১২ অক্টোবর ২০২২ দৈনিক প্রকাশিত একটি সংবাদে দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সরানো এবং সার্ক, বিমসটেক, আসিয়ান রাষ্ট্রগুলোতে শেয়ারিংয়ের ভিত্তিতে স্থানান্তর চেয়ে আইনি নোটিশ দেয়া হয়েছে। সংবাদে প্রকাশ, ১১ অক্টোবর ২০২২ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মাহমুদুল হাসান রেজিস্ট্রি ডাকযোগে স্বরাষ্ট্র সচিব, পররাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক এবং শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কাছে এ নোটিশ পাঠিয়েছেন। ওই আইনি নোটিশে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ তার ভূখণ্ডে মিয়ানমারের ১২ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়েছে। এ ছাড়া প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা সন্তান জন্মগ্রহণ করছে। এই রোহিঙ্গাদের প্রতিপালন করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি বছর ১ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হচ্ছে, যা বাংলাদেশী টাকায় ১৩ হাজার কোটি টাকা।
নোটিশে আরো বলা হয়, প্রথমত, বাংলাদেশ ১৯৫১ সালের শরণার্থীবিষয়ক কনভেনশন ও ১৯৬৭ সালের প্রটোকলের স্বাক্ষরিত রাষ্ট্র নয়। তাই বাংলাদেশ আইনগতভাবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে বাধ্য নয়। দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গারা স্বাধীনতাকামী জনগোষ্ঠী নয়। তারা স্বাধীনতার জন্য কোনো সংগ্রামে লিপ্ত নয়। তাদের কোনো প্রবাসী সরকার নেই, যার দরুন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী অন্য কোনো রাষ্ট্রের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের অধিকারী নয়। তৃতীয়ত, রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানের জন্য বাংলাদেশের সাথে আঞ্চলিক কোনো সংস্থা যেমন সার্ক, বিমসটেক, আসিয়ানের কোনোরূপ চুক্তি নেই, ফলে এককভাবে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে পারে না।
আইনি নোটিশে একতরফাভাবে রোহিঙ্গাদের বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়েছে। মনে রাখতে হবে তারাও বিশ্ব মানবগোষ্ঠীর অংশ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সনদে রিফিউজিদের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। তাদের রোহিঙ্গা নয় বরং মানুষ হিসাবেই বিবেচনা করতে হবে।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে ইতোমধ্যে অনেক লেখালেখি হয়েছে, আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে মিয়ানমার সরকার গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছে, অং সান সু চিকে বিশ্বের বিভিন্ন সংগঠন থেকে দেওয়া আকর্ষণীয় সম্মানজনক উপাধি ও পদপদবি প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। বিশ্ব মানবজাতির মধ্যে সবচেয়ে কষ্টে ও মানবেতর জীবনযাপন করছে রোহিঙ্গারা। সর্বস্ব হারিয়ে তারা এখন রিফিউজি (Refugee)।
প্রখ্যাত গ্রিক নাট্যকার ইউরিপিদেস বলেছে যে, পৃথিবীতে তার চেয়ে বেশি দুঃখ আর নাই যে মাতৃভূমি/ নিজ রাষ্ট্র থেকে উৎখাত হয়েছে। BlackÕs Law Dictionary এর বর্ণনা মতে ‘A refugee is a person who flees or expelled from a country especially because of persecution and seeks haven in another country’ অর্থাৎ রিফিউজি বা শরণার্থী যে নিজ দেশ হতে বিতাড়িত হয়ে অন্য দেশে বসবাসকে নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্নবোধ করে। পৃথিবীতে রিফিউজির বা শরণার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ১. অস্ত্রের সঙ্ঘাত, ২. প্রাকৃতিক দুর্যোগ যথা নদীভাঙন, ভূমিকম্পন প্রভৃতি এবং ৩. প্রাকৃতিক বিপর্যয় তথা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সংঘটিত প্রাকৃতির দুর্যোগ, প্রভৃতি কারণে। আন্তর্জাতিক শরণার্থী আইনটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের একটি অংশ। তবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন (International Human Right Law) এবং আন্তর্জাতিক মানব হিতৈষী বা জনহিতকর আইন (International Humanetarian Law) পরস্পর সম্পর্কযুক্ত হলেও এক কথা নয়। প্রথাগত (Customary Law) আইন, পদ্ধতিগতভাবে দীর্ঘদিন যাবৎ পালনীয় পদ্ধতি (Peruemploy norms) এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সনদ থেকে রিফিউজি বা শরণার্থী আইনের সৃষ্টি। এ ছাড়াও ১৯৫১ সালের আন্তর্জাতিক সনদ এবং ১৯৬৭ সালের সম্পাদিত প্রটোকলে রিফিউজিদের অধিকার সংক্রান্ত দুটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সনদ।
এ ছাড়া Universal Declaration of Human Right 1948, the convention relating to the State of Refugee 1951 Ges Dnvi Protocal 1967, convention on the Elimination of all forms of Discrimienation Against Women’ 1979, the convention against torture and other cruel inhuman or degrading treatment or Punishment’ 1984, the Convention on the Rights of the Child’ ১৯৮৯ প্রভৃতি আন্তর্জাতিক সনদগুলোতে শরণার্থীদের অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। জীবনের নিরাপত্তার জন্য কোনো রাষ্ট্র হতে বিতাড়িত হয়ে আশ্রয় গ্রহণকারী কোনো রাষ্ট্রে আশ্রয় প্রার্থনা করলে (Asylum) সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের আশ্রয় প্রদানের নীতিগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এ ছাড়াও বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় মানবজাতির প্রগতিশীল আশা আকাক্সক্ষার সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পূর্ণ ভ‚মিকা পালনের কথা বলা হয়েছে। অন্য দিকে বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ-২৫ এ বলা হয়েছে যে, ‘জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের ও জাতিসঙ্ঘের সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা এই সকল নীতি হইবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি এবং এই সব নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র- ক. আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তিপ্রয়োগ পরিহার এবং সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য চেষ্টা করিবেন,
খ. প্রত্যেক জাতির স্বাধীন অভিপ্রায় অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করিবেন, এবং
গ. সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ বা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন করিবেন।
নোটিশদাতা হয়তো সৎ উদ্দেশ্য নিয়েই উক্ত আইনি নোটিশ দিয়েছেন, কিন্তু তিনি সমাধানের কোনো প্রস্তাব দেন নাই। নোটিশদাতার মতে আন্তর্জাতিক রিফিউজি আইন’ ১৯৫১ এবং উহার প্রটোকল ১৯৬৭ দলিলে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করে নাই। স্মরণ রাখা দরকার যে, ১৯৫১ এবং ১৯৬৭ সালে বাংলাদেশের জন্ম হয়নি। তদুপরি যেহেতু বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘের তালিকাভুক্ত একটি সদস্য রাষ্ট্র সেহেতু উক্ত আইন মেনে চলার জন্য বাংলাদেশ নীতিগতভাবে বাধ্য এবং উক্ত সনদ সম্মান করতে বাংলাদেশের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করার বিষয়ে কথা বলার পূর্বে স্মরণ রাখা দরকার যে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিভীষিকাময় পৈশাচিক তাণ্ডবের কারণে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের এক কোটি নর-নারী শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। তখন যদি ভারত সরকার এক কোটি বাংলাদেশীকে আশ্রয় না দিতো তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অনিশ্চিত হয়ে যেত। অতএব, রোহিঙ্গাদের প্রশ্নে নাক ছিটকানোর কোনো কারণ নাই, বরং তাদের অধিকারকে বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশের হাত স¤প্রসারিত করা দরকার।
শরণার্থী রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়, ১৯৪৮ সালের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার মূল অধিকারগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
১. ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার অধিকার।
২. আশ্রয় প্রার্থনা ও পাওয়ার অধিকার।
৩. অত্যাচার অথবা নিষ্ঠুরতা, অমানবিক বা মর্যাদাহানিকর ব্যবহার বা শাস্তি থেকে মুক্তি।
৪. দাসত্ব বা দাসত্ববন্ধন থেকে মুক্তি।
৫. আইনের সামনে একজন ব্যক্তি হিসেবে স্বাীকৃতি।
৬. চিন্তা, চেতনা ও ধর্ম পালনের স্বাধীনতা।
৭. অবৈধ গ্রেফতার ও আটকাবস্থা থেকে মুক্তি।
৮. ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন এবং বাড়িতে অবৈধ অনুপ্রবেশ থেকে মুক্তি।
৯. মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা।
১০. শিক্ষা পাওয়ার অধিকার।
১১. সমাজের সাংস্কৃতিক জীবনে অংশগ্রহণের অধিকার।
রোহিঙ্গাদোর পুনর্বাসন বা নিজ রাষ্ট্রে ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে জাতিসঙ্ঘ সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসঙ্ঘ শুধুমাত্র রিলিফ ও উদ্বেগ জানিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করায় যাবতীয় ঝামেলা এখন বাংলাদেশকে বইতে হচ্ছে।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
Leave a Reply