বরিশালের পাটেক্স হ্যান্ডিক্র্যাফটের স্বত্বাধিকারী তানভীর হোসেন ছোট উদ্যোক্তা। ছাত্র অবস্থায় অল্প পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। পাটের ব্যাগসহ বিভিন্ন শোপিস আইটেম তৈরি ও বাজারজাত করে তার প্রতিষ্ঠান। সারাদেশে পণ্যের চাহিদা বাড়ায় ব্যবসা বড় করতে চান, তবে বাদ সেধেছে পুঁজি। ব্যাংক থেকে যে ঋণ নেবেন, সাহস পাচ্ছেন না। কারণ সেখানে রয়েছে শর্তপূরণের নানা জটিলতা।
তানভীর হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, বিভিন্ন সভা-সেমিনারে ব্যাংকাররা মিঠা কথা বললেও আবেদন করলেই বোঝা যায় ঋণ পাওয়া কত কঠিন। দুই-পাঁচ লাখ টাকা ঋণ নিতেও লাগে নানা-রকম ডকুমেন্ট। সবচেয়ে বড় ডকুমেন্ট যেটা চায়, তা হলো জমির দলিল। ব্যক্তিগত ও সামাজিক গ্যারান্টার জোগাড় করা আরও দুরূহ কাজ। আমার যদি সব ডকুমেন্টই থাকত, তাহলে সিএমএসএমই উদ্যোক্তা হতাম না, বড় ব্যবসায়ী হতাম। আসলে যে যাই বলুক, ঋণের প্রতিবন্ধকতাগুলো এখনও দূর করা যায়নি। সমস্যা রয়েই গেছে।
শুধু তানভীর হোসেন নন, এ খাতের বেশির ভাগ প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও নতুন উদ্যোক্তাদের বক্তব্য এমনই। তারা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালায় সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার কথা বলা হলেও বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তা যথাযথভাবে পরিপালন করছে না। যখন তারা ঋণের জন্য আবেদন করতে যান, তখন নানা ধরনের ডকুমেন্ট চেয়ে ঝামেলা ও ভোগান্তিতে ফেলা হয়। এতে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন শুরুতেই ভেঙে যায় অনেকের।
কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) হলো দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৩ সালের তথ্য অনুসারে, দেশে প্রায় ৭৮ লাখ সিএমএসএমই রয়েছে এবং এ খাতে দুই কোটির বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মরত। জিডিপিতে অবদান রাখছে প্রায় ২৮ শতাংশ। তবে ২০২৪ সালের অর্থনৈতিক শুমারির তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা ১ কোটি ১৮ লাখ ৭৭ হাজার, যেখানে কর্মসংস্থান হয়েছে তিন কোটি ৭ লাখ ৬১ হাজার। এসব ইউনিটের ৯৯ শতাংশই সিএমএসএমই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এ খাতের টেকসই উন্নয়ন দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু পর্যাপ্ত অর্থায়ন ও নীতি সহায়তার অভাবে এ খাতের কাক্সিক্ষত বিকাশ হচ্ছে না।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, এসএমই ও করপোরেট ঋণ এক রকম নয়। করপোরেট ঋণে ব্যাংকাররা যেভাবে চাইবে সেভাবেই ঋণগ্রহীতারা তা সমন্বয় করতে পারে। কারণ তাদের কাছে সহায়ক জামানত ও প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট থাকে। কিন্তু ছোটদের ক্ষেত্রে এসবের ঘাটতি থাকবেই। ফলে ছোটরা ঋণটা কীভাবে চায় সেটা বিবেচনায় নিতে হবে। আরেকটা বিষয়, ছোটরা ঋণ নিয়ে যথাসময়ে ফেরত দেয়। অথচ ব্যাংকাররা বড়দের ঋণ দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এর কারণ সহজেই টার্গেট পূরণ করা যায়। অনেক সময় বড়দের ঋণ দিয়ে তা এসএমই হিসেবে দেখানো হয়। এ ধরনের লুকোচুরিতে কাক্সিক্ষত বিকাশ হচ্ছে না খাতটির।
প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও নতুনদের ঋণ পাওয়া কঠিন : ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান সিলেট হাটের স্বত্বাধিকারী গোলাম রব্বানী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন সরকারের স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রামের (এসইআইপি) আওতায় ২০২৩ সালের আগস্টে প্রায় ৪০ জনের একটি দল বেসরকারি ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ নেন, যাতে তিনিও ছিলেন। প্রশিক্ষণ চলাকালে যোগ্যদের ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা। কিন্তু ওই ৪০ জনের কাউকেই ঋণ দেওয়া হয়নি। ঋণ না পেয়ে তাদের কয়েকজন বাংলাদেশ ব্যাংকে মৌখিক অভিযোগ করেন। এ বিষয়ে গোলাম রব্বানী আমাদের সময়কে বলেন, আমরা যারা অংশ নিয়েছিলাম তাদের অধিকাংশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ফিজিক্যাল অবস্থান এবং ঋণ নেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাউকেই ঋণ দেওয়া হয়নি। আসলে ছোট ও প্রকৃত ব্যবসায়ীদের জন্য ঋণ পাওয়া খুবই কঠিন। যোগাযোগ করা হলে ব্যাংকটির সিলেট শাখার এসএমই ব্যাংকিং বিভাগের প্রধান শেখ আরিফুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের দিক থেকে কিছু বলা সম্ভব না। আমরা ম্যানেজমেন্টের নির্দেশনা মেনে দায়িত্ব পালন করি।
একই প্রকল্পের আওতায় যমুনা ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ঋণ না পেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে লিখিত অভিযোগ করেন আরেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও প্রজ্ঞা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সুভাশীষ দাস। সুভাশীষ আমাদের সময়কে বলেন, আমরা এক গ্রুপে ১০ জন প্রশিক্ষণ নিই এবং তখন ৫ লাখ টাকা করে ঋণ সনদের সঙ্গেই প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। সে মোতাবেক আমি অ্যাকাউন্ট খোলা, চেকবই ও চার্জসহ ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা খরচ করি। কিন্তু শেষ দিনে আমাদের ৭ জনকে অনেক কম ঋণের ডামি চেক ধরিয়ে দেওয়া হয়। আমাকে দেওয়া হয় মাত্র ২ লাখ টাকার চেক, যা নিতে অস্বীকৃতি জানাই। তখন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আপাতত এটা গ্রহণ করুন, এরপর বাড়িয়ে দেওয়া হবে। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে আমার অ্যাকাউন্টে ঋণের টাকা ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে কোনো কারণ ছাড়াই ৫০ হাজার টাকা কেটে নেওয়া হয়। এরপর নানারকম চার্জ কাটার পর উত্তোলন করতে সক্ষম হই ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। ব্যাংকের এমন হয়রানিতে ব্যবসায় বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছি।
ওই প্রকল্পের পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক নজরুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, আমরা প্রশিক্ষণ শেষ করেই ঋণের ব্যবস্থা করে দেব এমনটি নয়। প্রশিক্ষণ নেওয়া মানে সে একটা ধাপ পার হলো। উদ্যোক্তা যতক্ষণ ঋণের উপযুক্ত না হবেন, কেউই অর্থায়ন করতে রাজি হবে না। তবে তখন যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই যোগ্যতার ভিত্তিতে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ পেয়েছেন। যারা পাননি তাদের কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন। আমরা ব্যাংকগুলোর ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে কথা বলে তা সমাধানের চেষ্টা করেছি।
আবেদনে লাগে অর্ধশতাধিক ডকুমেন্ট : সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একটি বড় ঋণ নিতে যত ধরনের ডকুমেন্ট দরকার হয়, সিএমএসএমই ঋণেও ঠিক একই রকম ডকুমেন্ট লাগে। উদ্যোক্তা ও ব্যবসার ধরন ভেদে এসব ডকুমেন্টের হেরফের হয়। এ খাতের অন্যতম প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) ২০২২ সালের শেষ দিকে সিএমএসএমই ঋণপ্রাপ্তির পদ্ধতি শীর্ষক একটি বুকলেট প্রকাশ করে। সেখানে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সিএমএসএমই ঋণ নিতে হলে একজন আবেদনকারীর কী ধরনের ডকুমেন্ট সংযুক্ত করতে হবে তার একটি তালিকা দেওয়া হয়। সেই তালিকায় ব্যবসার ধরনভেদে ৬০টির বেশি ডকুমেন্ট সংযুক্তির তথ্য উল্লেখ রয়েছে। ওই বুকলেট যখন প্রকাশ করা হয়, তখন ডিসিসিআইয়ের সভাপতি ছিলেন রিজওয়ান রাহমান। যোগাযোগ করা হলে তিনি আমাদের সময়কে বলেন, এসএমই ঋণের যে নীতিমালা আছে সেখানে দেখা যায় বিভিন্ন ধরনের কাগজপত্রের প্রয়োজন হয়, যা ব্যবসায়ীদের পক্ষে পূরণ করা কঠিন। অনেকের কাছে এগুলো থাকেই না। তাই ডকুমেন্টেশন সহজ করা জরুরি। আবার সবার কাছে জামানত থাকে না। এক্ষেত্রে ক্যাশ-ফ্লোর ভিত্তিতে অর্থায়নের সুযোগ তৈরি করতে হবে। আরেকটা সমস্যা হলো- সিএমএসএমইর কোনো ডেটাবেজ নেই। এগুলো যতদিন আমরা করতে না পারব, ততদিন এ খাতের কাক্সিক্ষত বিকাশ হবে না।
ক্ষুদ্রঋণের ডকুমেন্টেশন আরও সহজ করা দরকার বলে মনে করেন এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন মো. মুসফিকুর রহমান। তিনি বলেন, এসব বিষয়ে এসএমই ফাউন্ডেশন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। বিভিন্ন সময় কর্মশালা আয়োজন করে তাদের ডকুমেন্টেশনে সহযোগিতা করা হচ্ছে। এর বাইরে আমাদের যেসব পার্টনার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলোর সঙ্গে ডকুমেন্টেশন আরও সহজ করা নিয়ে কাজ করছি।
Leave a Reply