1. tasermahmud@gmail.com : admi2017 :
  2. akazadjm@gmail.com : Taser Khan : Taser Khan
সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫, ০৫:১৮ অপরাহ্ন

দুর্নীতির বিষবৃক্ষ বন অধিদপ্তরে

‍ইউএস বাংলাদেশ ডেস্ক :
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ১৪ জুলাই, ২০২৫

বন অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম ও বরাদ্দ করা অর্থ আত্মসাৎ, বদলি ও পদোন্নতিতে ঘুষ-দুর্নীতির নানা ঘটনা ঘটেছে। চারা রোপণে বরাদ্দ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। গাছের অস্তিত্ব নেই- এমন স্থানে বসানো হয়েছে সরকারি সাইনবোর্ড। পরিচর্যার অভাবে রোপিত চারাগুলোর বেশিরভাগই মারা গেছে। এ ছাড়া বদলি ও পদায়নের ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেন এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে অস্বচ্ছতার বড় ধরনের অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে। এসব অনিয়মে মূল ভূমিকায় রয়েছেন খোদ প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাথমিক তদন্তে প্রধান বন রক্ষকের ভক্ষকের ভূমিকার প্রমাণ মিলেছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, নিয়োগ-পদোন্নতি, বদলির ক্ষেত্রে অনিয়ম, বনায়ন প্রকল্পের নামে প্রতারণা করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার বিষয়টি স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছিল; এখানে সেটির একটা তথ্যচিত্র প্রকাশিত হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, যারা পূর্বে অনিয়ম-দুর্নীতি করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কখনও হয়নি। এ ছাড়া এসব অনিয়ম-দুর্নীতিতে প্রধান বন সংরক্ষকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও কর্মকর্তা রয়েছেন। এর সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও জড়িত থাকেন।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এসব দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে যারা জড়িত, তাদের সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে এমন দুর্নীতি-অনিয়ম প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। দুদক এটিকে কার্যকভাবে প্রমাণ করবে- এটাই প্রত্যাশা।

বন অধিদপ্তরের নানা অনিয়মের অভিযোগে গত ফেব্রুয়ারিতে দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিট রাজধানীর বন ভবনে অভিযান পরিচালনা করে। এ সময় প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসাইন চৌধুরী, উপপ্রধান বন সংরক্ষক এবং টেকসই বন ও জীবিক (সুফল) প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক গোবিন্দ রায়সহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। পরে এনফোর্সমেন্ট টিম প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসাইন চৌধুরীর অধীনে প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীলতার অভাব রয়েছে। বদলি ও পদায়নের ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেন এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা পাওয়া যায়নি। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তার দপ্তরের বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয়িত অর্থের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, তবে প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়মের বিষয়ে তিনি কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। এ ছাড়া বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে নির্ধারিত নীতিমালা উপেক্ষা করে আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে পদায়ন করা হয়।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম এতটাই প্রকট যে, বন বিভাগের কর্মকর্তাদের মধ্যে দায়িত্বশীলতার সংকট সৃষ্টি হয়। বদলি ও পদায়ন নীতিমালার লঙ্ঘন এবং দুর্নীতির বিস্তারের ফলে বন অধিদপ্তরের প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যক্রম কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

এনফোর্সমেন্ট টিমের দাখিল করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাথমিক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি ও পদোন্নতি ‘বন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলিসংক্রান্ত নীতিমালা, ২০০৪’ অনুসারে হওয়ার কথা থাকলেও এটি অনুসরণ করা হয়নি। বিভিন্ন বন বিভাগের রেঞ্জ ও স্টেশন পোস্টিংয়ে অবৈধ আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে বদলি ও পদায়নের তথ্য পাওয়া গেছে, যেখানে প্রধান বন সংরক্ষকের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে- মর্মে প্রতীয়মান। এ ছাড়া টেকসই বন ও জীবিকা (সুফল) প্রকল্পের অধীনে গত দুই অর্থবছরে ৮৭২ হেক্টর নার্সারি ও বনায়ন করার পরিকল্পনা থাকলেও তদন্তে দেখা গেছে, উল্লেখযোগ্য অংশে কোনো বনায়ন করা হয়নি। কিছু এলাকায় শুধু সীমানা নির্ধারণের জন্য সামান্য চারা লাগানো হয়েছে।

দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, অভিযান চলাকালে আরও জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে রামু উপজেলার জোয়ারিয়ানালা বিট এলাকায় ৫১০ হেক্টর বনভূমিতে নতুন বাগান সৃজনের বরাদ্দ থাকলেও বাস্তবে মাত্র ১৬০ হেক্টরে বনায়ন হয়েছে। একইভাবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ৩৬২ হেক্টর বনায়ন প্রকল্পেও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব প্রকল্পে অর্থের অপচয় ও আত্মসাতের ক্ষেত্রে প্রধান বন সংরক্ষকের অসহযোগিতা ও নজরদারির অভাব সুস্পষ্ট। এনফোর্সমেন্ট টিম আরও জানতে পারে, অধিকাংশ এলাকায় চারা রোপণের নামে বরাদ্দ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। যেখানে গাছের অস্তিত্ব নেই, সেখানে সরকারি সাইনবোর্ড বসানো হয়েছে। পরিচর্যার অভাবে রোপিত চারাগুলোর বেশিরভাগই মারা গেছে।

এ বিষয়ে জানাতে চাইলে প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, পদায়নের ক্ষেত্রে আমি নীতিমালা অনুসারে করেছি। এর বাইরে কিছু করা হয়নি।

প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়মের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রতিটি প্রকল্পে আলাদা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আছেন, সেখানে আলাদা ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়।

দুদকের প্রতিবেদনে উল্লিখিত অনিয়মগুলোকে ঢালাও অভিযোগ আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ওনারা যে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন, সেখানে স্পেসিফিক কোনো কিছু নেই। স্পেসিফিক ‘এই এই জায়গায়’ অনিয়ম হয়েছে; এমন কিছু বললে তখন সে বিষয়ে বলতে পারতাম। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ থেকে প্রধান বন সংরক্ষকের দায়িত্ব পালন করা আমীর হোসাইন চৌধুরী অনিয়মের অভিযোগগুলো অস্বীকার করেন।

এদিকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের আওতায় নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ নামে ৪৪৫ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পে লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। লুটপাটের অভিযোগ খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক। সম্প্রতি দুদকের সহকারী পরিচালক মো. সহিদুর রহমানকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। অনুসন্ধান কর্মকর্তা গত জুনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর, ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে বিভিন্ন নথিপত্র তলব করে চিঠি দিয়েছেন। চাহিত নথিগুলোর মধ্যে রয়েছে- নির্মল বায়ু ও পরিবেশ ফেস প্রকল্প বাস্তবায়ন সংক্রান্ত (১) ডিপিপি (২) প্রাক্কলন, (৩) প্রকল্প অনুমোদনপত্র, (৪) জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি, (৫) শিডিউল বিক্রয় রেজিস্ট্রার, (৬) দরপত্র খোলার বিবরণী, দরপত্র উন্মুক্ত পত্র ও তুলনামূলক বিবরণী, (৭) দরপত্র কমিটি গঠনপত্র ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি গঠনপত্র (একাধিক হলে সব) এবং দরপত্র মূল্যায়ন প্রতিবেদন ও সুপারিশ, (৮) প্রকল্পের খাত অনুযায়ী প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বছরভিত্তিক বরাদ্দ ও মোট বরাদ্দ অর্থাৎ অনুমোদিত প্রাক্কলন বা প্রাক্কলিত মূল্য, (৯) দরপত্র অনুমোদন পত্র, (১০) নোটিফিকেশন অব আওয়ার্ড, ঠিকাদারের সম্মতিপত্র, চুক্তিপত্র, কার্যাদেশ, (১১) প্রকল্পভিত্তিক পরিমাপ বই এবং চলতি ও চূড়ান্ত বিল, (১২) প্রকল্প সমাপ্তির পর আইএমইডি কর্তৃক পিসিআর সমাপ্তি প্রতিবেদন, (১৩) প্রকল্প সংশ্লিষ্ট নথির নোটশিটসহ অন্যান্য রেকর্ডপত্র এবং (১৪) প্রকল্পের খাত অনুযায়ী প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বছরভিত্তিক বরাদ্দ ও মোট বরাদ্দ অর্থাৎ অনুমোদিত প্রাক্কলন বা প্রাক্কলিত মূল্য ইত্যাদি।

দুদক মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বলেন, দুদকের অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় অনুসন্ধান কর্মকর্তা তার প্রয়োজনে যে কোনো নথিপত্র তলব করতে পারেন। এটি সম্পূর্ণ তার এখতিয়ার। কমিশন দালিলিক প্রমাণের ভিত্তিতেই পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেবে।

দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এরই মধ্যে বেশকিছু নথিপত্র দুদকে পৌঁছেছে। নথিপত্র যাচাই-বাছাই চলছে। অভিযোগ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র দেখে মনে হয়েছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় ধরনের অনিয়ম রয়েছে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের আওতায় মূল প্রকল্পের মোট ব্যয় ছিল ৪৪৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ৫১ কোটি ৮৪ লাখ এবং বিশ্বব্যাংকের ঋণ থেকে ৩৯৩ কোটি ১৭ লাখ টাকা ব্যয় করার কথা ছিল। কিন্তু তিনবার সংশোধনের পর ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৮০২ কোটি ৫২ লাখ টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। কিন্তু বারবার মেয়াদ বাড়িয়ে এটি শেষ করা হয় ২০১৯ সালের জুনে। প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে মোট খরচ হয়েছে ৪২৫ কোটি ৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি ৬ কোটি ৮৩ লাখ এবং বৈদেশিক ঋণের ৪১৮ কোটি ২১ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ঋণ শোধ করতে হচ্ছে জনগণকে।

২০০৯ সালে নেওয়া ‘নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ’ প্রকল্পের সময় ও ব্যয় দুটিই বৃদ্ধি করা হয়। ৬ বছরের প্রকল্প শেষ হয় ১১ বছরে। যেখানে ৪৪৫ কোটি টাকার প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ৮০০ কোটি টাকা করা হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত ৪২৫ কোটি টাকা খরচ করে প্রকল্পের ইতি টানা হয়েছিল।

জানা গেছে, সরকারি সংস্থা বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) অভ্যন্তরীণ তদন্তেও অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে। আইএমইডির তদন্ত প্রতিবেদনও দুদকের হাতে এসেছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019-2023 usbangladesh24.com