যুগে যুগে আমাদের সমাজে অমানবিক, অনৈতিক, বিবেকবর্জিত ও নীতি-জ্ঞানশূন্য কৃতকর্মের দায়ভারে স্বজাতি ও বিজাতীয় অনেকেরই করা, গোটা বাঙালি জাতির সমালোচনা ছাড়াও ব্যঙ্গোক্তি পাওয়া যায় বিবিধ বইয়ে। এগুলোর সত্যতার সাক্ষ্য আজো আমরা রাখছি শিহরণ জাগানো নানা দুষ্কর্মে। ১৫১২ থেকে ১৫১৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তোস পিরেস নামক এক পর্তুগিজ তার Suma oriental নামক বইয়ে লিখেছেন, ‘সব বাঙালি ব্যবসায়ীই অসৎ। … কোনো লোককে অপমান করতে হলে তাকে ‘বাঙালি’ বলা হয়। তারা (বাঙালিরা) অত্যন্ত বিশ্বাসঘাতক।’ (বিশ্ব ভারতীর ভূতপূর্ব অধ্যাপক সুখময় মুখোপাধ্যায়ের বাঙলার ইতিহাসের দু’শো বছর, স্বাধীন মুসলমানদের আমল, পৃ:-৩৪৮ ও ৩৫৩ হতে উদ্ধৃত।)
আধুনিক বাঙালি সমাজের বিশেষ লক্ষ্যে বঙ্কিমচন্দ্র রচনা করেন ‘মুচিরাম গুড়ের জীবন-চরিত’, যাতে লিখেছেন, ‘বাঙ্গালাদেশে মনুষ্যত্ব বেতনের ওজনে নির্মিত হয়- কে কত বড় বাঁদর, তার লেজ মাপিয়া ঠিক করিতে হয়। এমন অধঃপতন আর কখন কোন দেশের হয় নাই। বন্দীচরণ-শৃঙ্খলের দৈর্ঘ্য দেখাইয়া বড়াই করে।’ এটা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৮১ সালে। তাই আজ প্রায় ১৩৯ বছরেও কাক্সিক্ষত মানুষিক উৎকর্ষণ না হয়ে- হয়েছে কী মনুষ্যত্ব দুর্লভ, না সমাজে মুচিরামের প্রেতাত্মার প্রাদুর্ভাব? উত্তরটি অনুধাবনে মূল রচনাটিকেই খুব সংক্ষেপে উদ্ধৃত করা হলো।
‘কৈবর্তের ব্রাহ্মণ পরিবারে মুচিরামের জন্মের ১০ বছর বয়সে পিতৃ বিয়োগ হইলে সংসার অভাব অনটনে চলিতে থাকে। মুচিরাম সুকণ্ঠী, লেখাপড়া ক-খ। অভাবের তাড়নায় মা যশোদা রফা করিয়া মাসিক ৫ টাকা বেতনে মুচিরামকে এক যাত্রাদলে দিলেন। গাহিবার সময় মুচিরামকে পিছন হইতে বলিয়া দিলেও সে ঠিকমত গাইতে না পারায় সাজঘরে যাত্রার অধিকারী বাঁশ লইয়া মুচিরামের দিকে ধাবিত হইলে মুচিরাম রাতের অন্ধকারে সরিয়া যায়। পরের দিন সকালে যাত্রাদল অন্য গ্রামে চলিয়া যায়। মুচিরাম অগত্যা রাস্তায় বসিয়া কাঁদিতে থাকে। কোন এক ফৌজদারী অফিসের হেড কেরানী ইশানবাবু অতি ক্ষুদ্রলোক- কেননা তার মাসিক বেতন ১০০ টাকা মাত্র। তাই তার ল্যাজ খাটো, বানরত্বে তিনি খাটো- কিন্তু মনুষ্যত্বে নহে। তিনি মুচিরামকে লইয়া গিয়া নিজ বাড়িতে আশ্রয় দেন। একটি কাজ দিবার আশায় মুচিরামকে কিছু লেখাপড়া শিখানোর জন্য পাঠশালায় ও পরে ইংরেজি স্কুলে পাঠাইলেন। কিন্তু কোনো লাভ হইল না। দয়ার পরবশে ইশানবাবু মুচিরামকে একটি ১০ টাকার মহুরীগিরি করিয়া দিয়া ‘ঘুষ-ঘাষ না লইতে বলিয়া দিলেন।’ কিন্তু প্রথম দিনেই একটি হুকুমের চোরাও নকল দিয়া মুচিরাম আট গণ্ডা পয়সা হাত করিলেন।
ইশানবাবু পেনশন লইয়া মুচিরামকে পৃথক বাসা করিয়া দিয়া সপরিবারে স্বদেশে প্রস্থান করিলেন। ইহাতে মুচিরামের পোয়াবারো পড়ায় সে নানা অপকর্মে জেলা লুটিতে লাগিলো। অবস্থাও বেশ ভালো হইতে লাগিলো। কালেক্টরির পেশকারি খালি হইলো। বেতন ৫০ টাকা আর উপার্জনের তো কথাই নাই। আবেদনের জন্য নিজ বিদ্যায় না কুলানোর কারণে ইংরেজিতে দরখাস্ত লিখাইয়া লইলো। ভালো ইংরেজি না হইলেও পরামর্শ মতে লেখক দরখাস্তের ভিতরে অন্তত গোটা কুড়ি ‘মাই লর্ড’ আর ‘ইউর লর্ডশিপ’ লিখিয়া দিলেন। হোম সাহেব প্রায় সকল আবেদনকারীকে ইন্টারভিউতে না বলিয়া বিদায় দিলেন। মুচিরামের দরখাস্ত পড়ে হাসিয়া হোম সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আমাকে কেন লর্ড বলিয়াছেন, আমি তো লর্ড নই।’ মুচিরাম জোড় হাতে বলিলো, ‘আমার মনে হইয়াছে, হুজুর লর্ড পরিবারের।’ সাহেব আবার হাসিয়া আরো ২-৪টি কথা জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া মুচিরামকেই পেশকারিতে বহাল করিলেন। পেশকারি পাইয়া মুচিরাম বড় ফাঁপরে পড়িলেন। বিদ্যাবুদ্ধিতে সে পর্যন্ত না কুলানোর কারণে অফিসে ১২ বছরের অভিজ্ঞ তাইদনবিশ ভজগোবিন্দ চক্রবর্তীর বাসা খরচ না চলায় তাহাকেই মুচিরাম নিজ বাসায় লইয়া গিয়া রাখিলেন। ফলে থাকা, খাওয়া, গৃহকর্মে সহায়তাসহ অফিসের সমস্ত কাজকর্ম তিনি করিয়া দেন। অফিসের কাজে মুচিরামের প্রশংসা ছাড়াও উপার্জনে আর সীমা রহিলো না।
ভজগোবিন্দের প্রস্তাবে তার অবিবাহিতা ভাগিনী ভদ্রকালীকে অবিবাহিত মুচিরাম বিবাহ করিলেন। তারপর হইতে স্ত্রী ভদ্রকালীর নামে অনেক জমিদারি পত্তনি ছলে-বলে, কলে-কৌশলে খরিদ করিতে থাকে। হোম সাহেব বদলি হইয়া যাওয়ায় তাহার স্থলে আসা রিড সাহেব অল্পদিনেই বুঝিলেন, মুচিরাম একটি বৃক্ষভ্রষ্ট বানর- অকর্মা অথচ ভারীরকমের ঘুষখোর। তিনি যে বিপুল সম্পত্তি করিয়াছেন রিড সাহেব তাহা জানিতেন না। কয়েকবারই মুচিরামকে অফিস হইতে বহিষ্কার বা পেশকারি হইতে অন্যত্র সরাইয়া দিবার সিদ্ধান্ত নিলেও, মুচিরামের গরিবীর বাহানায় না খাইয়া মারা যাওয়ার কথার চোখের জলে রিড সাহেব তাহাও করিতে পারেন নাই।
অগত্যা রিড সাহেব মুচিরামকে ডেপুটি কালেক্টর করাইলেন। মুচিরামের মাথায় বজ্রাঘাত হইলো। কারণ পেশকারিতে ঘুষ লইয়া অসংখ্য টাকা রোজগারের সুযোগ ছাড়িয়া আড়াই শত টাকা ডেপুটিগিরিতে তাহার কি হইবে? অগত্যা ডেপুটি হইয়া প্রথম হুকুমপত্রে শ্রীযুক্ত বাবু মুচিরাম গুড় বাহাদুর ডেপুটি কালেক্টর লেখা দেখিয়া মহুরীকে ডাকিয়া গুড় শব্দ কাটাইয়া শুধু মুচিরাম রায় বাহাদুর লিখাইলেন। মুচিরামের নারাজ থাকা গুড় পদবির জ্বালা রহিত করাইলো। মুচিরামকে অন্যত্র বদলি করায় সেখানে যাইতে ভদ্রকালীর আপত্তিতে তিনি চাকরিতে ইস্তফা দিলেন। চাকরিস্থলে বড় বাড়ি করিলে ঘুষের টাকায় করা বলিয়া লোকের সমালোচনার ভয়ে কলিকাতায় অট্টালিকা ক্রীত হইলো। সেখানে আসায় ভদ্রকালীর অঙ্গের অলঙ্কার দেখিয়া স্ত্রীলোক হাসায় তার অলঙ্কারের গর্ব ঘুচিয়া গেল।
মুচিরাম প্রত্যহ গাড়ি করিয়া বাজারে যাইতেন এবং যাহা দেখিতেন তাহাই কিনিতেন। বাবুটা নতুন আমদানি দেখিয়া বিক্রেতাবর্গ পাঁচ টাকার জিনিস দেড় শত টাকা হাঁকিত এবং কমপক্ষে পঞ্চাশ টাকা না পাইলে ছাড়িত না। হঠাৎ মুচিরামের নাম ফাটিয়া গেল। পাড়ার জুয়াচোর, বদমাশ, মাতাল, লম্পট, নিষ্কর্মা ভাল ধুতি চাদর, জুতা পায়ে, চুল ফিরাইয়া, মুচিরামকে সম্ভাষণ করিতে আসিল। মুচিরাম তাহাদিগকে কলিকাতার বড় বড় বাবু মনে করিয়া আদর করিতে লাগিলেন। একই গলিতে বাস করা প্রথম শ্রেণীর বাটপার, রামচন্দ্র দত্তের কাছে মুচিরাম গিয়া পরিচিত হইলেন। উভয়ের বন্ধুতা হইল। তিনি মুচিরামের নাগরিক জীবনযাত্রা নির্বাহে শিক্ষাগুরু হইলেন।
মুচিরামের টাকা থাকায় সকলেরই কাছে তাহার মান হইলো। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনে ঢুকিলেন এবং নাম লেখাইয়া মুচিরাম বছর বছর টাকা দিতে লাগিলেন। প্রতি অধিবেশনে রাম বাবু সাথে যাইতে আরম্ভ করিলেন এবং মুচিরাম ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সভায় একজন বক্তা হইয়া দাঁড়াইলেন। তিনি বকিতেন মাথামুণ্ডু কিন্তু ছাপায় বাহির হইত আর এক প্রকার। সম্প্রতি বাঙ্গাল কাউন্সিলে একটি পদ খালি হইলে মুচিরাম আসনটি গ্রহণ করিলেন। রামচন্দ্র বাবুর সঙ্কল্প এত দিনে সিদ্ধ হইয়া আসিতেছিল। এ জন্য তিনি মুচিরামকে এত বড় বাবু করিয়া তুলিয়াছিলেন। রামচন্দ্র অর্ধেক মূল্যে তালুকগুলো বাঁধা রাখিলেন। সে বছর তালুকের নিকটবর্তী স্থানে সকলে দুর্ভিক্ষে পতিত হইল।
মুচিরাম প্রজাদের নিকট হইতে মাঙ্গন মাথট লইতে তালুকে আসিলে প্রজারা দলে দলে আসিতে থাকে। একদিন এভাবে অনেক দূর হইতে প্রায় একশত প্রজা আসে। কিন্তু নিকাশ প্রকাশে বেলা যাওয়ায় তাহারা বাড়ি ফিরিতে পারিল না। দোকান হইতে খাদ্যসামগ্রী কিনিয়া মুচিরামের বাগানে রাঁধাবাড়া করিয়া খাইতে বসিল, সেই সময়ে নিকটস্থ মাঠ পার হইয়া অশ্বযানে জেলার প্রধান রাজ পুরুষ ম্যাজিস্ট্রেট কালেক্টর মিনওয়েল সাহেব যাইতে ছিলেন। তিনি বাগানের ভিতরে কতগুলো লোকের ভোজন দেখিয়াই সিদ্ধান্ত করিলেন যে, দুর্ভিক্ষপীড়িত উপবাসী এসব দরিদ্র লোককে কোনো বদান্য ব্যক্তি ভোজন করাইতেছেন। তত্ত্ব জানিবার জন্য নিকটে একজন চাষাকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘টোমাডিগের গড়ামে ডুরবেক্কা কেমন আছে?’ চাষা ভাবিয়া- চিন্তায় উত্তর করিলো, ‘গাঁয়ে ভারী ডুরবেক্কা আছে।’ বাগানে খাইতে থাকা লোকগুলোকে কত দিবস ভোজন করাইয়াছে, গ্রামের নাম, জমিদারের নাম ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করে নোট বইয়ে তিনি লিখিয়া নেন। দুর্ভিক্ষে জনগণকে ভোজন করাইয়া ইংরেজের সহায়তা ও বন্ধুত্বের কারণে জমিদারকে রাজাবাহাদুর উপাধির সুপারিশ করায় পরে গেজেট হইল রাজা মুচিরাম রায়বাহাদুর।’ (বঙ্কিম রচনাবলী, পৃ:-৪৫৯-৪৬৬)।
Leave a Reply