দেশের আয়কর আইন ২০২৩ এর জটিলতা কাটছে না। আইনগত জটিলতার কারণে রাজস্ব কর্মকর্তাদের নিরীক্ষা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। এই কারণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২৩ সালের জুন মাস থেকে নতুন আয়কর আইন চালু হয়েছে। দেশের করব্যবস্থা এত দিন ধরে ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশ দিয়ে চলেছে। তবে বিভিন্ন সময়ে সেই আয়কর অধ্যাদেশের সংশোধন করা হয়েছে। নতুন আইনে অটোমেশনে জোর দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি নতুন আইনে রিটার্ন জমা, করপোরেট কর, কর কর্মকর্তাদের ক্ষমতা ইত্যাদির বিষয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে নতুন আইনে কিছু জটিলতা রয়ে গেছে। এতে আয়কর আদায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন আইনের জটিলতায় এনবিআর উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কর রাজস্ব হারাচ্ছে। কারণ কর কর্মকর্তারা পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে অডিট ফাইলগুলো নিষ্পত্তি করতে পারছেন না। তারা বলেছেন যে আয়কর আইন-২০২৩ নির্বাচিত অডিট ফাইলগুলো সমাধানে অনেক ক্ষেত্রে বড় বাধা তৈরি করেছে। আইনটিকে অবাস্তব, সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল বলে এনবিআর কর্মকর্তারা মনে করছেন।
একটি নিরীক্ষায় ট্যাক্স প্রবিধান মেনে কর কর্তন করা হয়েছে বা সংগ্রহ করা হয়েছে কি না তা যাচাই করার জন্য নির্দিষ্ট ট্যাক্স রিটার্ন ফাইল নির্বাচন করা জড়িত। এ জন্য কর সংগ্রহকে সুরক্ষিত করার জন্য, অডিট ফাইল নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া সহজ করা দরকার বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন নিরীক্ষা নিষ্পত্তিগুলো এনবিআরের জন্য কর সংগ্রহের অন্যতম প্রধান উৎস। কারণ তারা করদাতাদের মধ্যে সম্মতি নিশ্চিত করতে এবং উৎসে কর কর্তনের সুবিধার্থে সহায়তা করে।
এনবিআরের আয়কর রিটার্ন অডিটের তথ্যে দেখা যায়, কর প্রশাসন ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২১,৬৯৮টি অডিট মামলা নিষ্পত্তি করে ৪৫০.৫৮ কোটি টাকা আয় করেছে ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৩,১৬১টি মামলা থেকে ৩৪০.৬৯ কোটি টাকা এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৯৪৩৫ মামলা নিষ্পত্তির মাধ্যমে ৪৩৯.৫ কোটি টাকা আয় করেছে। উল্লেখিত সময়ে কর কর্মকর্তারা ওই অডিট ফাইলগুলো নিষ্পত্তি করে সংশ্লিষ্ট অর্থবছরে ২,২৫৬.৪৪ কোটি টাকা, ৩,৭৩৯.০৭ কোটি টাকা এবং ৯০৫.০৩ কোটি টাকার কর দাবি তৈরি করেছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে, এনবিআর ইতোমধ্যে ১৬,০১৯টি অডিট মামলা অনুমোদন করা সত্ত্বেও কর কর্মকর্তারা নতুন কর আইন অনুসারে চলতি অর্থবছরে অডিট ফাইলগুলো নিষ্পত্তি করতে পারছেন না।
এনবিআরের সাবেক সদস্য (করনীতি) সৈয়দ মো: আমিনুল করিম বলেন, অডিট নিষ্পত্তিসংক্রান্ত নতুন সংযোজিত বিধান সম্পূর্ণ অবাস্তব এবং হয়রানির কারণ হতে পারে। বিধানটি করদাতাদের কর ফাঁকি দিতে উৎসাহিত করছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন এই আইনে কিছু সমস্যা আছে। যেমন- কোনো করদাতার নথি নিরীক্ষা করতে হলে জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেতে হবে। একজন করদাতার পেছনে বিভিন্ন কর অঞ্চলে একাধিক কর্মকর্তা ছুটবেন। এতে করদাতার হয়রানি আরো বাড়তে পারে। আবার সমস্যা দেখা দিলে সমাধান করছে কর বিভাগ। যেমন- নতুন আইনে প্রথমে সঞ্চয়পত্রের উৎসে কর চূড়ান্ত দায় ছিল না। এটি এখন চূড়ান্ত দায় করা হয়েছে।
একটি অডিট শুধু করদাতারা তাদের কর দায়গুলো সঠিকভাবে মূল্যায়ন করেছে এবং রিপোর্ট করেছে। অন্যান্য বাধ্যবাধকতাগুলো পূরণ করেছে কি না তা পরীক্ষা করার বাইরে থেকে যাচ্ছে। পরীক্ষার মাধ্যমে কর দাতার সম্মতি সমর্থনে, অসম্মতি রোধে এবং কর ব্যবস্থার ন্যায্যতা এবং কার্যকারিতার প্রতি করদাতাদের আস্থা বাড়াতে ভূমিকা পালন করে। সাধারণত এনবিআর আয়কর আইন-২০২৩-এর ১৮২ ধারার অধীনে জমা দেয়া মোট রিটার্নের ১০ থেকে ১২ শতাংশ প্রতি বছর অডিটের জন্য নির্বাচন করা হয়।
এনবিআর সদস্য (করনীতি) এ কে এম বদিউল আলম স্বীকার করেছেন, নতুন কর আইনে কিছু জটিল বিধান রয়েছে। এনবিআর আয়কর আইন ২০২৩ সংস্কারের জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে। আইনের বিধানগুলোকে জনগণ এবং ব্যবসাবান্ধব করার টাস্কফোর্স কাজ করছে বলে তিনি জানান।
এত দিন রিটার্ন জমার নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে সময় বৃদ্ধির আবেদন করা যেত। এ ক্ষেত্রে দুই থেকে চার মাস সময় বাড়ানো যেত। কিন্তু নতুন আইনে সেই সুযোগ রাখা হয়নি। ৩০ নভেম্বর বা নির্ধারিত সময়ের পর রিটার্ন জমা দিলে জরিমানা যেমন দিতে হবে, তেমনই কোনো কর রেয়াতও মিলবে না। যেমন- এত দিন যাতায়াত ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, ইন্টারনেট বিলসহ নানা ধরনের ভাতা পান চাকরিজীবীরা। এসব ভাতার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পর্যন্ত করমুক্ত ছিল। কিন্তু এখন ৩০ নভেম্বর বা নির্ধারিত সময়ের পর রিটার্ন দিতে গেলে এসব ভাতার অর্থ আর করমুক্ত থাকবে না।
নির্দিষ্ট সময়ের পর রিটার্ন দিলে বিনিয়োগজনিত কর রেয়াতও মিলবে না। সরকার নির্ধারিত খাত সঞ্চয়পত্র, পেনশন স্কিম, শেয়ারসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করলে বছর শেষে কর রেয়াত মেলে। পরে রিটার্ন দিলে এই করছাড় পাওয়া যাবে না। যারা প্রথমবারের মতো রিটার্ন দেবেন, তারা ৩০ নভেম্বরের পরিবর্তে ৩০ জুন পর্যন্ত রিটার্ন দিতে পারবেন। এটি আইনের নতুন সংযোজন।
নতুন আইনে প্রথমবারের মতো ছোট করদাতাদের জন্য এক পাতার রিটার্ন ফরম বানানো হয়েছে। বার্ষিক করযোগ্য আয় ৫ লাখ টাকার কম হলেই এক পাতার আয়কর বিবরণী জমা দিলেই হবে। তবে এ ক্ষেত্রে সম্পদের পরিমাণ ৪০ লাখ টাকার কম হতে হবে।
এক পাতার ওই ফরমে সব মিলিয়ে ১৬ ধরনের তথ্য দিতে হয়। এগুলো হলো নাম, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন), সার্কেল, কর অঞ্চল, করবর্ষ, আবাসিক মর্যাদা, মোবাইল নম্বরসহ যোগাযোগের ঠিকানা, আয়ের উৎস, মোট পরিসম্পদ, মোট আয়, আরোপযোগ্য কর, কর রেয়াত, প্রদেয় কর, উৎসে কাটা করের পরিমাণ (যদি থাকে), এই রিটার্নের সাথে প্রদত্ত কর, জীবনযাপন ব্যয়।
করপোরেট কর আদায় করতে কোম্পানির সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। নতুন আয়কর আইনে ট্রাস্ট ও তহবিলকে কোম্পানি হিসেবে বিবেচনায় এনে তাদের আয়ের ওপর সাড়ে ২৭ শতাংশ হারে করপোরেট কর বসানোর বিধান করা হয়েছে। আগের আইনে সমজাতীয় ধারায় শুধু ব্যক্তিসঙ্ঘ, আইনের দ্বারা সৃষ্ট কৃত্রিম ব্যক্তি এবং অন্যান্য করারোপযোগ্য সত্তার ওপর সাড়ে ২৭ শতাংশ করপোরেট কর বসত। এখন নতুন করে দু’টি খাত যুক্ত করা হয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর গোয়েন্দা সেলের (সিআইসি) মহাপরিচালক পদমর্যাদার নিচের কর্মকর্তাদের কর ফাঁকি অনুসন্ধানের ক্ষমতা দেয়া হয়নি। নতুন আয়কর আইনের ২০৪ ধারায় বলা হয়েছে, তদন্তকারী আয়কর কর্তৃপক্ষ যেকোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে কর ফাঁকির অনুসন্ধান ও তদন্ত করতে পারবেন। একই আইনের ১৯৮ ধারায় তদন্তকারী আয়কর কর্তৃপক্ষ হয়ে কারা করদাতার বিষয়ে অনুসন্ধানকারী হবেন, তা বলা হয়েছে। সেখানে সিআইসির মহাপরিচালককে শুধু এই স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। অন্য কোনো কর্মকর্তাকে এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। নতুন আইনে কর অপরাধের জন্য ফৌজদারি মামলায় পাঁচ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আগে কোনো করদাতার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে এনবিআরের বোর্ড সভায় মামলার প্রস্তাব উপস্থাপন করে অনুমোদন নিতে হতো। এখন সংশ্লিষ্ট কর অঞ্চলের কর কমিশনারের অনুমোদন নিয়েই মামলা করা যাবে।
Leave a Reply