পত্রিকায় প্রকাশ, ‘মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত সন্দেহে পাঁচজনকে গ্রেফতার করে সিআইডি। চক্রের সদস্যরা শত শত কোটি টাকা অবৈধভাবে উপার্জন ও বিদেশে পাচারের প্রাথমিক তথ্যও পেয়েছেন তদন্তকারীরা। এ চক্রে ৫০ জনের অধিক সদস্যের মধ্যে গ্রেফতারকৃত মুন্নু একাই শত কোটি টাকার মালিক। এক সংবাদ সম্মেলনে সহকারী পুলিশ সুপার সুমন কুমার দাস বলেন, আমরা জানতে পেরেছি, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীনস্থ একটি প্রেসে ১৯৮৮ সাল থেকে মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজের প্রশ্ন ছাপা হতো। প্রেসের সাথে প্রশ্নফাঁসকারী চক্রের একটা যোগাযোগ ছিল। প্রশ্ন প্রণয়নের সাথে যারা জড়িত তাদের সাথেও যোগাযোগ ছিল চক্রটির। এরা প্রশ্নগুলো প্রেস থেকে নিয়ে একটি বাসায় এসে পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থীদের পড়াত।
যখন থেকে প্রশ্নফাঁস তখন থেকেই স্বাস্থ্য খাতে রোপিত হয়েছে বিষবৃক্ষ যা আজ পরিণত হয়েছে মহীরুহে। অপরাধ জগতে যত ধরনের অপরাধ হয়ে থাকে, সবচেয়ে ভয়াবহ অপরাধ অবৈধ উপায়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া। এ কারণেই, ‘ইউনিভার্সিটি অব সাউথ আফ্রিকা’-এর সিংহদ্বারে লেখা রয়েছে, ‘কোনো জাতিকে ধ্বংস করার জন্য পারমাণবিক অস্ত্রের দরকার নেই- দরকার শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় প্রতারণার সুযোগ দেয়া। প্রতারণার আশ্রয়ে সৃষ্টি হওয়া চিকিৎসকের হাতে হবে রোগীর মৃত্যু, প্রকৌশলীর হাতে হবে ইমারত ধ্বংস, অর্থনীতিবিদের দ্বারা দেশ দেউলিয়া হবে, বিচারকের দ্বারা হবে অবিচার, রাজনীতিকের হাতে বিক্রি হবে দেশের সার্বভৌমত্ব- পরিশেষে একটি জাতির অবলুপ্তি।’
দুই দশক আগের কথা। নারায়ণগঞ্জ আদালতপাড়া এক এমবিবিএস চিকিৎসকের সার্টিফিকেটে ছেয়ে গিয়েছিল। যৌন ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ জনৈক চিকিৎসক বিক্রি করতেন জখমি সার্টিফিকেট। প্রতিপক্ষকে হয়রানি করার জন্য ‘শার্পকাটিং গ্রিভিয়াস’ সার্টিফিকেটের জুড়ি নেই। লোকজন ৮-১০ কিলোমিটার দূর থেকে কয়েকটা সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল পার হয়ে যৌনরোগের ডাক্তারের কাছে আসতেন জখমের সার্টিফিকেটের জন্য। এক সময় টনক নড়ে যায় কর্তৃপক্ষের। পরে নিয়ম করা হয়, তদন্তকারী কর্মকর্তা ছাড়া জখমি সার্টিফিকেট প্রদান বন্ধ। ফলে লাগাম পড়ে যৌন চিকিৎসকের সার্টিফিকেট বাণিজ্যে।
পুঁচকে এমবিবিএস ডাক্তারের জখমি সার্টিফিকেট দিয়ে মামলা করে প্রতিপক্ষকে কয়েকদিন হাজত খাটনো ছাড়া তেমন কিছু করা যায় না। পদস্থ কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সার্টিফিকেট দিয়ে একজনকে ফাঁসিতেও ঝুলানো সম্ভব। আমার জানা তেমন ঘটনার একটি উদাহরণ, দৈনিক জনতা ১৮.৪.২০০৭ সালে ‘শিরোনাম ভুয়া রিপোর্টে আরিফের মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রদান। মিথ্যা ময়নাতদন্ত রিপোর্ট ও মিথ্যা সার্টিফিকেট দিয়ে এক ডাক্তার কোটি কোটি টাকার মালিক; অবৈধ টাকায় গুডহিল হসপিটাল ও গুডহিল ডায়াগনস্টিক ফিজিওথেরাপি কমপ্লেক্স নির্মাণ। নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের ডা: আবদুল হাই কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের পাশেই গুডহিল হসপিটাল ও গুডহিল কমপ্লেক্স। এ খবরটি ৪.৬.২০০৭ তারিখে প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায়ও।
স্বাস্থ্য বিভাগে দুর্নীতি ও অনিয়ম নতুন নয়। কোনো কারণে ভাগাড়ে নাড়া পড়লে সবাই জানতে পারে স্বাস্থ্য বিভাগের অনিয়মের কথা। নয়তো অনিয়ম অনাচার বইতে থাকে অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মতো।
গত ৬ জুলাই ইতালির রোমে অবতরণ করা বাংলাদেশ বিমানের অনেক যাত্রীর কোভিড-১৯ পজিটিভ শনাক্ত হয়। ওই যাত্রীদের কাছে ‘কোভিড-১৯ নেগেটিভ’ এবং ‘ভ্রমণের জন্য নিরাপদ’ মর্মে কাগজপত্র ছিল। ওদের ঢাকায় ফেরত পাঠানো হয়। এর ফলে দেশের ভাবমূর্তি নস্যাৎ হতে শুরু করলে সরকারের টনক নড়ে যায়। নাড়া পড়ে স্বাস্থ্য বিভাগে। ঠিক এ রকম ভাগাড়ে নাড়া পড়েছিল ওয়ান ইলেভেনের প্রথম দিকেও। আজকের মতো তখনো ‘জয়নাভাইয়ের ময়না রিপোর্ট’ নামক একটি প্রবন্ধের জন্য তথ্যের আবশ্যক হওয়ায় ১৮ এপ্রিল থেকে ৯ ডিসেম্বর ২০০৭ মাত্র আট মাসের মধ্যে গোটা বিশেক পত্রিকা সংগ্রহ করেছিলাম। পত্রিকায় স্বাস্থ্য বিভাগের দুর্নীতি ও অনিয়ম সম্পর্কে যেসব প্রতিষ্ঠানের নাম পাওয়া গিয়েছিল শিরোনামসহ দুর্নীতি ও অনিয়মের সারমর্ম নিম্নরূপ। সে তালিকায় ছিল বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে, পঙ্গু হাসপাতাল, মহাখালী হেলথ টেকনোলজি, চমেক হাসপাতাল, সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ, স্বাস্থ্য সার্ভিস এবং বেসরকারি হাসপাতাল। এ ছাড়াও রয়েছে সার্টিফিকেট বাণিজ্য, কমিশন বাণিজ্য এবং অযোগ্যতাসহ প্রাইভেট প্র্যাকটিস।
বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
ইত্তেফাক পত্রিকায় গত ১৬.৮.০০৭ ইং শিরোনাম ছিল, ‘দুর্নীতির রেকর্ড গড়েছেন মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি। তিনি পুরুষকে নারী এবং নারীকে পুরুষ করা ছাড়া সবই করতে পারেন।’ ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা: নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি দীর্ঘ দুই মাসের অধিক সময় ধরে ১০৮টি দুর্নীতি অভিযোগের তদন্ত করে ৮৮টি দুর্নীতি অনিয়মের অভিযোগের প্রমাণ পায়। কেনাকাটার নামে হয়েছিল কোটি কোটি টাকা লুটপাট। ১০০ টাকার তোয়ালের ৩০০০ টাকা বিল দেখানো হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন বাস্তবায়নে যাওয়ার আগেই পুনর্মূল্যয়নের আবেদন।
দৈনিক সমকাল পত্রিকায় গত ১৯. ৯.০০৭ ইং শিরোনাম ছিল, ‘শর্ষের ভেতরে লুকানো ভূত।’ কেঁচো খুঁড়তে সাপ- পুরনো এ প্রবাদের মতো করেই চলছে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় তদন্ত প্রতিবেদনের পুনর্মূল্যায়ন। ৯ বছরের অনিয়ম দুর্নীতি তদন্তের জন্য গঠিত কমিটি বিগত পাঁচ বছরের অনিয়ম তদন্ত করে যে রিপোর্ট প্রাথমিকভাবে পেশ করেছিলেন, সে প্রতিবেদনের মধ্যেই অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি রয়েছে এমন অভিযোগ উঠায় সিন্ডিকেটের দোহাই দিয়ে গঠন করা হয় পুনর্মূল্যায়ন কমিটি। বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ডা: মোহাম্মদ তাহিরের গড়া এ পুনর্মূল্যায়ন কমিটি। কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হলো আগের কমিটির অনেক সদস্যকেই। তারা নিজেরা বাঁচতে ও দোসরদের বাঁচাতে উপস্থাপন করেছেন খণ্ডিত একটি তদন্ত প্রতিবেদন। এমনকি কমিটির কোনো কোনো সদস্যের বিরুদ্ধেও রয়েছে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ। এর পর যা হওয়ার তাই হয়েছে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল : ইত্তেফাক ২০.১১.২০০৭ ইং, শিরোনাম ঢাকা মেডিক্যালের তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকের অর্থ আত্মসাৎ মামলা। কর্মচারীদের বেতনভাতা ও কমিশনের ৮১ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতাল : দৈনিক আমাদের সময় ৭.১১.২০০৭ ইং, জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে মধ্যস্বত্বভোগী ডাক্তারদের খপ্পরে পড়ে হৃদরোগীরা সর্বস্বান্ত। ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার রিং ও ভাল্ব বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকায়।
পঙ্গু হাসপাতাল : গত ১০ জুলাই ২০০৭ দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায়- চিকিৎসক, কর্মচারী ও দালালেরা মিলে পঙ্গু হাসপাতালকে পঙ্গু করেছেন। পঙ্গু হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা: নুরুদ্দিন আহমদের অপচিকিৎসার কাহিনী। মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শিবলী নোমান বলেন, কর্তব্যে অবহেলা ও ভুল চিকিৎসায় গৃহবধূ রহিমা খাতুনের মৃত্যুর অভিযোগে ১৬ জুন শ্যামলীর জেনারেল হাসপাতালের নামে ও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা হয়েছে।
মহাখালী হেলথ টেকনোলজি : দৈনিক খবর, ৬.১০.০০৭ ইং শিরোনাম ছিল- মহাখালী হেলথ টেকনোলজিতে লুটপাট; ২০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ক্যাশিয়ার সাসপেন্ড।
চমেক হাসপাতাল : যুগান্তর ২৩.১১.২০০৭ ইং, শিরোনাম ‘যন্ত্রপাতি ক্রয় ও মেরামত চমেক হাসপাতালে পাঁচ বছরে ১৮ কোটি টাকা লোপাট’। ৩০ হাজার টাকার এসির মেরামত খরচ দেখানো হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। সারে চার হাজার টাকার ডায়াটারমি মেশিনের একটি খুচরা যন্ত্রাংশ কেনা হয়েছে ‘২৫ হাজার টাকা’য়। এসব খাতে গত পাঁচ বছরে বরাদ্দকৃত প্রায় ১৮ কোটি টাকার অধিকাংশই লোপাট হয়েছে।
সরকারি অর্থ লুটপাট করে ঠিকাদারদের পাশাপাশি হাসপাতালের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচরীও কোটি কোটি টাকার মালিক। এর মধ্যে এক কর্মকর্তা হালিশহরে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন এবং টেন্ডার শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত সামসুল হক নামের কর্মচারী হাসপাতালের পশ্চিম গেটের পাশে ‘সেবা ডায়াগনস্টিক সেন্টার’-এর পরিচালক।
সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ : ইত্তেফাক ৭.১২.২০০৭ ইং, সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়ম। মেডিসিন ইউনিটের ১৬ নং বেডের রোগী আবদুল আলিম জানান, তিনি কুমিল্লার হাইমচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। গত ১৭ দিনে তিনি বুটাপেন আর প্যারাসিটামল ছাড়া আর কোনো ওষুধ ফ্রি পাননি। একমাত্র হাসপাতালের বেডটি ফ্রি, বাকি সবকিছুই পেতে হয় টাকার বিনিময়ে। ঘুষ ছাড়া সেবা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। ব্রেন টিউমার নিয়ে নূরউদ্দিন (৪৫) ৩১ অক্টোবর সার্জিক্যাল ওয়ার্ডের ৩ নং বেডে ভর্তি হয়েছেন। কোনো ওষুধপত্রের খবর নেই। দলেদলে ডাক্তার শুধু দেখে যাচ্ছেন। গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের কালকিনির বড় চরলক্ষ্মীতে। বাড়ি থেকে দু’টি গরু বিক্রি করে ২২ টাকা এনেছিলেন। সব খরচ হয়ে বাকি আছে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। ৭ নভেম্বর কে বা কারা তার টাকা চুরি করে নিয়ে যায়।
টাকা চুরির ব্যাপারে এক ওয়ার্ডবয় ও আয়াকে সন্দেহ করায় হাসপাতালের স্টাফরা স্ত্রী নাসিমাকে মারধর করে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়। অসুস্থ স্বামীর শয্যাপাশে আসতে না পেরে হাসপাতালের সিঁড়িতে বসে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন নাসিমা। এ ধরনের চিত্র নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। কেউ কিছু বলার সাহস দেখালে জোটে লাঞ্ছনা, এমনকি প্রহারও। হাসপাতালের এক কর্মকর্তা জানান, হাসপাতালের গোটা ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে রোগীদের হয়রানি এবং সরকারি হাসপাতাল বিমুখ করে তোলার জন্য। তিনি আরো বলেন, একজন রোগী দুর্ভাগ্যবশত একবার সরকারি হাসপাতালে আসলে দুর্ব্যবহার ও হয়রানির কারণে সে দ্বিতীয়বার এখানে আসতে সাহস পায় না। ইত্তেফাক ৮.১২.২০০৭ইং, মিটফোর্ড হাসপাতালে প্যাথলজি বাণিজ্য যেন ওপেন সিক্রেট।
স্বাস্থ্য সার্ভিস : গত ২৮.৭.০০৭ ইং তারিখে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার শিরোনাম ছিল, ‘স্বাস্থ্য সার্ভিসে ব্যাপক অনিয়ম’। সহকারী অধ্যাপক থেকে সরাসরি অধ্যাপক পদে নিয়োগ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের দুর্নীতি এমন পর্য়ায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে, সেখানে কর্মরত একজন পরিচালককে অন্য শাখায় তদবিরের কাজ করতে গিয়ে ঘুষ দিতে হয়। গত পাঁচ বছর পিএসসির মাধ্যমে স্বাস্থ্য সার্ভিসের সহকারী অধ্যাপক থেকে সরাসরি অধ্যাপক পদে নিয়োগসহ সব নিয়োগের ৯৫ ভাগই দুর্নীতি, অনিয়ম ও লাখ লাখ টাকার উৎকোচ বাণিজ্যের মাধ্যমে হয়েছে। তদন্ত করতে গিয়ে একের পর এক দুর্নীতি বের হয়ে আসছে।
বেসরকারি হাসপাতাল : দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় ১২.৭.০০৭ ইং- ‘হাসপাতালকেন্দ্রিক দালাল চক্র’ শিরোনামে খবর
মোহাম্মদপুর এলাকায় বেসরকারি হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় দু’জন মারা যান। এরা হলেন- যুবলীগ নেতা জাহাঙ্গীর ও রহিমা বেগম। এ বিষয়ে থানায় হত্যা মামলা হলেও আসামি চিকিৎসকরা ধরাছোঁয়ার বাইরে।
সার্টিফিকেট বিক্রি : ইত্তেফাক ১৬.১১.২০০৭ ইং শিরোনাম- ভুয়া ডাক্তারি সার্টিফিকেট নিয়ে মালয়েশিয়া গিয়ে ফেরত এসেছে এক বছরে ১০ হাজার লোক। কোনো ধরনের পরীক্ষা না করেই তাদেরকে ‘ফিট’ সার্টিফিকেট দিয়ে দেয়া হতো। লাখ লাখ টাকা খরচ করে মালয়েশিয়া গিয়েও তাদেরকে দেশে ফিরে আসতে হয়েছে আনফিট হওয়ার করার কারণে। দেশে ফেরত আসা শ্রমিকদের পাওনা কোনো অবস্থাতেই ফেরত দিত না এজেন্টরা।
কমিশন বাণিজ্য : ইত্তেফাক ১৩.১১.২০০৭ ইং, শিরোনাম ‘বন্ধ হচ্ছে ডাক্তারদের কমিশন ব্যবসা’।
সরকারি হাসপাতালে এক্সরে ও প্যাথলজি পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও কমিশনের লোভে এক শ্রেণীর ডাক্তার রোগীদের পরীক্ষা- নিরীক্ষা করার লম্বা সিøপ ধরিয়ে দিয়ে বাইরের বেসরকারি কিনিকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। সরকারি হাসপাতালে এই কমিশন ব্যবসা এখনো রমরমা। বেশির ভাগ চিকিৎসকের প্রাইভেট চেম্বারে আগত রোগীদের পরীক্ষার নামে চলে কমিশন ব্যবসা। রাজধানীর নামীদামি প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি ও কিনিক সবচেয়ে বেশি কমিশন দিয়ে থাকে ডাক্তারদের। হাসপাতাল থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ৫০ থেকে ৬০ ভাগ কমিশন পান চিকিৎসক। একশ্রেণীর ডাক্তার প্রতি মাসে শুধু কমিশনই পান ২০ থেকে ৫০ লাখ টাকা।
অযোগ্যতা : ইনকিলাব পত্রিকায় গত ৩১.৭.২০০৭ ইং শিরোনাম- ‘কসাই ডাক্তারের কাণ্ড, শ্রমিকের হাত ও পেট দুটোই গেছে’। এক লাখ ৬০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই কসাই ডাক্তার। পঙ্গু রফিক পাষণ্ড ডাক্তারের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবিতে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে মামলা দায়ের করেছেন।
প্রাইভেট প্র্যাকটিস : সমকাল ২৭.১০.২০০৭ইং, শিরোনাম ‘চিকিৎসক যখন মানসিক রোগী’। ঘটনা হলোÑ ‘মানসিক রোগী’ হিসেবে কর্মস্থল থেকে ছুটি নিয়ে রাজশাহী ইসলামী ব্যাংক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করছেন দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা: আজিজুল হক।
চিকিৎসকদের নীতিমালা : আজকের কাগজ ১১.৮.২০০৭ ইং চিকিৎসা সংক্রান্ত আইনের পর্যালোচনার সারমর্ম। ১৯৪৯ সনের ১২ অক্টোবর লন্ডনে বিশ্ব মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক যে ঘোষণাগুলো নীতিমালা হিসেবে গৃহীত হয় তার ১ নং ও ১০ নং শর্ত নিম্নরূপ :
১। আমি নিজে দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞা করছি যে, মানবতার সেবায় আমার জীবন উৎসর্গ করব।
১০। এমনকি হুমকির মুখেও আমি চিকিৎসার জ্ঞানকে মানবতার পরিপন্থী কাজে প্রয়োগ করব না।’
১৯৪৯ সনের ১২ অক্টোবর লন্ডন ঘোষণাপত্রের আংশিক পরিবর্তন ও রদবদল করে ১৯৫৬ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের চিকিৎসকরা ‘পাকিস্তান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’ গঠন করেন। পূর্ব পাকিস্তানের ডাক্তাররা পাকিস্তান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (পূর্বাঞ্চল) আঞ্চলিক সংগঠনের মাধ্যমে সংগঠিত হয়েছিলেন যা ১৯৭১ সালে পরিবর্তন করে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন নাম করা হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, চিকিৎসা বিজ্ঞান ও এর সহযোগী বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধন। চিকিৎসা পেশার সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করা এবং অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের স্বার্থ, অধিকার ও সুযোগ সুবিধা রক্ষা করা এবং জাতীয় ও ব্যক্তিজীবনে পেশাগত, নৈতিক, সামাজিক ও পেশাগত কারণে রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনে সদস্যদেরকে উদ্বুদ্ধ করা এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রচারের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার্থে এই পেশাকে সহায়তা প্রদান। সেই সাথে চিকিৎসা শাস্ত্রের শিক্ষা ও তৎসংক্রান্ত গবেষণার উন্নয়নকল্পে পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের নীতিমালায়র ৭ নং শর্তে উল্লেখ রয়েছে ‘কোনো ওষুধ ব্যবসায়ী, কোনো কমিশন দেয়া কিংবা তাদের কাছ থেকে অনুরূপ কমিশন নেয়া’ সম্পূর্ণ বারণ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগসহ চিকিৎসকরা এসব নীতিমালা না মানার পরিণাম নিম্নরূপ।
‘ভারতে চিকিৎসা সফর’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ২০১৯ বইমেলায়। গ্রন্থের ৭৪ পৃষ্ঠায় ‘সব ডাক্তার ডাক্তার নয়’ প্রবন্ধের ৯৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে, ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশন সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালে এক লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশী নাগরিককে ভারতে যাওয়ার মেডিক্যাল ভিসা দিয়েছে। এই সংখ্যা ২০১৬ সালে ভারতগামী চিকিৎসাপ্রার্থীদের দ্বিগুণ। ২০১৫ ও ২০১৬ অর্থবছরে ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে আসা চার লাখ ৬০ হাজার রোগীর মধ্যে এক লাখ ৬৫ হাজারই বাংলাদেশী। অনেকে ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়েও ভারতে চিকিৎসা করে থাকেন।
ভারতে আসা-যাওয়াসহ ভিসাপদ্ধতি (ভিসা ফি নেই বললেই চলে) খুবই সহজ। নি¤œমধ্যবিত্তরাও চিকিৎসার জন্য ভারত চলে যায়। আমার জানামতে, ভারতের প্রতিটি হাসপাতালে রয়েছে সেন্টাল অক্সিজেন সাপ্লাই সিস্টেম (যা বাংলাদেশের একটিতেও নেই)। এখনই সতর্ক না হলে দেশের চিকিৎসকরা রোগীশূন্য হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক।
Leave a Reply