চারদিকে কেবল দুঃসংবাদ। ভেবেছিলাম, অনাহূত ও অবাঞ্ছিত অতিথি করোনাভাইরাস চলে যাবে। ছয় মাস হয়ে গেল। সে এখনো জগদ্দল পাথরের মতো চেপে আছে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী কেউ আক্রান্ত হতে বাকি নেই। সুস্থ হয়েছেন অনেকেই, আবার সুস্থ হলেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া রয়ে গেছে কারও কারও। আর কেউ কেউ মৃত্যুবরণও করেছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন বরেণ্য ব্যক্তিরা, মুক্তিযোদ্ধা ও কাছের মানুষ। সে তালিকা বেশ দীর্ঘ। কাকে বাদ দিয়ে কার কথা লিখি!
স্বাস্থ্য খাত ছাড়াও বেকারত্ব, আয় হ্রাস, ব্যয় বৃদ্ধি ঘরে ঘরে। আমি সামান্য কিছু সেবাকাজের সঙ্গে জড়িত। সাহায্যপ্রার্থীর সংখ্যা আমাদের সামর্থ্যের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। তাই লজ্জায় সংকুচিত হই। কাকে ফেলে কার দিকে সাহায্যের হাত বাড়াই! মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির ভৌতিক বিল; তিতাস, ওয়াসা, ডেসকোর সংযোগবিচ্ছিন্ন করার হুমকি। দুর্নীতি ও নির্মম হত্যার আজকে গড়া রেকর্ড কয়েক দিনের মধ্যে ভেঙে যাচ্ছে!
এর মধ্যেই দুঃসংবাদ এল, প্রতিবেশী ভারতের অর্থনীতি প্রথম প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) সংকুচিত হয়েছে ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ। গত বছর একই প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। অতি ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশের অর্থনীতির অভিঘাত থেকে বাংলাদেশ কি বিচ্ছিন্ন থাকতে পারবে? তাই মনটা দীর্ঘদিন থেকে সুসংবাদের জন্য অস্থির অপেক্ষায় ছিল। অবশেষে কয়েকটি সুসংবাদ পেলাম। প্রথমটি বিদেশি বার্তা সংস্থা এএফপির ব্যুরোপ্রধান প্রীতিভাজন শফিকুল আলমের কাছ থেকে। বাকি দুটো দেশের বাইরে থেকে।
আমরা বাংলাদেশের শিল্পপতি শামশুদ্দিন, ভারতের আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ ও মার্কিন ছাত্রটিকে টুপি খুলে অভিবাদন জানাতে পারি করোনার এ কঠিন দুঃসময়ে সুসংবাদের কারণ হওয়ার জন্য। করোনাভাইরাসের কার্যকর ভ্যাকসিন ও চিকিৎসা আবিষ্কৃত হোক। আবার সুসংবাদে ভরে উঠুক আমাদের দুনিয়া
আগেই জেনেছি, নামী ব্র্যান্ডগুলো তাদের কার্যাদেশ পুনর্বহাল করেছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, এর ফলে জুলাই মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা এক মাসে সর্বোচ্চ রপ্তানির রেকর্ড গড়েছে। গত বছর একই সময়ে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের এ জন্য অভিনন্দন।
কিন্তু আজকের বিষয় তা নয়। বরং কোভিডের এই দুঃসময়ে একজন তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকের সংবেদনশীলতার মানবিক কাহিনি ও আরও দুটি সমসাময়িক বীরত্ব ও কর্তব্যনিষ্ঠার ঘটনা নিয়েই আজকের এ লেখা।
কী করেছেন এই তৈরি পোশাকশিল্পের মালিক? ব্যক্তিগতভাবে আমার অপরিচিত, ৬৫ বছর বয়সী, এই শিল্পমালিকের নাম এ বি এম শামশুদ্দিন। তিনি হান্নান গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। এক মাস লকডাউনের পর গত ২৬ এপ্রিল যখন পোশাক কারখানাগুলো খোলা হয়, তখন তিনি গাজীপুর এলাকায় তাঁর কারখানার ১২ হাজার শ্রমিকের কোভিডের সঙ্গনিরোধকালীন অবস্থানের জন্য নয়টি ভবন ভাড়া করেন। তঁাদের মধ্যে কোভিডে আক্রান্ত বলে সন্দেহভাজন ১ হাজার ৩৫৭ শ্রমিককে (মোট শ্রমিক সংখ্যার প্রায় ১১ শতাংশ) সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন।
অন্য কারখানাগুলো যখন কোভিড সন্দেহযুক্ত শ্রমিকদের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়, তখন শামশুদ্দিন নিশ্চিত করেন যে তারা যাতে নিজের পরিবার ও এলাকাবাসীর মধ্যে ভাইরাসের সংক্রমণ না ঘটায়। তিনি প্রতিটি সন্দেহজনক শ্রমিককে ছয়জন ডাক্তার ও সমসংখ্যক নার্সের সহায়তায় বাছাই করেন। প্রত্যেক আক্রান্ত শ্রমিকের খাদ্য, চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় সব সামগ্রী, এমনকি তারা যাতে আদা, এলাচিযুক্ত গরম চা–পান করতে পারে, সে জন্য ফ্লাস্কের ব্যবস্থা করেন। প্রত্যেক শ্রমিককে শতভাগ বেতন ও ঈদ বোনাস দেওয়া হয়। তিনি সন্দেহভাজন সব শ্রমিকের জন্য কোভিড পরীক্ষার ব্যবস্থা করেন। আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত ১৪৩ জনের প্রত্যেকের জন্য ১৪ দিনের সঙ্গনিরোধ বাধ্যতামূলক করেন।
দুই মাস পর শ্রমিকদের সবাই করোনামুক্ত হয়ে কাজে যোগ দিয়েছে। এই সেবা দিতে তাঁর দুই কোটি টাকা খরচ এবং ফিল্ড হাসপাতাল পরিচালনা করতে হয়েছে। সাংবাদিক শফিককে তিনি বলেন, এটা ছিল অনেকটা মুক্তিযুদ্ধের মতো। উল্লেখ্য, ১৫ বছরের যুবক শামশুদ্দিন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য মেজর হায়দারের কাছে যান। মেজর হায়দার বয়স কম হওয়ার কারণে তঁাকে ফিরিয়ে দেন। শ্রমিকেরাও তাঁর ভালোবাসার প্রতিদান দিয়েছে। এখন তাঁর কারখানায় পুরোদমে কাজ চলছে। এমনকি নতুন কার্যাদেশ বাস্তবায়নের জন্য ১ হাজার ৫৯৫ জন নতুন শ্রমিক নিয়োগ দিয়েছেন।
পরিতৃপ্তির হাসি দিয়ে সাংবাদিক শফিককে তিনি আরও বলেন, ‘জীবনে একবার ঘটে এমন অভিজ্ঞতা। যখন আমার বন্ধুরা নিজেদের ঘরে আবদ্ধ করেছেন, আমি তখন একটা যুদ্ধের মধ্যে ছিলাম। আল্লাহর রহমতে আমরা যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছি। আমাদের শ্রমিকদের কেউ মারা যায়নি বা চাকরি হারায়নি।’
এটাই বোধ হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা। আমরা দেখতে পাচ্ছি, সব পোশাক কারখানার মালিকই শোষক নন। তবে শামশুদ্দিনের মতো শিল্পপতির সংখ্যা খুবই কম। প্রার্থনা করি, তাঁদের সংখ্যা বাড়ুক।
দ্বিতীয় সুসংবাদটি এসেছে ভারত থেকে। সেখানকার বিশিষ্ট আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণের বিরুদ্ধে প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্ট সম্পর্কে টুইটারে বিরূপ মন্তব্যের জন্য মানহানির মামলা হয়। সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে বলেন। তিনি ক্ষমা চাইতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, তিনি যা সত্য বলে বিশ্বাস করেন, তাই মন্তব্য করেছেন। এ অবস্থায় আদালতের কাছে তাঁর ক্ষমাপ্রার্থনা হবে কপট এবং তা করলে তিনি নিজের বিবেকের অবমাননা করবেন। তিনি ক্ষমাপ্রার্থনার পরিবর্তে আদালতের দেওয়া শাস্তি মাথা পেতে গ্রহণ করবেন। উল্লেখ্য, ভারতের অ্যাটর্নি জেনারেল ভেনুগোপাল প্রশান্ত ভূষণকে শাস্তি না দেওয়ার জন্য আদালতকে অনুরোধ করেন। সুপ্রিম কোর্ট রায়ে প্রশান্ত ভূষণকে এক ভারতীয় রুপি জরিমানা করেন ও অনাদায়ে তিন মাসের জেল ও সুপ্রিম কোর্টে আইন ব্যবসা করতে পারবেন না, এ আদেশ দেন। জরিমানা অনাদায়ে শাস্তির শেষ অংশটুকু না থাকলে ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের সম্মান বাড়ত।
সর্বশেষ সংবাদ অনুযায়ী প্রশান্ত ভূষণ আদালতের নির্দেশের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে এক ভারতীয় রুপি জরিমানা পরিশোধ করেছেন। আইনের সেবক প্রশান্ত ভূষণের প্রতি শ্রদ্ধা।
আমার এক মার্কিনি ছাত্র আমি কেমন আছি, বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি কেমন, তা জানতে ফোন করেছিল। কথায় কথায় তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কে জিতবে বলে সে মনে করে। কাকে সে ভোট দেবে তা কিন্তু আমি জানতে চাইনি। তার জবাব, ‘আমার কোনো ধারণা নেই। তা ছাড়া ফেডারেল সরকারের কর্মকর্তা হিসেবে আমি এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে পারি না। আমি কেবল চাই শান্তিপূর্ণ, স্বচ্ছ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হোক।’ একজন প্রকৃত সরকারি কর্মকর্তার মতো জবাব।
মাঝেমধ্যে আমার ছাত্ররা এমন একটা কিছু করে বা বলে যা আমাকে অবাক করে। আমি আপ্লুত হই।
আর আমাদের সরকারি কর্মকর্তারা ভোট কারচুপিতে সহায়তা করেন। আমাদের একেকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যতটা না দক্ষ পেশাজীবী, তার চেয়ে বড় রাজনীতিবিদ। এমনটি তো হওয়ার কথা ছিল না। কেন এমন হলো?
সে যা–ই হোক না কেন, আমরা বাংলাদেশের শিল্পপতি শামশুদ্দিন, ভারতের আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ ও মার্কিন ছাত্রটিকে টুপি খুলে অভিবাদন জানাতে পারি করোনার এ কঠিন দুঃসময়ে সুসংবাদের কারণ হওয়ার জন্য। করোনাভাইরাসের কার্যকর ভ্যাকসিন ও চিকিৎসা আবিষ্কৃত হোক। আবার সুসংবাদে ভরে উঠুক আমাদের দুনিয়া।
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও অধ্যাপক
Leave a Reply