, সেগুলোর ধারেকাছে এর আগের কমিশন যেমন যায়নি, তেমনি এই কমিশন হয়তো পাতাও উল্টিয়ে দেখেনি। বর্তমান নির্বাচন কমিশন ওই পথে হাঁটলে অন্তত কিছু ইতিবাচক ভাবমূর্তি রাখতে পারত একই সঙ্গে আগামী কমিশনের জন্য আরও কার্যকর নির্বাচনী আইন রেখে যেতে পারত। যদিও আইনি সুপারিশ কমিশন করতে পারে, তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সরকারের তথাপি এসব সুপারিশ নির্বাচন কমিশন কর্তৃক উত্থাপিত হলে সরকারের এবং সংসদের পক্ষে পাশ কাটানো কঠিন হতো। এসব ইতিবাচক সংস্কার নিয়ে শরিক এবং নাগরিক সমাজের সঙ্গে আলোচনা করলে সরকারের ওপর একধরনের চাপ সৃষ্টি হতো। আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা বলে, নির্বাচন কমিশনের ইতিবাচক সুপারিশ অতীতে কোনো সরকার সহজে নাকচ করতে পারেনি, অবশ্য যদি তাতে কমিশনের শরিকদের আস্থায় আনা যায়।
মালয়েশিয়ার কমিশন যেসব বিষয়ে সংস্কারের সুপারিশ করেছে, তা ২০১১ সালে ওই সময়কার নির্বাচন কমিশন তাদের সুপারিশমালায় করেছিল। এসব সুপারিশের মূলে ছিল সংবিধানের ১৮ ধারায় বর্ণিত কমিশন গঠনের জন্য একটি কার্যকরী আইন তৈরীকরণ। এর নিমিত্তে একটি খসড়াও সরকারকে দেওয়া হয়েছিল। সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে ছিল নির্বাচনী ব্যয় মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা, নির্বাচনকালে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এসবই লিপিবদ্ধ করা রয়েছে এবং এসব শরিকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়েছিল।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন যদি কিছু ইতিবাচক সংস্কারের চিন্তা করে, তবে আমি মনে করি, এসব অযৌক্তিক এবং এখতিয়ারবহির্ভূত সুপারিশ যা নির্বাচন কমিশনকে দুর্বল করবে, সেগুলো বাদ দিয়ে ইতিবাচক নির্বাচনকে স্বচ্ছ করার জন্য হাতকে শক্তিশালী করবে, সে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
এসব সুপারিশ এর আগে বহুবার করা হয়েছে। তবে পুনরাবৃত্তি করার উদ্দেশ্য যে যাতে নির্বাচন কমিশন তাদের মেয়াদ শেষ করার আগে কিছু ইতিবাচক স্বাক্ষর রেখে যেতে পারে। মনে রাখতে হবে যে আমাদের মতো দেশে যেখানে রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিম্নমুখী, সেখানে একা নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। তবে নির্বাচন কমিশন তার প্রয়াসকে স্বচ্ছ করার অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে পারে। সে কারণেই নির্বাচন কমিশনকে স্বচ্ছ হতে হবে। ক্ষমতা খর্ব করে নয়, ক্ষমতার প্রয়োগ কাম্য। অন্যথায় ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)
Leave a Reply