গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক প্রতিষ্ঠার পর দর্শনার্থীদের মাঝে আশার আলো জাগালেও হঠাৎ করে অসংখ্য বিদেশী প্রাণীর মৃত্যুর ঘটনায় সবার মাঝে হতাশা বিরাজ করছে। পার্ক প্রতিষ্ঠার পর চলতি বছরই সবচেয়ে বেশি প্রাণীর মৃত্যু ঘটেছে। নানা বিষয় সামনে রেখে সরকার পার্ক ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন এনেছে। সরিয়ে দেয়া হয়েছে পার্কের প্রকল্প পরিচালক, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও চিকিৎসককে। তবে ইতোপূর্বে পার্কে নানা ধরনের প্রাণীর মৃত্যু হলেও কর্তৃপক্ষ কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়ায় এবার বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হলো।
ধারাবাহিকভাবে জেব্রা মারা গেছে ৩২টি
২০১৩- ২০১৫ সাল পর্যন্ত দুই ধাপে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে মোট ২৫টি জেব্রা আনা হয় এ পার্কে। এসব জেব্রা অবমুক্ত করার পর নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে না পেরে ২০১৫ সালের মধ্যেই ১১টি জেব্রার মৃত্যু হয়। পার্কে প্রথম জেব্রা শাবকের জন্ম হয় ২০১৭ সালের ১৪ মে। সেই থেকে ২০২১ সালের ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ২৫টি শাবকের জন্ম হয়। এর মধ্যে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন কারণে জেব্রা মারা যায় ১০টি। চলতি বছরের ২ জানুয়ারি থেকে ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত আরো ১১টি জেব্রার মৃত্যু হয়। সব মিলিয়ে পার্কে ২৫টি জেব্রা শাবকের জন্ম হলেও মারা গেছে ৩২টি জেব্রা।
‘যক্ষা রোগে’ জিরাফের মৃত্যু
এর আগে ২০১৭ সালের ১৭ মে পার্কে অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হয়ে দুটি জিরাফের মৃত্যু হয়। তখন পার্ক কর্তৃপক্ষ ময়নাতদন্ত করে বলেছিল ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণেই তারা মারা গেছে। ২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারি পার্কের একমাত্র পুরুষ জিরাফটিও মারা যায় ভুল চিকিৎসায়। যদিও জিরাফের যক্ষা রোগের কথা বলেছিলেন তখনকার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
সিংহের মৃত্যু
২০২১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর পার্কের একটি সাদা সিংহ মারা যায়। পার্ক কর্তৃপক্ষের দাবি ছিল গরমে হিটস্ট্রোকে সেটি মারা যায়। এছাড়াও গত বৃহস্পতিবার পার্কে ফের অসুস্থ হয়ে একটি সিংহীর মৃত্যু হয়।
মারা গেছে বাঘ
গত ১২ জানুয়ারি একটি বাঘের মৃত্যু হয় এই পার্কে। চিকিৎসকদের দাবি ছিল অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত হয়ে বাঘটির মৃত্যু হয়। এর পূর্বে আরো একটি বাঘের মৃত্যু হয়। তখন পার্ক কর্তৃপক্ষ দাবি করেছিল গলায় গুইশাপ আটকে তার মৃত্যু হয়েছিল।
ক্যাঙ্গারুহীন পার্ক
এছাড়াও পার্ক প্রতিষ্ঠার পর দর্শনার্থীদের জন্য বেশ কয়েকটি ক্যাঙ্গারু বিদেশ থেকে আনা হলেও ধারাবাহিকভাবে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তা এখন শূন্যতে পৌঁছেছে।
দায়সারা ময়নাতদন্ত ও কমিটি করেই ক্ষান্ত কর্তৃপক্ষ
পার্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকেই একের পর এক প্রাণীর মৃত্যু হলেও দায়সারা ময়নাতদন্ত করেই ক্ষান্ত ছিল পার্ক কর্তৃপক্ষ। প্রতিটি প্রাণীর মৃত্যুর সঠিক কারণ উদঘাটন ও মৃত্যুরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগের অভাব ছিল তাদের মধ্যে।
সদ্য পার্ক থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তবিবুর রহমান বলেন, ইতোপূর্বে প্রাণীর মৃত্যু হলেও তার মেয়াদে এই প্রথম বড় ধরনের প্রাণীর মৃত্যু হয়েছে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে। প্রাণীর মৃত্যুর পর নিয়ম অনুযায়ী ময়নাতদন্ত করা হয়। পরে বিভিন্ন স্যাম্পল কালেকশন করে তা পাঠিয়ে দেয় ল্যাবে। এছাড়াও এ সংক্রান্ত রিপোর্ট পাঠিয়ে দেয়া হয় সংশ্লিষ্ট বিভাগে। সেখানেই পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়ার কথা।
এদিকে সাফারি পার্ক সংশ্লিষ্ট নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, এই পার্কে বিদেশী প্রাণী ব্যবস্থাপনায় চরম অনিয়ম রয়েছে। জেব্রা যেখানে বসবাস করে সেখানে রয়েছে বিশাল শালবন। সেখানে জেব্রার খাবারের অনুপযোগী উদ্ভিদ ও লতাপাতা রয়েছে। রয়েছে বদ্ধ নালা। সেখানে জমে থাকা পানি রয়েছে। জেব্রার বসবাসের জন্য অনেকটা অনুপযুক্ত এই এলাকা।
এই কর্মকর্তার ধারণা, খাবার থেকেই এবার জেব্রা ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়াও জেব্রার সঙ্গেই বিচরণ রয়েছে জিরাফ, ওয়াইল্ড বিস্ট, কমন ইল্যান্ড। সঙ্গে রয়েছে শত শত বানর। পার্কের খাবার পরিবেশন করেন বিভিন্ন ঠিকাদাররা। এসব খাবার পরীক্ষা নিরিক্ষারও কোনো ভালো ব্যবস্থা নেই। এছাড়াও বিদেশী প্রাণীর বিষয়ে তেমন অভিজ্ঞতা নেই পার্কের অনেকেরই। এ বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য আমাদের দেশেও তেমন ব্যবস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি। তাই বিদেশী প্রাণী ব্যবস্থাপনায় নজর না দিলে ভবিষ্যতে আরো বড় ধরনের বিপর্যয়ে পড়তে হতে পারে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, বিদেশী প্রাণীর ব্যবস্থাপনায় ও আমাদের দেশীয় প্রাণীর ব্যবস্থাপনায় বিস্তর ফারাক রয়েছে। তাই বিদেশী প্রাণীর দিকে বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন। প্রতিটি বিদেশী প্রাণীর ব্যবস্থাপনা ও রোগ সম্পর্কে সম্মক ধারণা রাখতে হবে। সঙ্গে তাদের উপযোগী বাসস্থান, বিচরণ ভূমি, খাবার ও রোগ অনুযায়ী চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে টিকার আওতায় আনতে হবে এসব প্রাণীদের। কোনো মতেই অবহেলা করা যাবে না। একটি প্রাণীর মৃত্যুর পর দ্রুত এর কারণ উদঘাটন করে পরবর্তী প্রাণীর মৃত্যুরোধের উদ্যোগ নিতে হবে।
জাতীয় চিরিয়াখানার সাবেক কিউরেটর ড. এ বি এম শহিদুল্লাহ বলেন,কয়েক দিনের ব্যবধানে যেভাবে প্রাণীগুলোর মৃত্যু হয়েছে তা সত্যিই হতাশাজনক। প্রাথমিক অবস্থায় আমরা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণকে দায়ী করছি। এছাড়াও আরো বেশ কিছু গবেষণাগারের ফলাফল এখনো পাইনি। সব মিলিয়ে তদন্ত হচ্ছে।
তিনি বলেন, জেব্রার মৃত্যুরোধে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত প্যানেল ১০ দফা নির্দেশনা দিয়েছে। তদন্তের পর আমরা আরো পর্যবেক্ষণ দেবো।
সাফারি পার্কের নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকল্প পরিচালক মোল্লা রেজাউল করিম বলেন, এটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম একটি সাফারি পার্ক। এখানে বিদেশী নানা ধরনের বন্যপ্রাণি রয়েছে। আমাদের এখানে অনেকেই রয়েছেন বিদেশী বন্যপ্রাণির ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে তেমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তাই এসব বিদেশি বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনার কৌশলগুলো আমাদের রপ্ত করতে হবে। সেজন্য সেখানে যোগাযোগ করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
Leave a Reply