বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতাদের লন্ডনে বৈঠকের খবরটা বেশ তাৎপর্যবহ হলেও নেট জগতে অপ্রত্যাশিতভাবে কম গুরুত্ব পেল বলে মনে হচ্ছে। দৈনিকগুলোতেও এটা বড় জায়গা পায়নি। জামায়াত-ঘনিষ্ঠ নয়া দিগন্তে দেখলাম দ্বিতীয় পাতায় সিঙ্গেল কলামে খবরটা ছাপা হয়েছে আজ বেশ ছোট করে।
মাঠপর্যায়ে এবং ভার্চ্যুয়াল জগতে জামায়াত ও বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের পারস্পরিক আক্রমণাত্মক অবস্থানের মাঝে এই বৈঠক হলো। কোনো দল থেকে বৈঠক সম্পর্কে কোনো ব্রিফিং দেখিনি। সে রকম কিছু অনেকের প্রত্যাশা ছিল। যেহেতু বৈঠকের আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে জনমনে ব্যাপক কৌতূহল রয়েছে।
এই বৈঠক স্রেফ সৌজন্যমূলকও হতে পারে। তবে দেশের দুটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলের চার প্রধান নেতার এই বৈঠকে রাজনৈতিক প্রসঙ্গ আসার অনুমানও উড়িয়ে দেওয়া যায় না, বরং সেটা স্বাভাবিক। বিশেষ করে দেশের চলমান অবস্থায় সেটা হতে পারে। সে কারণেই হয়তো এ বৈঠকের প্রস্তাবক কে এবং এ থেকে কারা লাভবান হবে, সেটা চলমান কৌতূহলের প্রধান এক দিক হয়ে উঠেছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকে দেশের এখনকার প্রধান এই দুই দলের মধ্যে নির্বাচনের সময়সূচি এবং আরও কিছু নীতিগত বিষয়ে বেশ মতভিন্নতা চলছিল। এই মতভিন্নতা একটা পার্শ্বফল হিসেবে নির্বাচন নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তাও তৈরি হয়েছে। সামাজিক মেরুকরণও বাড়ছে।
নির্বাচনী অনিশ্চয়তার একটা সরাসরি ফল হয় বিনিয়োগ অনিশ্চয়তা। এবারকার অনিশ্চয়তার আরও দুটো বাজে ফল হচ্ছে, প্রশাসনে আলস্য ও অপেক্ষার মনোভাব এবং স্থানীয় সরকারহীন প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে উন্নয়ন-খরা। এর মাঝে আগের আমলের মার্কেট সিন্ডিকেটগুলো গা-ঝাড়া দিয়ে নানা দিকে হাত প্রসারিত করতে শুরু করছে। তারা রাজনৈতিক দল এবং প্রচারমাধ্যম জগৎকে প্রভাবিত করতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে।
এসব কারণেই, লন্ডন বৈঠকে বিএনপি ও জামায়াত নেতৃত্ব নির্বাচনের তারিখ প্রশ্নে কাছাকাছি আসতে পারল কি না, সেটা একটা জাতীয় কৌতূহলের বিষয়। নির্বাচনের তারিখ এগিয়ে আনার ব্যাপারে এই দুই দলের সমঝোতা হলে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনকে দ্রুত বিদায় নিতে হবে। আবার, নবগঠিত দলগুলোর জন্য সেটা একটা খারাপ বার্তা হতে পারে।
বিএনপি গতকালও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ না পাওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। বৈঠক শেষে মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা কোনো সুনির্দিষ্ট ডেডলাইন তাঁদের দেননি। তিনি ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেছেন। বৈঠকের ফলাফল সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘আমরা একেবারেই সন্তুষ্ট নই। আমরা পরিষ্কার করে বলেছি, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হলে দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে।’ মনে হচ্ছে তাদের দিক থেকে চাপ অব্যাহত থাকছে।
বিএনপি-জামায়াতের মাঝে সাম্প্রতিক গভীর আস্থার সংকটের মাঝে লন্ডন বৈঠকের পর এ রকম কৌতূহলও তৈরি হলো যে, ভবিষ্যতে আবারও কোনো আদলে কাছাকাছি আসবে কি না এই দুই পুরোনো মিত্র। এটা বিএনপির এখনকার মধ্যপন্থী মিত্রদের জন্য অবশ্যই একটা (দু) ভাবনার বিষয়। আবার সেটা বিএনপির ভেতরকার নেতৃত্বের ধরনেও গুরুত্বের কিছু অদলবদল ঘটাতে পারে।
বিএনপি-জামায়াতের মাঝে সাম্প্রতিক গভীর আস্থার সংকটের মাঝে লন্ডন বৈঠকের পর এ রকম কৌতূহলও তৈরি হলো যে, ভবিষ্যতে আবারও কোনো আদলে কাছাকাছি আসবে কি না এই দুই পুরোনো মিত্র। এটা বিএনপির এখনকার মধ্যপন্থী মিত্রদের জন্য অবশ্যই একটা (দু) ভাবনার বিষয়। আবার সেটা বিএনপির ভেতরকার নেতৃত্বের ধরনেও গুরুত্বের কিছু অদলবদল ঘটাতে পারে।
তারেক রহমান ইতিমধ্যে গত ৭-৮ মাসে কিছু বিষয়ে উদারনৈতিক রাজনৈতিক অবস্থানের যে ইঙ্গিত দিচ্ছেন, জামায়াতের সঙ্গে পুরোনো ধাঁচের কোনো সমঝোতায় ফিরলে তাতে নিশ্চয়ই হেরফের ঘটবে। প্রশ্ন হলো, সে রকম কিছু কি ঘটতে যাচ্ছে? জামায়াত নেতৃত্ব কোনো আসন সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছে কিনা— এ বিষয়ে আঞ্চলিক অনেক শক্তিরও কৌতূহল আছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা যে আসছেন, সেই দিকগুলোও বোধ হয় এ সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যায়। এর মাঝে ইইউ রাষ্ট্রদূতেরা বৈঠক করলেন জাতীয় নাগরিক কমিটির সঙ্গে।
এখানকার রাজনীতি নিয়ে বিদেশিদের এসব স্পষ্ট আগ্রহ ও সংশ্লিষ্টতার একটা কারণ তো অবশ্যই এটা যে, স্থানীয় রাজনীতিবিদেরা একসঙ্গে বসে জুলাইয়ের মতো ঐক্যের শক্তিতে দেশকে আর দিশা দেখাতে পারছেন না। আবার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সরকারের নৈতিক প্রভাবও কমার ইঙ্গিত দেয় এসব।
মাঠপর্যায়ে সম্ভাব্য সংস্কার নিয়ে ইতিমধ্যে আশা ও হতাশার যে টানাপোড়েন চলছে, তার ফাঁক গলে ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের কর্মী-শুভানুধ্যায়ীরা সক্রিয় হওয়ার একটা পরিসর পেয়েছেন। বিএনপি-জামায়াতের দূরত্ব বা নৈকট্য উভয়ই ওই পরিসর বাড়াবে।
মূলত অভ্যুত্থানের শক্তির অভ্যুত্থান-পরবর্তী ব্যর্থতা থেকে সেই পরিসরের জন্ম ও বিকাশ। এটা বিলম্বিত করতে পারত সংস্কার প্রশ্নে প্রধান এই দুই দল ও ছাত্র-তরুণদের সমঝোতা। লন্ডন বৈঠক সেখানে কোনো উদ্দীপনা জোগাবে কি না, সেও একটা প্রশ্ন হিসেবে আছে। ‘সৌজন্যমূলক’ বলা হলেও রাজনীতিতে সর্বশেষ বৈঠকের একটা ছাপ পড়তে বাধ্য।
গণ-অভ্যুত্থানের ছাত্র-তরুণ-শ্রমিক সংগঠকদের সঙ্গেও কি লন্ডনে এ রকম বৈঠক হতে পারে? এ রকম প্রশ্নের উত্তর কেবল ভবিষ্যৎ জানে। রাজনীতিতে একটা নতুন পর্ব এটা। গুঞ্জন রয়েছে, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কেউও লন্ডনে বিএনপির সর্বোচ্চ নেতৃত্বের সঙ্গে বসতে ইচ্ছুক।
তবে এ পর্যায়ে এও মনে পড়ছে, নিকট অতীতে আমাদের রাজনীতিবিদেরা সংলাপের মাধ্যমে কখনো পরস্পরের দূরত্ব কমাতে পারেননি। বিএনপি-আওয়ামী লীগের মাঝে নির্বাচন প্রশ্নে অতীতে একাধিক সংলাপ হয়েছিল।
মান্নান ভূঁইয়ার সঙ্গে আবদুল জলিলের, সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নানা পর্যায়ের বৈঠক আমরা দেখেছি। সেসব যে কেবল নিষ্ফলা ছিল তা-ই নয়, সংলাপের ব্যর্থতা থেকে খুব খারাপ ধরনের সহিংস পার্শ্বফল পেয়েছিল দেশ। এতে সংলাপের পক্ষগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কেউ তাৎক্ষণিকভাবে, কেউ কয়েক বছর পর। ওই সব সংলাপের ব্যর্থতা থেকে আমাদের রাজনৈতিক ব্যক্তিরা দেশের অভিভাবক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে নিজেদের সীমাবদ্ধতার নজির রেখেছেন।
সংলাপ সংস্কৃতির সফলতা নির্ভর করে ছাড় দেওয়ার মনোভাব থেকে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোতে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অভাবের কারণে সংলাপে ছাড় দিয়ে সংকট উত্তরণের ব্যাপারে কম আন্তরিকতা দেখা যায়।
অনেক সময়ই এখানে সংলাপ হয় সময়ক্ষেপণের কৌশল হিসেবে। আবার কখনো কখনো সংলাপের আড়ালে চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি। ‘বৈঠক করব এবং উভয়ে জিতব’—এ রকম মনোভাব ছাড়া চলতি সময়ের বাংলাদেশেও চলমান সংলাপগুলো কোনো ইতিবাচক ফল দেবে না। এ রকম পরিস্থিতি তৈরি হলে বিদেশিদের নাক গলানো বেড়ে যেতে পারে। এ ছাড়া অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে সংলাপ নিয়ে সংবাদমাধ্যমের উত্তেজনাও পরিস্থিতি জটিল করে। সংলাপকে ব্যর্থ করতেও সংবাদমাধ্যম ব্যবহৃত হয়।
কিন্তু এসব অতীতে বাংলাদেশ আর ফিরতে অনিচ্ছুক। এমনিতেই রাজনীতি সংলাপ ও বৈঠক অধ্যায়ে প্রবেশ করামাত্র গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর সমাজে গণমানুষের নায়ক হয়ে ওঠার বিষয়টি পেছনে পড়ে গেল। ছাত্র-শ্রমিক-জনতা জুলাইয়ে কিছু আকাঙ্ক্ষা নির্ধারণ করে দিয়েছিল। পরবর্তী আট মাসে সেই আকাঙ্ক্ষাগুলোকে আকার দিতে পারেনি প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলগুলো।
এখন সংলাপ ও বৈঠকের তোড়জোড়ে জনতার তৃতীয় পক্ষ হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অতীতের এ রকম অবস্থা সুখকর ছিল না। সে কারণেই, সংলাপের অন্ধকার টানেলে প্রবেশের আগে নির্বাচন ও সংস্কারের একটা টাইমলাইন ঘোষিত হয়ে যাওয়া উচিত। এতে এবারের পরের নির্বাচন কীভাবে হবে সে বিষয়ে সব পক্ষের একটা ঐকমত্য থাকতে হবে। নির্বাচন নিয়ে সংঘাত বাংলাদেশ আর দেখতে চায় না।
Leave a Reply