শিক্ষাজীবনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ- এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় বছরের প্রথম দিকে, যথাক্রমে ফেব্রুয়ারি ও এপ্রিলে। কিন্তু করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে এবার বছরের শেষার্ধে এসেও এখনো পরীক্ষা দুটি শুরুই করা যায়নি। গত বছরও এই মহামারীর কারণে নেওয়া যায়নি এইচএসসি পরীক্ষা। পরে সব পরীক্ষার্থীকেই বিশেষ ব্যবস্থায় অটোপাস দেওয়া হয়েছিল।
শিক্ষা প্রশাসন সূত্র বলছে, এবার আর অটোপাসের দিকে যাবে না সরকার। দেরিতে হলেও পাবলিক পরীক্ষা দুটি নেওয়া হবে। আগেই পরীক্ষার সময় ও বিষয় কমিয়ে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস প্রকাশ করা হয়েছিল। মহামারী পরিস্থিতি অনুকূলে এলে ওই সিলেবাসের ভিত্তিতে নভেম্বর ও ডিসেম্বরে পরীক্ষা দুটি নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এ লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে শিক্ষা বোর্ডগুলো।
করোনা সংক্রমণের কারণে ফেব্রুয়ারিতে চলতি বছরের এসএসসি এবং এপ্রিলে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা নেওয়া যায়নি। পরে পরীক্ষা দুটি জুন ও আগস্টে নেওয়ার পরিকল্পনা হয়। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে এই সময়েও পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে আগামী নভেম্বর ও ডিসেম্বরে পরীক্ষাগুলো নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ। গুছিয়ে নেওয়া হচ্ছে পরীক্ষা গ্রণের আনুষঙ্গিক কর্মযজ্ঞ।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নেহাল আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, দেরিতে হলেও এবারের দুই পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া হবে। দেশে করোনা সংক্রমণের কারণে গত বছর এসএসসি পরীক্ষা নেওয়া গেলেও এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা নেওয়া যায়নি। পরে বিকল্প পন্থায় ফল দেওয়া হয়েছে। তবে এবার দুটি পাবলিক পরীক্ষাই নিতে চায় সরকার। শিক্ষার্থীদের মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতি সহনীয় হলে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের আলোকে পরীক্ষা নেওয়া হবে।
বোর্ডের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পরীক্ষার্থীদের ফরম পূরণ, পরীক্ষা কেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া, উত্তরপত্র মূল্যায়নের জন্য পরীক্ষক নিয়োগ, এমনকি প্রশ্নপত্র-উত্তরপত্র পরিবহনে গাড়ি ভাড়া করাসহ পরীক্ষা গ্রহণের সব আয়োজন চলছে।
সিলেবাস কমিয়ে পরীক্ষা আয়োজন প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, অটোপাসের চেয়ে সিলেবাস কমিয়ে পরীক্ষা নেওয়া উদ্যোগ- মন্দের ভালো হিসেবে দেখছি। আমরা একটা বিশেষ সময় পার করে চলছি। এই মহামারী না হলে তো স্বাভাবিক পরীক্ষাটাই হতো। এখন বিশেষ কারণে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেমনটা হয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়। আমি শিক্ষার্থীদের বলব তোমরা লেখাপড়া থেকে যেন বিচ্ছিন্ন না থাকো। রাষ্ট্র আমাদের যেভাবেই মূল্যায়ন করার ব্যবস্থা করুক না কেন, তোমরা যেন নিজেকে ঠিকভাবেই প্রস্তুত কর।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) ডিজি অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেন, গত ৩০ মার্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পর সংক্ষিপ্ত সিলেবাস শেষ করে পরবর্তী দুই সপ্তাহ পর এসএসসি এবং এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। এসএসসির জন্য ৬০ দিন এবং এইচএসসির জন্য ৮৪ দিনে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস শেষ করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে সেই পরিকল্পনায় ব্যত্যয় ঘটে। এখন ওই সিলেবাসের ভিত্তিতেই অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হচ্ছে। নভেম্বর-ডিসেম্বর পরীক্ষা নেওয়ার লক্ষ্য রেখেই আমরা সব আয়োজন করছি। বাকিটা করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে।
সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের পরীক্ষা প্রসঙ্গে অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। কবে খুলবে তা এখনো নিশ্চিত নয়। লেখাপড়ার বাইরে থেকে ছেলেমেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে। এর মধ্যে যদি তাদের অটোপাস দেওয়া হয়- এই ‘তকমা’ তাদের সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। আমরা এটি চাই না। বাস্তবতার নিরিখে যতটা সম্ভব কম সিলেবাস দিয়ে তাদের পরীক্ষা আয়োজন করা হোক। আমরা শিক্ষার্থীদেরও টিকাদানের জোর দাবি জানাচ্ছি।
পরীক্ষা হবে যে পদ্ধতিতে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে এবার এসএসসি ও এইচএসসি-সমমানের পরীক্ষা গ্রুপভিত্তিক (বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্যসহ অন্যান্য গ্রুপ) নৈর্বাচনিক ৩টি বিষয়ে অনুষ্ঠিত হবে। আবশ্যিক ও চতুর্থ বিষয়ের পরীক্ষা নেওয়া হবে না। তবে সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে আবশ্যিক এবং চতুর্থ বিষয়ের নম্বর দিয়ে পরীক্ষার ফলে যোগ করা হবে। এসএসসিতে বাংলা, ইংরেজি, সাধারণ গণিত, আইসিটি ও ধর্ম বিষয়ে পরীক্ষা হবে না। এইচএসসিতে বাংলা, ইংরেজি ও আইসিটি বিষয়ে পরীক্ষা হবে না।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এসএম আমিরুল ইসলাম বলেন, জেএসসি এবং এসএসসি পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতে সাবজেক্ট ম্যাপিং করে আবশ্যিক বিষয় ও চতুর্থ বিষয়ের নম্বর দেওয়া হবে।
সংক্ষিপ্ত সিলেবাস ও ম্যাপিং
এসএসসি ও সমমান পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা অষ্টম শ্রেণিতে আবশ্যিক বিষয়গুলো (যেমন- বাংলা, ইংরেজি, আইসিটি ও ধর্ম) পড়েছে। এগুলো জেএসসি/জেডিসি পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হয়েছে। এইচএসসি পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা নবম-দশম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, আইসিটি ও ধর্মের মতো আবশ্যিক বিষয়গুলো পড়েছে।
এই বিষয়গুলো এসএসসি পরীক্ষায় মূল্যায়ন করা হয়েছে। কিন্তু এসএসসি ও সমমান পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের গ্রুপভিত্তিক বিষয়গুলো আগে (জেএসসি/জেডিসি পরীক্ষায়) শিক্ষা বোর্ডগুলোর পক্ষে মূল্যায়নের সুযোগ ছিল না। এ কারণে এই বিষয়গুলো মূল্যায়ন করা আবশ্যক।
এ ছাড়া আবশ্যিক বিষয়গুলোর নম্বর জেএসসি/জেডিসি পরীক্ষায় সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে এসএসসি ও সমমান পর্যায়ে নম্বর দেওয়া সম্ভব। এইচএসসি ও সমমান পর্যায়ের পরীক্ষার্থীদের জন্যও বিষয়টি একই রকম। এ ছাড়া উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে গ্রুপভিত্তিক বিষয়গুলোর মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এ কারণে গ্রুপভিত্তিক বিষয়গুলোর মূল্যায়ন জরুরি বলে মত দিয়েছে পরীক্ষা সংক্রান্ত পরামর্শক কমিটি।
Leave a Reply