সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার নিখোঁজে (নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত হত্যা বলা যায় না) অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। এসব প্রশ্নের উত্তর জানা প্রয়োজন এবং কিছু সিস্টেমেটিক পদ্ধতিতে তদন্ত করলেই সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে।
বলা হচ্ছে এমপি আনারকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে হাড় ও মাংস টুকরো টুকরো করা হয়েছে। তা হয়ে থাকলে যেখানে করা হয়েছে সেখানে প্রচুর রক্ত ঝরেছে এবং রক্ত পরিষ্কার করতে সে জায়গাটুকু ধুয়ে ফেলতে হয়েছে। সুতরাং কলকাতার একটি অ্যাপার্টমেন্টে ঘটনাটি ঘটেছে তাহলে সেই অ্যাপার্টমেন্টেই এমপি আনারের রক্ত নিশ্চয়ই কোনো পাইপ দিয়ে ড্রেনে পড়েছে। পানি নিষ্কাশনের সেই পাইপ থেকে নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করলেই রক্তের ডিএনএ পাওয়া যাবে।
সম্ভাবনা হিসেবে ধরে নিয়ে অনেক কিছু তদন্ত করতে হবে। এমনও হতে পারে, মারাত্মক আঘাতের ফলে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর এমপি আনারের দেহ সেখান থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে পারে অপরাধীরা। যদি এমন হয়ে থাকে তাহলে তার মৃত্যু অন্য কোথাও হয়ে থাকতে পারে অথবা অকুস্থলেই তার মৃত্যুর ফলে তার লাশ সরানো হয়ে থাকতে পারে। যেটাই ঘটুক তার লাশ অথবা কথিত মৃতদেহের টুকরো যে অন্যত্র সরানো হলো এবং কাদের মাধ্যমে ও কে কে সরানোর সাথে জড়িত ছিল তাদেরকে শনাক্ত করা দরকার এবং এদের শনাক্ত করাও কঠিন কিছু নয়। এদের শনাক্ত করতে পারলে অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে।
প্রথমত যা করা দরকার : এমপি আনার খুন হয়েছেন কি না অথবা হয়ে থাকলে কোথায় খুন হয়েছেন? তার লাশ বা তার অংশবিশেষ ওখান থেকে সরানো হয়েছে কি না? তদন্তের উদ্দেশ্য হবে লাশ পাওয়া বা নিশ্চিত হওয়া যে, তার মৃত্যু হয়েছে। এখন পর্যন্ত জানা গেছে, তার মৃত্যু হয়েছে কলকাতার একটি ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টে। ফরেনসিক বিজ্ঞান বলে যে, যদি ওই অ্যাপার্টমেন্টেই মৃত্যু হয়ে থাকে তাহলে সেখানেই বেশির ভাগ প্রমাণ পাওয়া যাবে। সেখানে কয়জন অপরাধী আগে থেকেই ছিল বা পরবর্তী সময়ে কয়জন সেখানে গিয়েছে তা জানতে হবে। এমপি আনারকে সেখানে হত্যা করলে তার ব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিসসহ ফিঙ্গার প্রিন্ট (হাতের ছাপ), ফুট প্রিন্ট (পায়ের ছাপ) ও লিপ প্রিন্ট (ঠোঁটের ছাপ) পাওয়া যাবে। কারণ তিনি অথবা হত্যাকারীরা সেখানে চা পান করে থাকতে পারে, চামচ দিয়ে কিছু খাবার খেয়ে থাকতে পারে। সেখানে ধস্তাধ্বস্তি হলে চুলও পাওয়া যাবে, হাতের ছাপ থাকবে, পায়ের ছাপ থাকবে। এভাবে সেই অ্যাপার্টমেন্টে আনার হত্যা হয়ে থাকলে এর সাথে জড়িত প্রতিটি ব্যক্তির উপস্থিতি বৈজ্ঞানিকভাবে জানা যাবে ও প্রমাণ করা যাবে।
পরবর্তী কাজ : পত্রিকান্তরে জানা গেছে, দেহটিকে টুকরো টুকরো করা হয়েছে। একটি লাশকে গুম করার জন্য তিন থেকে চারজনই যথেষ্ট। অন্য দিকে একজনকে হত্যা করে অনেক ছোট ছোট টুকরো করার মতো এত সময় নষ্ট করার কাজ অপরাধীরা করবে না। সময় বাঁচানোর জন্য এরা মৃতদেহকে চার থেকে ছয় টুকরোর বেশি করবে না। চার থেকে চয় টুকরো করলেই অপরাধীরা খুব সহজেই মৃতদেহকে লুকিয়ে ফেলতে পারবে। কিন্তু এমপি আনারের মৃতদেহের কোনো টুকরোই তো নিশ্চিতভাবে এখনো পাওয়া গেল না। তাহলে আমরা আগে থেকে কিভাবে বললাম, ‘মৃতদেহের টুকরোতে হলুদ মাখানো হয়েছিল?’
ধরলাম এমপি আনারকে টুকরো করে মৃতদেহ ফেলা দেয়া হয়েছে, কোথায় ফেলা হলো? আরেকটি প্রশ্নের উত্তর জানতে হবে। মৃতদেহের টুকরো কি স্যুটকেসে/থলিতে করে পানিতে ফেলে দিয়েছে, না স্যুটকেস/থলি থেকে বের করে পানিতে অল্প অল্প করে ছিটিয়ে ফেলা হয়েছে? যদি ছিটিয়ে ফেলা হয়ে থাকে তাহলে খোঁজাখুঁজি করলে অব্যশই দুই/এক টুকরো পাওয়া সম্ভব। কারণ টুকরোগুলো অল্প সময়ের মধ্যে ভেসে উঠার কথা। অন্য দিকে স্যুটকেস/থলিসহ পানিতে ফেলে দিলে সেই স্যুটকেসটা/থলিটাও পাওয়া যাবে। এটা যদি বহমান পানিতে ফেলা হয়ে থাকে তাহলে স্রোতের অনুকূলে কিছুটা দূরে খুঁজলে অবশ্যই পাওয়া যাবে। যদি স্থির পানিতে ফেলা হয়ে থাকে তাহলে মৃতদেহের টুকরোভর্তি স্যুটকেস/থলিটি সেখানেই পাওয়া যাবে।
এ ছাড়া ইতোমধ্যে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য বহুবিধ তদন্তে কাজে লাগবে। ঘটনাস্থল যেহেতু ভারতে, সে কারণে ভারতের আইনশৃঙ্খলাবাহিনী এবং সেখানকার ফরেনসিক প্যাথলজিস্টরা নিশ্চয়ই যৌথভাবে তদন্ত করছে বলেই আমার বিশ্বাস। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে যে তথ্যগুলো প্রকাশিত হয়েছে তার বেশির ভাগই লোক মুখে শোনা। এগুলো আবার বিভিন্নভাবে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চের (ডিবি) কার্যালয়ের পক্ষ থেকে দেয়া তথ্যও রয়েছে। যেকোনো হত্যা তদন্তকালে যদি কোনো তথ্য আগেই প্রকাশিত হয়ে যায়, তা হত্যাকারীদের সহায়তা করে কৌশল নির্ধারণে। আমার মনে হয়, হত্যাকারীদের কৌশল নির্ধারণে ভূমিকা পালন করে এমন তথ্য দেয়া ঠিক নয়।
শেষ কথা : যেকোনো হত্যা তদন্তে সিন ইনভেস্টিগেশন, মৃতের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট এবং যে স্থানে মৃত্যু হয়েছে সেখানকার তদন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই কাজটি তদন্তকারী সংস্থাগুলো সঠিকভাবে পালন করতে পারলে সফলতা আসবে এবং হত্যাকারীদের ধরা যাবে। এটা যদি হত্যাকাণ্ড হয়ে থাকে তাহলে তা ভারতীয় ভূখণ্ডে ঘটেছে এবং ভারতীয়দের ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টে ঘটেছে। সে কারণে বিষয়টি আরো গভীরে গিয়ে তদন্ত করা উচিত। এ ব্যাপারে আসামি শনাক্তকরণে অব্যশই ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার আন্তরিক সহযোগিতা ও সহায়তা গুরুত্বকপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
Leave a Reply