কোনো ধরনের পূর্বশর্ত ছাড়াই বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলকে সংলাপে বসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সংলাপের জন্য সময় না দিয়েই আগামী ৭ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। সংলাপের আহ্বান প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র চুপচাপ তা মেনে নিয়ে সরকারের সাথে স্বাভাবিকভাবে কাজ চালিয়ে যাবে মনে করছেন না কূটনীতিক ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ভিসানীতির প্রয়োগসহ অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা দিয়ে হার্ডলাইনে যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতি, সাধারণ মানুষ আরো বিপাকে পড়তে পারে।
দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু গত সোমবার বাংলাদেশের প্রধান তিন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির কাছে একটি চিঠি লিখেছেন। এতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র চায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সুষ্ঠু ও অবাধে বাংলাদেশে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। এ জন্য সব পক্ষকে সহিংসতা থেকে বিরত থেকে সংযম পালনের আহ্বান জানানো হয়। এতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষাবলম্বন করে না। কোনো ধরনের পূর্বশর্ত ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্র সব পক্ষকে সংলাপে বসার আহ্বান জানাচ্ছে। গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে এমন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সমভাবে ভিসানীতির প্রয়োগ অব্যাহত রাখবে।
ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস একই দিন বিএনপি ও জাতীয় পার্টির কাছে ডোনাল্ড লু’র চিঠিটি পৌঁছে দেয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের হাতে পৌঁছাতে তা আরো দুই দিন লেগে যায়। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস গত বুধবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের হাতে চিঠিটি পৌঁছে দেন। কিন্তু চিঠি হাতে পাওয়ার পর ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, আজই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হবে। এখন সংলাপের সময় নেই। রাতে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন।
রাজনৈতিক সংলাপের জন্য ডোনাল্ড লু’র আহ্বান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কী হবে জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন গতকাল বৃহস্পতিবার নয়া দিগন্তকে বলেন, গণমাধ্যমে আগেই এসেছিল, ডোনাল্ড লু’র চিঠি মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস প্রধান তিন রাজনৈতিক দলকে দিয়েছেন বা দিচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়ে তফসিল ঘোষণা ১৫ দিন বা ২১ দিন পিছিয়ে দিতে পারত। কেননা সংবিধান অনুযায়ী, আগামী ২৯ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। অর্থাৎ নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হাতে যথেষ্ট সময় ছিল। সিইসি যেহেতু রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে ইতিবাচক পরিবেশে নির্বাচনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন, তাই ইচ্ছা করলেই এ জন্য প্রয়োজনীয় সময় তিনি দিতে পারতেন। কিন্তু সেটি তিনি দেননি। এ কারণে সংলাপের আহ্বান জানিয়ে ডোনান্ড লু’র চিঠি পাওয়ার পর গত বুধবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলতে পেরেছেন, আজই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়ে যাবে। এখন সংলাপের সময় নেই। তিনি বলেন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সংলাপের পরিকল্পনা আওয়ামী লীগের নেই। তাই সঙ্গত কারণে তারা তফসিল পেছানোর জন্য নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করেনি। তবে তফসিল ঘোষণা কখন হবে তা নির্ধারণের এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের রয়েছে। অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আওয়ামী লীগ চাইবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচনটা পার করে দিতে।
ডোনাল্ড লু’র চিঠিতে ভিসানীতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে- এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব বলেন, এই নীতি বহাল রয়েছে। চিঠি পাওয়ার পর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেছেন যে, সমঝোতা ছাড়া নির্বাচনে গেলে আমাদের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। অন্য দিকে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের প্রায় সবাই কারাগারে অন্তরীণ। তাই তারা সংলাপ করবেই বা কিভাবে। কিন্তু বিএনপি ছাড়া একটি নির্বাচনে এমনকি আওয়ামী লীগের একান্ত সমর্থক ছাড়া অন্যদের ভোট কেন্দ্রে নিয়ে আসা সম্ভব হবে বলে আমার মনে হয় না। এ ধরনের নির্বাচনে ১০-১৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়ার সম্ভাবনা কম। ভোট দিতে জনগণকে বাধ্য করার কোনো আইন আমাদের দেশে নেই। ১০ শতাংশ ভোট পড়ার পরও নির্বাচনকে সুষ্ঠু হিসেবে ঘোষণা করার নজির বাংলাদেশে রয়েছে। তিনি বলেন, আসন্ন নির্বাচনটা ‘লোক দেখানো’ হতে যাচ্ছে। তাতে কে অংশ নিলো বা নিলো না সেটি খুব একটা গুরুত্ব পাবে না।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আরো নাজুক হয়ে পড়বে কি না জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা রাজনীতিবিদরাই সৃষ্টি করে, আর ভুক্তভোগী হয় সাধারণ মানুষ। এটা বরাবরই হয়ে আসছে। সাধারণ মানুষের জন্য কারো কোনো চিন্তাভাবনা আছে বলে কখনো মনে হয় না। ক্ষমতা ধরে রাখতে আর ক্ষমতায় যেতে ‘জনগণ’ শব্দটিকে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহার করে। তিনি বলেন, সংলাপের আহ্বান প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র চুপচাপ তা মেনে নিয়ে স্বাভাবিকভাবে কাজ চালিয়ে যাবে বলে আমার মনে হয় না। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যুক্তরাষ্ট্রকে নির্বাচনসহ নানা ইস্যুতে অবিরাম আক্রমণ করে গেছেন। আগে ভারতের দৃষ্টিতে বাংলাদেশকে দেখতো যুক্তরাষ্ট্র; কিন্তু এখন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে বাংলাদেশে তাদের কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে। তাই তারা হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকবে এমনটা হবে না। আর বিপদটা সেখানেই। যুক্তিতর্কে আমরা যা-ই বলি না কেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো অনেকটাই যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। যুক্তরাষ্ট্র চাইলে আমাদের রাজনৈতিক নেতা ও দেশের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। আওয়ামী লীগ গত ১০ বছরের মতো এবারো যেনতেন একটা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আবারো ক্ষমতায় এলে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে তা নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে। ২০১৪ বা ২০১৮-এর নির্বাচনের পর ‘যা হওয়ার হয়েছে, কী আর করা যাবে’ এমন একটি ভাব আন্তর্জাতিক মহলে ছিল। কিন্তু এবার তেমনটা হবে না বলেই মনে হয়। এতে বাংলাদেশে অর্থনীতি, সাধারণ মানুষ আরো বিপাকে পড়বে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ এখনই খুব খারাপ অবস্থায় রয়েছে।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক নিয়ে শেষ পর্যন্ত কী হবে তা বলা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করে তৌহিদ হোসেন বলেন, নির্বাচন কমিশন এখন পর্যন্ত অসংখ্য স্থানীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষককে নিবন্ধন দিয়েছে। এসব পর্যবেক্ষক যদি বলে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, তবে নির্বাচন কমিশনও তাতে সায় দেবে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা বাংলাদেশে এলে তাদের পর্যালোচনা দেশে এবং দেশের বাইরে গুরুত্বের সাথে নেয়া হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে তৎকালীন নির্বাচন কমিশনগুলো যতটা সহজে বিতর্কিত নির্বাচন করতে পেরেছে, এবার ততটা সহজ হবে না বলে আমার ধারণা। গত ১০ বছরে নদীতে অনেক জল গড়িয়েছে। প্রধান একটি রাজনৈতিক দলকে বাইরে রেখে একতরফা নির্বাচন হলে সরকারের বৈধতা, নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। তিনি বলেন, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো সে দিকে কর্ণপাত করছে না। আমি আশা করব, তাদের শুভ বুুদ্ধির উদয় হবে। তারা অনুধাবন করতে পারবে যে, সংলাপের বিকল্প একমাত্র সংলাপই।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতি বিজ্ঞানের অধ্যাপক আলী রিয়াজ গতকাল ডোনাল্ড লু’র চিঠিসংক্রান্ত এক নিবন্ধে লিখেছেন, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা এবং গত মে মাসে ঘোষিত ভিসানীতির প্রভাব বাংলাদেশের ওপর পড়েছে। তবে তা রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়াই সরকারকে নির্বাচনে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি একটি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। কিন্তু এর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথে নেয়া যাবে- এমনটা আশা করা বাস্তবসম্মত নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি বা সংলাপের আহ্বান- কোনোটাই অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারবে না। সুষ্ঠু নির্বাচন একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারত। আশা করা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা এই বিষয়টি আগে থেকেই ভেবে রেখেছেন এবং সম্ভবত তাদের হাতে আরো হাতিয়ার রয়েছে। এর মধ্যে কোন অস্ত্রটি ব্যবহার করা হবে তা বাংলাদেশের জনগণ এবং বাংলাদেশের রাজনীতি পর্যবেক্ষকদের কাছে একটি প্রশ্ন।
Leave a Reply