বিমা খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে ও নীতিনির্ধারণী সংস্থার ক্ষমতা বাড়াতে ‘বিমা আইন ২০২৫’ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সংশোধিত খসড়া আইনে বিমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন, পরিবারের মালিকানা সীমিতকরণ, দাবি নিষ্পত্তিতে নজরদারি এবং আইন লঙ্ঘনে কঠোর দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) এ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। কারণ বর্তমানে প্রচলিত ১৫ বছর আগের আইনটি বিমা কোম্পানির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করছে কর্তৃপক্ষ। আইডিআরএর সদস্য (আইন) তানজিনা ইসলাম জানান, ‘আইন সংশোধনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রকের কার্যক্ষমতা দৃঢ়ভাবে বাড়ানো হচ্ছে।’ সংশোধিত আইনের খসড়া অনুযায়ী, বিমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ বা তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম যদি কোম্পানি বা বিমাধারীর স্বার্থের পরিপন্থি হয়, তাহলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওই পর্ষদ পুনর্গঠন কিংবা সর্বোচ্চ দুই বছরের জন্য ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা পাবে। আরও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে- মালিকানায় সীমাবদ্ধতা : কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি বা একই পরিবারের সদস্যরা সম্মিলিতভাবে একটি বিমা কোম্পানির ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণ করতে পারবে না। দাবি নিষ্পত্তি সংকট : ২০২৪ সালে বিমা দাবি নিষ্পত্তির হার ছিল মাত্র ৫৭ শতাংশ। মোট দাবির পরিমাণ ১৬ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকার বিপরীতে পরিশোধ হয়েছে ৯ হাজার ৪৭৬ কোটি। কমিশন কাঠামো পরিবর্তন : জীবন বিমার ক্ষেত্রে প্রথম বছরের প্রিমিয়ামের ওপর কমিশন ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হবে। দ্বিতীয় বছরে কমিশন ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে, তবে পরবর্তী বছরগুলোয় তা ৫ শতাংশ থাকবে। তল্লাশি ও বাজেয়াপ্তের ক্ষমতা : সন্দেহজনক নথিপত্র থাকলে আইডিআরএ কর্মকর্তারা বিমা কোম্পানির অফিসে প্রবেশ করে তালা ভেঙে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জব্দ করতে পারবেন। প্রয়োজনে পুলিশের সহায়তা নেওয়া যাবে। মূলধনের ঘাটতি : নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে কোম্পানি যদি মূলধনের ঘাটতি পূরণ না করে, তবে নতুন পলিসি বিক্রি ও প্রিমিয়াম সংগ্রহে নিষেধাজ্ঞা, ১০ লাখ টাকা থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা ও দৈনিক ৫০ হাজার টাকা করে আর্থিক দণ্ড আরোপ করা যাবে। পরিচালনা পর্ষদে যোগ্যতা : চেয়ারম্যান বা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য ন্যূনতম ১০ বছরের ব্যবসা, ব্যবস্থাপনা বা পেশাগত অভিজ্ঞতা থাকতে হবে এবং একজন পরিচালক সর্বোচ্চ টানা ছয় বছর দায়িত্বে থাকতে পারবেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট আদিবা রহমান বলেন, ‘২০১০ সালের পর আইনটি আর সংশোধন হয়নি। খাতের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সংশোধন জরুরি হলেও যেন ক্ষমতার অপব্যবহার না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।’ সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী বলেন, ‘এই সংশোধনী খাতের জবাবদিহি ও শৃঙ্খলা ফেরাতে সহায়ক হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইনের মতো এখানেও কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং ও ইন্স্যুরেন্স বিভাগের একজন অধ্যাপক বলেন, ‘আইন সংশোধন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও বাস্তব পরীক্ষাটা হবে এর বাস্তবায়নে।’
আইডিআরএ সূত্র জানায়, খসড়া আইনটি শিগগিরই সংস্থার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে এবং এ বিষয়ে জনমত ও স্টেকহোল্ডারদের মতামত আহ্বান করা হবে। গ্রাহকদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থতার কারণে ২০২৪ সালের শেষে দেশের বিমা খাতে প্রিমিয়াম সংগ্রহের প্রবৃদ্ধি গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ৭ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০২৩ সালে এর হার ছিল ৯ দশমিক ১ শতাংশ। বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বিমা খাতে মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহ হয়েছে ১৮ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা, যা আগের বছর ২০২৩ সালে ছিল ১৭ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা। এ বিষয়ে আইডিআরএ চেয়ারম্যান আসলাম আলম বলেন, ‘ঋণের নামে বিভিন্ন ব্যাংকের মালিকরা যেমন টাকা তুলে নিয়েছেন, তেমনি ছয়টি লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মালিকরা বিনিয়োগের নাম করে গ্রাহকদের জমা করা প্রিমিয়ামের টাকা আত্মসাৎ করেছেন। কাগজে-কলমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগের কথা বললেও বাস্তবে তারা কোথাও তা বিনিয়োগ করেনি।’
Leave a Reply