‘আগস্ট’ বাঙালির আবেগাপ্লুত হওয়ার মাস। এ মাসে গোটা জাতি দুঃখ-ভারাক্রান্ত মনে স্মরণ করে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। মাত্র ৫৫ বছর বয়সে যিনি এনে দিয়েছিলেন স্বাধীনতা। বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বাঙালির হাজার বছরের লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত মর্যাদাকর জাতিসত্তা।
শুধু প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেই মহামানবকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে মানুষরূপী হায়েনার দল। নজিরবিহীন ওই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গোটা বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে যায়।
২৯ বছর পর আবার সেই একই প্রতিহিংসায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট অপশক্তি হামলা চালায় বঙ্গবন্ধুকন্যা আজকের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য। গোটা বিশ্ব আবারও স্তম্ভিত হয়। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন মানুষ প্রাণ হারায়। আহত হয় ৩ শতাধিক লোক। দলীয় নেতাকর্মীরা ‘মানবঢাল’ তৈরি করে ঘিরে রেখেছিল বলে প্রাণে রক্ষা পান বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। বেঁচে যায় বাংলাদেশ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশবিশেষকে ব্যবহার করে সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যা করা হলেও ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকেই ঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ করানো হয়। সরকারের শীর্ষ মহল থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের বাছাই করা ঘাতকরা শেখ হাসিনাকে হত্যা করার উদ্যোগ নিয়ে মাঠে নামে। সবাই জানে, যে কোনো হত্যাকাণ্ডের তিনটি ধাপ থাকে। প্রথম ধাপে হয় হত্যার পরিকল্পনা।
কখন, কোথায়, কীভাবে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত করা হবে। দ্বিতীয় ধাপে থাকে ঘাতক নির্বাচন। কারা হত্যাকাণ্ডে অংশ নেবে এবং কীভাবে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত করবে। তৃতীয় ধাপে থাকে হত্যাকারী ও পরিকল্পনাকারীদের কীভাবে রক্ষা করা হবে; কী প্রক্রিয়ায় খুনিদের আইনি ও সামাজিকভাবে দায়মুক্ত করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা হবে ইত্যাদি।
ইতিহাসের নানা ঘটনা সাক্ষ্য দেয়, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য নানা ধরনের পরিকল্পনা শুরু করে। তখনকার দিনের বাস্তবতায় নিজেদের ‘গা’ বাঁচিয়ে বঙ্গবন্ধুকে শেষ করে দেয়ার জন্য আইনি প্রক্রিয়ায় একের পর এক মামলা দিয়ে সারাজীবন কারাগারে রেখে মেরে ফেলার বহু ফন্দি-ফিকির করেও শেষ পর্যন্ত রক্ষা হয়নি। কারণ, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিল সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও বাঙালি জাতিসত্তার ঘাতক-কুশীলবরা এদেশে বর্বরোচিত গণহত্যার নীলনকশা প্রণয়ন করে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করায়। কিন্তু তাতেও তারা সফল হয়নি। বঙ্গবন্ধুর ডাকে ৩০ লাখ বাঙালি বুকের তাজা রক্ত দিয়ে এবং ২ লাখ মা-বোন তাদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে। হত্যাকারী কুশীলবরা শেষ মুহূর্তে নিশ্চিত পরাজয় জেনেও প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে জাতিকে মেধাশূন্য করার জন্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে।
১৯৭২ সালের পর দেশে যা কিছু হওয়া যৌক্তিক ছিল, তার কিছুই হয়নি। বঙ্গবন্ধু সবাইকে নিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটাকে গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু তলে তলে কুশীলবরা ঠিকই তাদের কাজ করতে থাকে। দিনের পর দিন ‘শাঠ্য’ আর ‘ষড়যন্ত্রে’ লিপ্ত থেকে পরিকল্পনা করতে থাকে কীভাবে প্রতিশোধ নেবে। ওই ষড়যন্ত্রে যুক্ত হয় দেশ-বিদেশের অনেকে। কুশীলবরা তিনটি ধাপ অর্থাৎ হত্যার পরিকল্পনা, ঘাতক নির্বাচন এবং ঘাতকদের রক্ষার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বর্বরোচিতভাবে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রতিশোধ নেয়া হয়। ঘাতকচক্র বাংলাদেশকে চিরতরে পঙ্গু করে দেয়ার জন্য জাতীয় চার নেতাকেও হত্যা করে। অপরদিকে জিয়াউর রহমান খুনিদের রক্ষায় পদক্ষেপ নেন। খুনিদের বিচার চিরদিনের জন্য বন্ধ করতে ‘ইনডেমনিটি’ আইন করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ফলে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার কুশীলবরা তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী তৎপর হয়ে ওঠে।
জিয়ার পুরো শাসনামলে যুদ্ধাপরাধীদের রাজনৈতিক পুনর্বাসনসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে তাদের বসিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসকে ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত করার প্রয়াস চালানো হয়। ’৭১-র গণহত্যার দোসর থেকে শুরু করে রাজাকার-আলবদরদের সামাজিকভাবে পুনর্বাসনে সহায়তা করা হয়।
কিন্তু এতকিছু করেও তারা শেষ পর্যন্ত সন্তুষ্ট হতে পারেনি। ১৯৯৬ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতার ফিরে আসে। এতে শুরু হয় নতুন জাগরণ। তাতে কুশীলবদের কপালে ভাঁজ পড়ে। তারা আবার শুরু করে পরিকল্পনা। বঙ্গবন্ধু হত্যার টানা ২৯ বছর পর ২০০৪ সালের এই আগস্ট মাসে প্রকাশ্য দিবালোকে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য গ্রেনেড হামলা চালায়। এই ঘটনায় পরে মামলা হয়। পর্যায়ক্রমে ১৪ বছর ধরে মামলার কার্যক্রম সম্পন্ন করে শুনানি শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর আদালত ১৯ জনের ফাঁসি এবং ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন।
ইতোমধ্যে জজ মিয়া নাটকসহ কত ঘটনা-রটনার অবতারণা করা হয়, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা আপিল করে। সর্বশেষ গত ১৬ আগস্ট মামলার পেপারবুক হাইকোর্টে জমা হয়েছে। এখন শুরু হবে আপিল শুনানি। অ্যাটর্নি জেনারেল দাবি করেছেন, একটি বেঞ্চ গঠন করে যেন আপিল শুনানি দ্রুত নিষ্পত্তি করা হয়। শেষ পর্যন্ত কী হবে, আদালত সে সিদ্ধান্ত নেবেন।
আপিল শুনানি কতদিন ধরে চলবে, কে জানে। তবে অতীতের অভিজ্ঞতায় বলা যায়- সময় যত যায়, ৭১, ৭৫ ও ২০০৪ সালের কুশীলবরা তলে তলে সংগঠিত হয়। প্রতিশোধস্পৃহায় তারা দেশে-বিদেশে দল পাকায়। প্রস্তুতি নেয় আরও বড় ধরনের কিছু একটা করার জন্য। রাষ্ট্রযন্ত্র, বিচারব্যবস্থা, সচেতন নাগরিক সমাজ সবাইকে এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।
১৯৭৫ সালে সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যা এবং পরে জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর হামলার মূল টার্গেট বাংলাদেশ। এত দুর্যোগ-দুর্বিপাকেও দেশ আজ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে হাঁটতে শুরু করেছে। এতে একদিকে যেমন বাংলাদেশের বন্ধুর সংখ্যা বেড়েছে; তেমনি শত্রুও কমেনি।
পাপে ভরা পাকিস্তানকে অনেক পেছনে ফেলে শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে বিশাল সম্ভাবনার এক জনপদ। এই বাংলাদেশটাই ওদের চোখের কাঁটা। তারা থাকে, খায়-দায়-ঘুমায় এদেশে; আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাকিস্তানের কথা স্মরণ করে। বাংলাদেশে কিছু মানুষ আছে, যারা সারাক্ষণ খাই-খাই, নাই-নাই, যাই-যাই করে। যাদের লোভের জিহ্বা মাটিতে গড়ায়, তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ওরা আওয়ামী লীগে মিশে যায়। পদ-পদবি, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থবিত্ত, যশ-খ্যাতি সবকিছু অর্জন করে বিষের ছোবল দিয়ে সময়মতো কেটে পড়ে। আর সেই বিষক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ ছটফটায়।
১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলেও সেই মহামানব আজ বিশ্বব্যাপী স্মরণীয়, বরণীয়। ২১ আগস্ট বাংলাদেশের মেরুদণ্ড চিরতরে ভেঙে দেয়ার পরিকল্পনা ব্যর্থ হলেও তাদের আস্ফালন কমেনি। মানুষ শয়তানি করতে করতে একসময় টায়ার্ড হয়ে যায়; কিন্তু শয়তান টায়ার্ড হয় না। এখানেই মানুষ আর শয়তানের পার্থক্য। তেমনি দেশপ্রেমিকরা একসময় অনেক কিছু ভুলে যায়। কিন্তু চক্রান্তকারীরা ভোলে না। তারা তৎপর থাকে। তলে তলে দল পাকায়, সংগঠিত হয়। সেদিনের সেই ভয়াবহ ঘটনার কথা মনে রেখে লোভ-লালসার উর্ধ্বে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় বেঁচে যাওয়া ‘বাংলাদেশ’কে রক্ষার জন্য।
মোল্লা জালাল : সিনিয়র সাংবাদিক; সভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন
Leave a Reply