ইসলাম হলো কুরআন-হাদিসে পরিচালিত একেশ্বরবাদী ধর্ম ও জীবনপদ্ধতি। কিন্তু বর্তমানে ইসলামকে আমরা শুধু ধর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাই। আমরা মনে করি, ইসলাম হলো শুধু স্রষ্টাভিত্তিক কাজকর্ম। সালাত পড়া, রোজা রাখা, হজ করা, জাকাত দেয়া। ইসলামকে আমরা শুধু এসব গণ্ডির মধ্যেই রাখতে ভালোবাসি। কিন্তু ইসলাম যে পূর্ণাঙ্গ এক জীবনব্যবস্থা সেটি মানতে চাই না। আমাদের পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ, রাষ্ট্র, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রতিটি ক্ষেত্রেই আল্লাহর কুরআন ও নবী মুহাম্মদ সা:-এর হাদিস অনুসারে সার্বিক পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনাকে ইসলাম বলে। শুধু সালাত-সিয়ামে ইসলাম সীমাবদ্ধ নয়। ইসলামের পরিধি ব্যাপক, বিস্তৃত। ইসলামের প্রসারণ আমাদের জন্ম থেকে মৃত্যু, দোলনা থেকে কবর, পরিবার থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত। আমাদের ইহকালীন-পরকালীন মুক্তি, শান্তির জন্য ইসলামই একমাত্র জীবনব্যবস্থা ও পথপ্রদর্শক।
ইসলাম একটি সুশৃঙ্খল, পরিপাটি, সাজানো-গোছানো জীবনপদ্ধতি। ইসলামকে শুধু ধর্ম বলে একে আমি ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করতে চাই না। ইসলাম হলো পূর্ণাঙ্গ, স্বাধীন এক জীবনব্যবস্থা যা ব্যক্তির জীবনের সার্বিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে। ইসলামের সৌন্দর্যের কথা বললে বলে শেষ করা যাবে না। ইসলামের যে মৌলিক পাঁচটি স্তম্ভ আছে, যার ওপর ভিত্তি করে ইসলাম দাঁড়িয়ে আছে। যেমন- ঈমান, সালাত, জাকাত, সিয়াম ও হজ। এ পাঁচটি স্তম্ভের দিকে তাকালেই আমরা ইসলামের সৌন্দর্য খুঁজে পাবো। আল্লাহ তায়ালা মু’মিনদের জন্য এ পাঁচটি স্তম্ভ ফরজ বা অত্যাবশ্যক করেছেন। প্রথমে আমরা সালাতের কথায় আসি। আল্লাহ তায়ালা মু’মিনদের জন্য প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করেছেন। পাড়া-মহল্লার সবাই এ পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে একে অন্যকে দেখার, খোঁজখবর নেয়ার সুযোগ হয়। একত্রে সারিবদ্ধভাবে যখন জামাতে দাঁড়ায় তখন সমাজের উঁচু-নিচু, ধনী-গরিব, আত্মীয়-অনাত্মীয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য, কোনো ভেদাভেদ থাকে না। তখনই সবাই এক আল্লাহর স্মরণে, এক আল্লাহর কাছে মাথা নত করে। আল্লাহ তায়ালা সালাতের পাশাপাশি জাকাতকেও ফরজ করেছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সূরা বাকারাহর ২৭৭ আয়াতে বলেন- ‘যারা আল্লাহর ওপর ঈমান এনে সৎ কাজ করবে, সালাত প্রতিষ্ঠা করবে এবং জাকাত আদায় করবে, তাদের কোনো ভয় নেই এবং চিন্তিতও হবে না।’ কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ৮২ বার সালাতের সাথে সাথে জাকাতের কথা বলেছেন। সুতরাং সালাত যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি জাকাত আদায়ও সমান গুরুত্বপূর্ণ। জাকাত হলো ধনীর সম্পদ থেকে গরিবের জন্য প্রাপ্ত অধিকার। আল্লাহ পৃথিবীতে সবাইকে সমান সম্পদ দিয়ে পাঠাননি। কাউকে ধনী, কাউকে গরিব করেই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। তবে এতে ধনী-গরিব উভয়ের জন্যই দৃষ্টান্ত রয়েছে। ধনীর সম্পদ থেকে গরিবরা সম্পদ পাবে। এ জাকাত প্রদানের ফলে ধনী-গরিবের মধ্যে বৈষম্য, পার্থক্য দূর হয়। আল্লাহ তায়ালা কী সুন্দর করেই না বৈষম্য নিরসনের উপায় বলে দিয়েছেন!
ইসলামের চতুর্থ স্তম্ভ হলো সিয়াম। রমজান মাসে সুবহে সাদিকের পর থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত সব ধরনের পানাহার, আহার থেকে বিরত থাকা হলো সিয়াম। আল্লাহ তার বান্দাদের উদ্দেশ করে কুরআনে সূরা বাকারাহর ১৮৩ নম্বর আয়াতে বলেন- ‘হে ঈমানদাররা! তোমাদের ওপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে, যেমনটি করা হয়েছিল তোমাদের তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ এ মাস হলো আল্লাহর বিধিনিষেধ, হুকুম-আহকাম মান্য করার মাস। আল্লাহ তায়ালা এখানে দেখিয়েছেন, গরিবরা অনাহার-অর্ধাহারে কতটা কষ্টে দিন কাটায় তা ধনীরা বুঝবে না। তাই তিনি সিয়ামের মাধ্যমে গরিবের দুঃখ, কষ্টটা তুলে ধরেছেন। পুরো এক মাস ধনীরা অনাহারে সিয়াম রেখে ক্ষুধার্তের অবস্থা বুঝতে পারে। আল্লাহ কত সুন্দর করেই না রোজার ফজিলত তুলে ধরেছেন তাঁর বান্দার কাছে।
এবার আসি ইসলামের সর্বশেষ স্তম্ভ হজের কথায়। আল্লাহ প্রত্যেক সুস্থ, সবল, বিবেকবান, সামর্থ্যবান প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য হজ ফরজ করেছেন, যারা হজের পূর্ণ অর্থ বহন করতে এবং সেখান থেকে ফিরে আসতে সক্ষম। হজ হলো মুসলমানদের জন্য মিলনমেলা, যাকে বলা হয় মহাসম্মেলন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মুসলমান পবিত্র মক্কা-মদিনায় জিলহজ মাসে কিছুদিনের জন্য একত্রিত হয়। তাদের ভাষা, আচার-আচরণ, চলাচল, পোশাক, আকার-আকৃতি সর্বব্যাপী প্রত্যেকের আলাদা আলাদা কালচার হওয়া সত্ত্বেও সবাই এক মনে, একই সাদা পোশাকে মহান আল্লাহর ডাকে একত্রিত হয়। সবার মুখে এক আল্লাহর নাম। আল্লাহ তায়ালা হজকে ফরজ করে গোটা মুসলিম জাতিকে একত্র করার সুযোগ করে দিলেন। তাদের একে অন্যের ভাষা, আচরণ, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক রীতিনীতি বুঝতে, একে অন্যের সংস্কৃতি জানতে কী অপরূপ এক মিলনমেলা! এই হজের মাধ্যমে বিশ্ব মুসলিমদের মধ্যে এক বিশ্বভ্রাতৃত্ব তৈরি হয়।
ইসলাম শুধু পাঁচটি স্তম্ভেই সীমাবদ্ধ নয়। এর পরিসর আরো ব্যাপক, বিস্তৃত। আমাদের পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনা- সব ক্ষেত্রেই ইসলাম আবশ্যক ভূমিকা পালন করে। পরিবারের সবার সাথে ভালো ব্যবহার করা, গরিব-এতিমের সাথে আচরণ, সমাজের একে অন্যের খোঁজখবর নেয়া সব ক্ষেত্রেই ইসলামের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ব্যক্তির আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ, কথার মাধুর্য সবখানেই ইসলামের গুরুত্ব, প্রভাব রয়েছে।
ইসলাম মানুষকে মুক্তির আহ্বান করে, আত্মার পরিশুদ্ধি করে। ব্যক্তির প্রতি ব্যক্তির বিশ্বাস, ভালোবাসা তৈরি করে। প্রতিবেশীর হক আদায়, তাদের খোঁজখবর নেয়া থেকে শুরু করে দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করা, রোগ শোকে পাশে থাকা ইত্যাদি কাজের নির্দেশনা দেয় ইসলাম। পরিপূর্ণ ইসলামে প্রবেশ করলে মানুষের ইহকালে ও পরকালে মুক্তি মিলবে।
ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত রাষ্ট্রনায়ক ধনী-গরিব, আত্মীয়-অনাত্মীয়, উঁচু-নিচুর মধ্যে কখনো পার্থক্য করবে না। তার মনে স্বজনপ্রীতির কোনো স্থান থাকবে না। ব্যক্তির নিজ নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় কাজের দায়িত্ব পাবে, সে দলীয় বা বিরুদ্ধ দলীয় লোক হলেও। ইসলামই নারীকে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী করেছে। নারীর অধিকার রক্ষায় পুরুষ সবসময়ই সোচ্চার থাকবে।
মোটকথা, বলতে গেলে, ইসলাম মানুষকে সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করে। ইসলামী আদর্শে জীবন পরিচালনা করলে ইহকালে যেমন শান্তিতে বসবাস করতে পারে তেমনি পরকালের কল্যাণের পথও সুগম হয়। আমরা যেন ইসলামকে শুধু ধর্ম মনে না করে, একে ক্ষুধা গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ না রেখে, ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের বাইরেও চিন্তার প্রসারতা ঘটাই। ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য পেতে হলে আমাদের পুরোপুরি ইসলামে প্রবেশ করতে হবে। ইসলামের কিছু মানলাম আর কিছু মানলাম না, নিজের মনমতো ইসলাম মানলে, নিজের ইচ্ছেমতো চললে, ইসলামের সৌন্দর্য, স্বাদ উপভোগ করা যায় না। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে সূরা বাকারাহর ২০৮ নম্বর আয়াতে নিজেই বলেছেন- ‘হে মুমিনরা, তোমরা ইসলামে পূর্ণরূপে প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের জন্য প্রকাশ্য শত্রু।’ সুতরাং আমাদের আল্লাহর কথা মেনে পরিপূর্ণ মু’মিন হয়ে ইসলামে প্রবেশ করতে হবে। আমরা যা করি তা-ই আমাদের কর্মফল, আমরা পুনরুত্থানের দিনে আমাদের কর্ম অনুযায়ী ফল পাবো। ভালো কাজের জন্য জান্নাত, খারাপ কাজের জন্য জাহান্নাম। তাই আমাদের এই সুশৃঙ্খল জীবনব্যবস্থা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে হবে। ভালো কাজে আদেশ, মন্দ কাজে নিষেধ করে ইসলামী সৌন্দর্যের আলোকে নিজে, পরিবার, সমাজ রাষ্ট্র কায়েম করতে হবে।
লেখক :
শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Leave a Reply