1. tasermahmud@gmail.com : admi2017 :
  2. akazadjm@gmail.com : Taser Khan : Taser Khan
সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:১৯ অপরাহ্ন

নির্বাচন কমিশনারদের দৃষ্টিকটু বিতণ্ডা

রিন্টু আনোয়ার
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

জাতীয় সংসদে পাস হওয়া প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২-এর আইন গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করেছেন, যার সভাপতি হয়েছেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারক। সদস্য হিসেবে থাকবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান ও রাষ্ট্রপতির মনোনীত দ’ুজন বিশিষ্ট নাগরিক। এ দুই বিশিষ্ট নাগরিকের মধ্যে একজন হবেন নারী।

এই কমিটি সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার পদে কাউকে সুপারিশের ক্ষেত্রে কয়েকটি যোগ্যতা-অযোগ্যতার বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে। এগুলো হলো- তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। বয়স হতে হবে ন্যূনতম ৫০ বছর এবং কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধা সরকারি বা বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত পদে বা পেশায় তার অন্যূন ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। আর অযোগ্যতাগুলো হচ্ছে- আদালত অপ্রকৃতিস্থ ঘোষণা করলে। দেউলিয়া হওয়ার পর দায় থেকে অব্যাহতি না পেলে। কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিলে কিংবা বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করলে। নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট-১৯৭৩ বা বাংলাদেশ কোলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনালস) অর্ডার-১৯৭২-এর অধীনে কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হলে এবং আইনের দ্বারা পদাধিকারীকে অযোগ্য ঘোষণা করছে না, এমন পদ ছাড়া প্রজাতন্ত্রের কর্মে লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকলে।

গত শনিবার উল্লিখিত আইন অনুযায়ী ছয় সদস্যের একটি সার্চ কমিটি (অনুসন্ধান কমিটি) গঠন করেছেন রাষ্ট্রপতি। আপিল বিভাগের বিচারক বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এই সার্চ কমিটির সভাপতি থাকছেন। তিনি আগের সার্চ কমিটির সদস্য ছিলেন। হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক হিসেবে থাকছেন বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামান। মহা হিসাব নিয়ন্ত্রক ও নিরীক্ষক (সিএজি) মুসলিম চৌধুরী এবং সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন। এ কমিটিতে সাংবিধানিক সংস্থাগুলোর প্রধানদের পাশাপাশি বিশিষ্ট নাগরিক হিসেবে থাকছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন ও লেখক-অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হক।

এই সার্চ কমিটি সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার পদে যোগ্যদের অনুসন্ধানের জন্য রাজনৈতিক দল এবং পেশাজীবী সংগঠনের কাছ থেকে নাম আহ্বান করতে পারবে। নামের সুপারিশ চূড়ান্ত করে কমিশনারদের নাম প্রস্তাব করতে এ কমিটি সময় পাবেন ১৫ দিন। তাদের সুপারিশকৃত নামগুলো থেকে ইসি ও কমিশনার নিয়োগ করবেন রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ। আর নিয়োগপ্রাপ্ত এই সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররাই পরিচালনা করবেন পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনসহ সব প্রকার নির্বাচন।

বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠন হয়েছিল ২০১৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ওই দিন রাতেই প্রজ্ঞাপন জারি করে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদার নেতৃত্বে কমিশনের অপর চার সদস্য রয়েছেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব তালুকদার, সাবেক সচিব রফিকুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ কবিতা খানম এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) শাহাদৎ হোসেন চৌধুরী। মেয়াদের পাঁচ বছরে তারা ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়াও ৬০ হাজারের বেশি স্থানীয় সরকার নির্বাচন পরিচালনা করেছেন। এই নির্বাচন কমিশন ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘সব স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন আয়োজন’ করার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের শপথগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু নুরুল হুদা কমিশন পাঁচ বছর ‘সব স্বার্থের ঊর্ধ্বে’ থেকে কয়টি নির্বাচন করেছেন?

সব ঠিক থাকলে তাদের মেয়াদের ডেটলাইন সামনের বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ১৪ ফেব্রুয়ারিতে। সম্প্রতি রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন অ্যান্ড ডেমোক্র্যাসির (আরএফইডি) এক অনুষ্ঠানে তিনি তার সমালোচনা করায় এক হাত নিয়েছেন বিশেষ কয়েকজনের ওপর। একদম নাম ধরে ধরে। নাগরিক সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের সাথে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদাকেও ছাড়েননি। নতুন কিছু তথ্য দিয়ে ধরেছেন তার সহকর্মী কমিশনার মাহবুব তালুকদারকেও। আড়ালে-আবডালে নয়। একেবারে প্রকাশ্যে অনুষ্ঠানে। ভাষা কেবল আক্রমণাত্মক নয়, সাথে সাধারণদের জন্য টাটকা তথ্যও। এত দিন অপ্রকাশিত বা লুকানো থাকলেও, পুরনো হলেও ভালো রসদ দিয়েছেন গণমাধ্যমকে।

বর্তমান ইসির ভালো নির্বাচনের সদিচ্ছাই ছিল না, তারা নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে, কেবল ‘বিতর্ক সৃষ্টি করেছে’- সাবেক সিইসি ড. এ টি এম শামসুল হুদার এ মন্তব্যের জবাব দিয়েছেন তিনি চাঁচাছোলাভাবে। শামসুল হুদা আমিত্বে ভুগছেন বলে মন্তব্য ছুড়ে দিয়েছেন রকিবুল হুদা। বলেই বসেন, ২০০৭-০৮ সালে জরুরি অবস্থার সময়ের সিইসি হিসেবে শামসুল হুদা ‘বিরাজনীতির পরিবেশে সাংবিধানিক ব্যত্যয়’ ঘটিয়েছেন। ৯০ দিনের মধ্যে করার বিধান থাকলেও নির্বাচন করেছেন ৬৯০ দিন পর। এ সাংবিধানিক ব্যত্যয় ঘটানোর অধিকার তাকে কে দিয়েছে- এ প্রশ্নও ছোড়েন তিনি। প্রশ্নমালা এখানেই শেষ করেননি তিনি।

আরো যোগ করেন- ‘নবম সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনকে কিভাবে প্রার্থীদের হলফনামা প্রচারের কাজ দিয়েছেন? বদিউল আলম মজুমদারকে লাখ লাখ টাকা কিভাবে দিলেন? এই লোক দুই বছর আমার পেছনে ঘুর ঘুর করছেন। একা একা এসেছেন।… তার সাথে আলাদাভাবে আলোচনা করা যায় না, বিশ্বাস করা যায় না। উনি নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কোনো বিশেষজ্ঞ নন। সংবিধান বিশেষজ্ঞও নন। সংবাদ সম্মেলন করার বিশেষজ্ঞ।’

বক্তব্যের একপর্যায়ে আরো বলেন, আর্থিক অনিয়মসহ নানা ধরনের অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় তিনি সুজনকে কোনো কাজে সম্পৃক্ত করেননি। কারণ বদিউল আলম মজুমদারকে নিয়ে অনেক ঝামেলা, অনিয়ম। এক কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম, কাজ না করে টাকা দেয়া, নির্বাচন কমিশনে সভায় অনিয়ম নিয়ে সিদ্ধান্ত আছে। কাগজ দিয়ে বই তৈরি করেন,… এ কাজ করার কী দরকার?… এগুলো দিয়ে ঝালমুড়ির ঠোঙ্গা বানানো ছাড়া কোনো কাজ নেই।

শৈত্যপ্রবাহের এই মাঘে বাঘ না ছাড়লেও আলোচনার খোরাক সাপ্লাই হয়েছে বিদায়ী সিইসির বক্তব্যে। সহকর্মী মাহবুব তালুকদার সম্পর্কে কিছু প্রতিক্রিয়া তিনি আগেও দিয়েছেন। এবার তাকে ‘রোগাক্রান্ত’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, ইসিতে তিনি ব্যক্তিগত অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন। এই রোগাক্রান্ত মাহবুব কখনো আইসিইউতে, কখনো সিসিইউতে ছিলেন। সিঙ্গাপুর-ভারতেও চিকিৎসা নিয়েছেন। এসব চিকিৎসার ব্যয় কমিশন থেকে করা হয়। এ অর্থের পরিমাণ প্রায় ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা।

মাহবুব তালুকদার বা বদিউল আলম মজুমদার সম্পর্কে নুরুল হুদার দেয়া তথ্যের সত্যতা অবশ্যই সময়সাপেক্ষ। সত্য-মিথ্যা পরের বিষয়। কিন্তু এত তথ্য আগে জানা ছিল না অনেকেরই। তবে কেঁচোর গর্তে টোকা দিয়ে সাপ-বেজিসুদ্ধ বেরিয়ে আসার দশা হয়েছে। জবাবে বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, এসব অভিযোগ ডাহা মিথ্যা। সত্য হয়ে থাকলে সিইসি এত দিন কেন এগুলো বলেননি- এ প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। তবে মাহবুব তালুকদার জবাব দিয়েছেন লাইন ধরে ধরে। বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, নির্বাচন কমিশনার হিসেবে অসুখের যথাযথ চিকিৎসা পাওয়া তার মৌলিক অধিকার। চিকিৎসার কারণেই তিনি এখন পর্যন্ত বেঁচে আছেন। নির্বাচন বিষয়ে তার ভিন্নধর্মী অবস্থান বলতে গিয়ে সিইসি তার প্রতিহিংসাচরিতার্থ করে চিকিৎসার মতো বিষয় টেনে আনার নিকৃষ্ট পথ বেছে নিয়েছেন।

তাকে রোগাক্রান্ত ব্যক্তি বলে উল্লেখের নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, ইচ্ছা করলেই কেউ আইসিইউ বা সিসিইউতে থাকতে পারে না।

নির্বাচন কমিশনার হওয়ার সময় থেকেই প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত জানিয়ে সিঙ্গাপুর ও ভারতের চেন্নাইতে চিকিৎসা নেয়ার কথা স্বীকার করেন। নিজ খরচে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার কথাও জানান। সেই সাথে এ-ও জানান, বর্তমানে কর্মরত অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার এবং অবসরপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশনার সবাই প্রাপ্যতা ও বিধি অনুযায়ী কমিশন থেকে চিকিৎসার খরচ নিয়ে থাকেন। কে এম নুরুল হুদা নিজেও নির্বাচন কমিশন থেকে চিকিৎসার জন্য টাকা নিয়েছেন।

নুরুল হুদা ও মাহবুব তালুকদারের এসব বিতণ্ডার মধ্য দিয়ে মানুষের বাড়তি কিছু তথ্য জানা হয়েছে। আরো জানার ইচ্ছাও জাগছে। বিশেষ করে এই সাংবিধানিক ও বিশিষ্টজনদের চিকিৎসা, ফরেন ট্যুরসহ রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা হাসিলের তথ্য। এখন জাতি অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মতো আগামীর প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনাররাও কি তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন নাকি ‘সব স্বার্থের ঊর্ধ্বে’ উঠে সরকারের আজ্ঞাবহ না হয়ে জনগণের সত্যিকারের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করবেন। জাতি আবারো আশাহত হওয়ার সম্ভাবনা কতদূর সময়-ই তা বলে দেবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019-2023 usbangladesh24.com