সর্বজনীন পেনশন স্কিমে ‘প্রত্যয়’-এর যাত্রা শুরু হয়েছে গত সোমবার (১ জুলাই) থেকে। প্রায় তিন মাস আগে, যখন এটি চালু করার ঘোষণা আসে সরকারের তরফে, তখন থেকেই এর বিরোধিতা করে আসছিলেন পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তাদের বিরোধিতার মধ্যেই চালু করা হয় এ স্কিম। এর প্রতিবাদে চালুর দিন অর্থাৎ সোমবার থেকেই এটি বাতিলে পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে শুরু হয়েছে অনির্দিষ্টকালের জন্য শিক্ষকদের সর্বাত্মক কর্মবিরতি। এ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠনগুলোও। ফলে দেশের পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে ঝুলছে তালা; বন্ধ আছে শিক্ষার্থীদের ক্লাস ও পরীক্ষা। শুধু তাই নয়, এসব বিশ^বিদ্যালয়ের অধিভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও সেবাপ্রার্থীদেরও যারপরনাই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। রয়েছে সেশনজটের আশঙ্কাও।
এর মধ্যেই গতকাল জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ গণমাধ্যমে একটি প্রেস রিলিজ পাঠিয়েছে ‘সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রত্যয়-এর শুভযাত্রা ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ের স্পষ্টীকরণ’ শিরোনামে। এতে বলা হয়েছে, ইতোমধ্যে যেসব শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিরত আছেন, তারা আগের মতোই সব পেনশন সুবিধা পাবেন। এ ছাড়া সরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য আজীবন পেনশন সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইন সংশোধন করা হবে।
পেনশন কর্তৃপক্ষের দেওয়া এই প্রেস রিলিজের বিষয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষকরা বলছেন, এ বিজ্ঞপ্তিতে নতুন কিছু নেই। ‘প্রত্যয়’ স্কিমে যা বলা হয়েছে, এতেও তা-ই বলা হয়েছে। এটি বিভ্রান্তিকর এবং চলমান আন্দোলনকে স্তিমিত করার জন্যই করা হয়েছে।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের প্রেস রিলিজে যা আছে : প্রেস রিলিজে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে একটি টেকসই পেনশন ব্যবস্থায় আনয়নের লক্ষ্যে অন্যদের পাশাপাশি
স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত এবং তার অঙ্গসংগঠনের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রত্যয় স্কিম চালু করা হয়েছে। বিষয়টি স্পষ্ট করতে প্রেসরিলিজে ৯টি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে-
এক. এ বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত যেসব শিক্ষক/কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিরত আছেন, তারা আগের মতো সব পেনশন সুবিধা পাবেন।
দুই. বর্তমানে সরকারি পেনশনে আনফান্ডেট ডিফাইন্ড বেনিফিট সিস্টেমের পেনশন ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। ফলে পেনশনের যাবতীয় ব্যয় প্রয়োজন অনুযায়ী প্রদত্ত বাজেট বরাদ্দ থেকে মেটানো হয়। তবে ১ জুলাই থেকে ফান্ডেড ডিফাইন্ড কনট্রিবিউটরি সিস্টেমের পেনশন ব্যবস্থা চালু হবে, তাই বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বেতন থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণে মাসিক জমার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রত্যয় স্কিমে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা কর্মচারীর পাওয়া মূল বেতনের ১০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ৫ (পাঁচ) হাজার টাকা যা কম হয় তা কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বেতন থেকে কাটবে এবং সমপরিমাণ অর্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা প্রদান করবে। তারপর উভয় অর্থ ওই কর্মকর্তা/কর্মচারীর কর্পাস অ্যাকাউন্টে জমা হবে।
তিন. আনফান্ডেট ডিফাইন্ড বেনিফিট সিস্টেমের পেনশন ব্যবস্থায় সরকারের আর্থিক সংশ্লেষ ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়, যা দীর্ঘমেয়াদে কোনোক্রমেই টেকসই ব্যবস্থা নয়। অন্যদিকে ফান্ডেড কনট্রিবিউটরি পেনশন সিস্টেমে প্রাপ্ত কনট্রিবিউশন ও বিনিয়োগ মুনাফার ভিত্তিতে একটি ফান্ড গঠিত হবে। তাই এটি দীর্ঘমেয়াদে একটি টেকসই পেনশন ব্যবস্থা। উল্লেখ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও ২০০৪ সাল থেকে ফান্ডেড কনট্রিবিউটর পেনশন ব্যবস্থা চালু আছে।
চার. নতুন পেনশন ব্যবস্থাপনা প্রবর্তনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সব টেকসই সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর মধ্যে আনা সম্ভব হবে। এতে ফিন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
পাঁচ. কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আবেদনের পর নিজ বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে একই পদে বা উচ্চতর কোনো পদে নিয়োগ পেলে তিনি সার্ভিস প্রটেকশন ও পে-প্রটেকশনপ্রাপ্ত হন, তাই এটিকে নতুন নিয়োগ হিসেবে গণ্য করা হয় না। সে ক্ষেত্রে তার বিদ্যমান পেনশন সুবিধার আওতায় থাকার সুযোগ থাকবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও কর্মচারী, যারা ২০২৪ সালের ১ জুলাই ও তার পরবর্তী সময়ে নতুন নিয়োগ পাবেন, কেবল তারা প্রত্যয় স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হবেন।
ছয়. সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইনে ৬০ বছর বয়স থেকে পেনশন প্রাপ্তির উল্লেখ থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ৬৫ বছর থেকে অবসরে যাবেন। তাই ৬৫ বছর থেকে আজীবন পেনশনপ্রাপ্ত হবেন। এ ক্ষেত্রে সরকার আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করবে।
সাত. লাম্পগ্রান্ট ও পিআরএল অর্জিত ছুটি প্রাপ্যতার ভিত্তিতে প্রদান করা হয়, তাই ছুটি জমা থাকা সাপেক্ষে তা বহাল থাকবে।
আট. কনট্রিবিউটরি পেনশন সিস্টেমে অংশগ্রহণকারীর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এককালীন নয়, বরং মাসিক পেনশনের যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ নির্ধারণ করাই অগ্রগণ্য, তাই এ ক্ষেত্রে আনুতোষিকের ব্যবস্থা রাখা হয়নি বরং বিদ্যমান মাসিক পেনশনের কয়েকগুণ বেশি মাসিক পেনশন প্রদানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রত্যয় স্কিমে মাসিক পাঁচ হাজার টাকা বেতন থেকে কাটা হলেও একই পরিমাণ অর্থ প্রতিষ্ঠান জমা দিলে ৩০ বছর পর একজন পেনশনার প্রতি মাসে ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৬০ টাকা হারে আজীবন পেনশন পাবেন। তার নিজ আয়ের মোট জমাকৃত অর্থের পরিমাণ ১৮ লাখ টাকা এবং তিনি যদি ১৫ বছর ধরে পেনশন পান সে ক্ষেত্রে তার মোট প্রাপ্তি হবে ২ কোটি ২৪ লাখ ৩৮ হাজার ৮০০ টাকা, যা তার জমার প্রায় ১২ দশমিক ৫ গুণ। পেনশনার পেনশনে যাওয়ার পর ৩০ বছর জীবিত থাকলে তার জমার প্রায় ২৫ গুণ অর্থ পেনশন পাবেন। এবং
নয়. বিদ্যমান ব্যবস্থায় পেনশনার আজীবন পেনশন পান। তার অবর্তমানে পেনশনারের স্পাউজ (পতি/পত্মী) ও প্রতিবন্ধী সন্তান আজীবন পেনশন পান। নতুন পেনশন ব্যবস্থায়ও পেনশনার আজীবন পেনশন পাবেন। পেনশনারের অবর্তমানে তার স্পাউজ বা নমিনি পেনশনারের পেনশন শুরুর তারিখ থেকে ১৫ বছর হিসাবে যে সময় অবশিষ্ট থাকবে সে পর্যন্ত পেনশন পাবেন। যেমন- একজন পেনশনার অবসরে যাওয়ার পর পেনশন ভোগরত অবস্থায় পাঁচ বছর পেনশন পেয়ে তারপর মারা গেলেন। এ ক্ষেত্রে তার স্পাউজ বা নমিনি আরও ১০ বছর পেনশন পাবেন।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের এই ব্যাখ্যার প্রতিক্রিয়ায় গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বলেন, ‘এ বিজ্ঞপ্তিতে নতুন কিছু নেই। প্রত্যয় স্কিমে যা বলা হয়, এতেও তা বলা হয়েছে। তিনি বলেন, বিজ্ঞপ্তিটি বিভ্রান্তিকর এবং আমাদের চলমান আন্দোলনে ব্যাঘাত ঘটাতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এগুলো করা হচ্ছে।’
সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয়’ স্কিমের প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সুপার গ্রেডে অন্তর্ভুক্তি এবং স্বতন্ত্র বেতন স্কেল চালুর দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষকরা। অনির্দিষ্টকালের সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে গতকাল দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) বন্ধ ছিল ক্লাস-পরীক্ষা কার্যক্রম। বন্ধ ছিল কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, প্রশাসনিক ভবন ও অ্যাকাডেমিক ভবনগুলো। এতে ভোগান্তিতে পড়েন বিশ্ববিদ্যালয়, অধিভুক্ত-উপাদানকল্প ১৯৮ কলেজের শিক্ষার্থী ও সেবাপ্রার্থীরাও। এ দিন কলাভবনের মূল ফটকে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষকরা।
কর্মসূচিতে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব অধ্যাপক নিজামুল হক ভূঁইয়া জানান, আন্দোলনের দ্বিতীয় দিনেও সরকারের পক্ষ থেকে কেউ যোগাযোগ করেনি শিক্ষকদের দাবির বিষয়ে। তিনি বলেন, সারাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর্মবিরতি পালন করেছেন। দাবি না মানা পর্যন্ত সর্বাত্মক কর্মবিরতি চলবে।
শিক্ষকদের সঙ্গে আন্দোলনে নেমেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদও। গতকাল সকাল ৯টায় ঢাবি প্রশাসনিক ভবনের প্রবেশপথে জড়ো হয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আন্দোলন শুরু করেন। এরপর তারা ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন প্রশাসনিক ভবনের সামনে। সংগঠনের আহ্বায়ক ও ঢাবি অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুল মোতালেব বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ১৯৭৩ সালের আদেশে চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পেনশন কাঠামো রয়েছে। আমাদের ওপর এ পেনশন স্কিম চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা আমাদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ। অবিলম্বে এই পেনশন স্কিম প্রত্যাহার করতে হবে।
ববির কর্মসূচিতে দুপক্ষের মারামারি : সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয়’ স্কিমের প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহারসহ তিন দফা দাবিতে গতকাল দ্বিতীয় দিনের মতো কর্মবিরতি পালন করেছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এদিকে কর্মসূচি পালনকালে কর্মকর্তাদের বিবদমান দুপক্ষের মধ্যে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে মারামারিও হয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে ববি প্রশাসন।
ভোগান্তিতে বেরোবি শিক্ষার্থীরা : শিক্ষকদের সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে স্থবিরতা নেমে এসেছে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। গতকাল দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি পালন করে শিক্ষক সমিতি। শিক্ষকদের আন্দোলনের কারণে বন্ধ রয়েছে সব ধরনের ক্লাস-পরীক্ষা।
Leave a Reply