২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার কোনো অর্থই বিতরণ করেনি ৯ ব্যাংক। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার তিন মাসের বেশি সময় পার হলেও আলোচ্য ব্যাংকগুলো উদ্যোক্তাদের মধ্যে কোনো ঋণ বিতরণ করছে না। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। করোনার প্রভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ মুহূর্তে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে তেমন কোনো সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। এতে অনেক প্রতিষ্ঠান চলতি মূলধনের অভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। বেকার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে হাজার হাজার কর্মচারী।
ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেসরকারি খাতের ৭টি ও সরকারি ২টি রয়েছে। ৭ বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে যমুনা, ওয়ান, এনসিসি, প্রিমিয়ার, এনআরবিসি ও ইউনিয়ন ব্যাংক রয়েছে। আর সরকারি ব্যাংকের মধ্যে আছে বেসিক ও বিডিবিএল।
জানা গেছে, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তা করতে প্রধানমন্ত্রী গত ৫ এপ্রিল প্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। এর মধ্যে সিএসএমই খাতে ২০ হাজার কোটি টাকা এবং বৃহৎ শিল্প ও সেবা খাতের চলতি মূলধনের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা ছিল। প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ঋণ বিতরণে উৎসাহিত করতে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের সুদহারের ওপর ভর্তুকি দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যাংক সিএসএমই খাতে ১০০ টাকা ঋণ বিতরণ করলে ৯ শতাংশ সুদহারের ওপর সরকার ৫ শতাংশ এবং সংশ্লিষ্ট গ্রাহক সুদ পরিশোধ করবে ৪ শতাংশ। একইভাবে বৃহৎ শিল্প ও সেবা খাতে সুদের ওপর সাড়ে চার শতাংশ ভর্তুকি দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী এ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করার পর তা বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর জন্য গত ১৩ এপ্রিল একটি নীতিমালা দেয়া হয়। ওই নীতিমালায় গ্রাহকদের মধ্যে ঋণ বিতরণের জন্য দিকনির্দেশনা দেয়া হয়।
কিন্তু ব্যাংকগুলো টাকার সঙ্কটের কারণে ঋণ বিতরণ করতে পারছিল না। ব্যাংকগুলোর সক্ষমতার কথা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকার অর্ধেক অর্থাৎ ২৫ হাজার কোটি টাকা পুনঃঅর্থায়ন তহবিল ঘোষণা করে। অর্থাৎ কোনো ব্যাংক আলোচ্য প্যাকেজের আওতায় ১০০ টাকা ঋণ বিতরণ করলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৫০ টাকা সরবরাহের ঘোষণা দেয়। একই সাথে ব্যাংকগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে আমানতের বিপরীতে বাধ্যতামূলক নগদ জমার হার অর্থাৎ সিআরআর হার দুই দফায় দেড় শতাংশ কমিয়ে দেয়া হয়। এতে ব্যাংকগুলোর হাতে বাড়তি প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার সরবরাহ বাড়ে। অপর দিকে বিনিয়োগসীমাও ২ শতাংশ বাড়িয়ে ৮৫ শতাংশ থেকে ৮৭ শতাংশ করা হয়। এতে ব্যাংকগুলো প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকার বাড়তি বিনিয়োগের সুযোগ পায়। একই সাথে ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা ট্রেজারি বিল ও বন্ড এক বছরের জন্য বন্ধক রেখে বিশেষ ছাড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নেয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়।
এ দিকে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্পের ঋণ বিতরণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়া হয়েছে। গত ৩১ ডিসেম্বরভিত্তিক বিতরণ করা ব্যাংকগুলোর এসএমই ঋণের ১০ শতাংশ চলতি বছরে প্রণোদনার প্যাকেজের আওতায় বিতরণ করার নীতিমালা দেয়া হয়। ওই নীতিমালা অনুযায়ী যমুনা ব্যাংককে ২৫৭ কোটি টাকা, এনসিসি ব্যাংকের ৪৭০ কোটি টাকা, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ৪৮০ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংকের ২৭০ কোটি টাকা, ওয়ান ব্যাংকের ২১০ কোটি টাকা, বিডিবিএলের ২০ কোটি টাকা, নতুন প্রজন্মের ব্যাংক এনআরবিসির ১৩০ কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংকের ৩০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এতগুলো সুযোগ দেয়ার পরও ব্যাংকগুলো প্রণোদনার প্যাকেজ থেকে ঋণ বিতরণে কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার তিন মাস ১০ দিন পার হলেও এ প্যাকেজের আওতায় একটি টাকাও ঋণ বিতরণ করেনি আলোচ্য ৯ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর মধ্যে যমুনা ব্যাংকসহ আরো কয়েকটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে গ্রাহককে এ বিষয়ে অসহযোগিতা করার অভিযোগ উঠেছে।
কয়েকজন উদ্যোক্তা জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে তেমন কোনো সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। এ দিকে চলতি মূলধনের অভাবে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। এ অবস্থায় ব্যাংকের সহযোগিতা না পেলে তারা টিকে থাকতে পারবেন না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো: সিরাজুল ইসলাম বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু যেসব ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করে গ্রাহককে ঋণ বিতরণ করবে না, আর এ বিষয়ে কেউ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে অভিযোগ করলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি জানান, অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এ জন্য ব্যাংকগুলোকে সক্ষম করে গড়ে তোলার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নানা দিক দিয়ে ব্যাংকগুলোকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা দিয়েছে। এরপরও যথাযথ নীতিমালা মেনে গ্রাহককে ঋণ না দেয়া ঘোরতর অন্যায়। এ কারণে ভুক্তভোগী গ্রাহককে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অভিযোগ করার জন্য তিনি পরামর্শ দিয়েছেন।
Leave a Reply