এবার কোরবানির ঈদ ঘিরে বাংলাদেশে চোরাই পথে বিপুল সংখ্যক গরু ঢুকছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
এতে দেশীয় গবাদিপশুর মধ্যে নানারকম রোগ ছড়িয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ খামারিদের। তাছাড়া লোকসানের আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে তাদের মধ্যে।
ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশন বলছে, গত এক মাসে দেড় লাখের মতো গরু প্রবেশ করেছে দেশে।
তবে আগে এই চোরাচালানে পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্ত ব্যবহৃত হলেও এখন পূর্বদিকের সীমান্তগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
অবশ্য ঈদ-উল আজহার জন্য চাহিদার তুলনায় বেশি পশু প্রস্তুত আছে বলে দাবি প্রাণিসম্পদ মন্ত্রীর।
তিনি জানিয়েছেন, এক কোটি ৩০ লাখ গরু প্রস্তুত আছে। সারাদেশে চাহিদা এক কোটি সাত লাখ। অর্থাৎ, চাহিদার তুলনায় প্রায় ২৩ লাখ গরু উদ্বৃত্ত আছে।
তারপরও চোরাই পথে গরু আসা থেমে নেই। যদিও, স্থানীয় পর্যায়ে পুলিশ প্রশাসনের তরফে এ ধরনের তথ্যের ভিত্তি নেই বলে জানানো হচ্ছে।
এদিকে বাজারে নেতিবাচক প্রভাবের শঙ্কা খামারিদের সংগঠনের।
কী পরিমাণ গরু আসছে?
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত ভারত ও মিয়ানমার থেকে গরু আসছে বাংলাদেশে।
যে কয়েকটি সীমান্ত দিয়ে গরু আসছে বলে জানা যাচ্ছে, তার অন্যতম বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি।
সেখানকার বাসিন্দা মাইনুদ্দিন খালেদ বিবিসি বাংলাকে জানান, মিয়ানমার থেকে গরু আসছে এই সীমান্ত দিয়ে।
‘৭০ কিলোমিটার সীমান্তের কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার গরু আসছে। রাতের বেলা এগুলো সীমানা পার করা হয়ে থাকে,’ বলেন তিনি।
এসবের সাথে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের জড়িত থাকার অভিযোগ করেন খালেদ।
তবে নাইক্ষ্যংছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল আবসারের দাবি, কোনো এলাকায় এই ধরনের কর্মকাণ্ড চললে জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে সম্পৃক্ততার অভিযোগ নতুন নয়।
‘কিন্তু, এর কোনো তথ্য প্রমাণ কেউ দিতে পারবে না,’ দাবি তার।
তিনি জানান, গরু আনার পর সেগুলোকে স্থানীয় বাজারে তোলা হয়। তারপর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়।
অবশ্য চোরাই পথে আনা পশুর সংখ্যাটা দুই তিনশোর বেশি নয় বলে জানান তিনি।
একই অবস্থা কুমিল্লা সীমান্তেও।
সেখানে সীমান্তের কালভার্ট ভেতর দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু ঢুকছে বলে জানান স্থানীয় সাংবাদিক রুবেল মজুমদার।
‘পুশ করার পর’ (ঠেলে দেয়ার পর) সীমান্তের আশেপাশের খামারগুলোতে গরুগুলোকে নিয়ে যাওয়া হয়।
‘খামারে নিয়ে যাওয়ার পর দেশি গুরুর সঙ্গে মিলে মিশে বাজারজাত করা হয়,’ বলছিলেন রুবেল মজুমদার।
বেশ কয়েকজনের একটি চক্রের কথাও জানান তিনি। যদিও এর সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
এর মধ্যে এক ব্যবসায়ী একদিনেই পাঁচ থেকে ছশো গরু নিয়ে আসছেন বলে জানান রুবেল মজুমদার।
বাংলাদেশে যত পশু কোরবানি হয়, একটা সময় তার বড় অংশটি আসতো প্রতিবেশী ভারত থেকে।
কিন্তু ২০১৪ সালে ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে গরু আসা বন্ধে সীমান্তে কড়াকড়ি করা হয়।
২০২২ সালে বিএসএফ এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিল, আগের তিন বছরে বাংলাদেশে পাচারের উদ্দেশ্যে নেওয়া ৩৭ হাজার গরু উদ্ধার করে তারা।
ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইমরান হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, আগে ৬৫ শতাংশ কোরবানির গরুই ভারত থেকে আসতো। কিন্তু কড়াকড়ির পর দেশে খামারের সংখ্যা ও উৎপাদন বাড়তে থাকে।
’এর ফলে ভারত থেকে পশু আনার সেই সংখ্যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শূন্যের কাছাকাছি চলে আসে,’ বলেন ইমরান হোসেন।
গত কিছু দিন ধরে পাচার বেড়ে যাওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেন তিনি।
অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য উল্লেখ করে ইমরান হোসেন বলেন, দেড় লাখ গরু ইতোমধ্যে দেশের বাজারে প্রবেশ করেছে।
‘সামনের কয়েক দিনে এই সংখ্যা আরো বাড়বে,’ আশঙ্কা তার।
তার দাবি, কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের লাভের জন্যই পাচার বন্ধ হচ্ছে না।
তবে, চুয়াডাঙ্গা, যশোরের মতো রুটগুলো দিয়ে আর আগে মতো গরু পাচার হচ্ছে না বলে দাবি স্থানীয়দের।
জেলার দামুড়হুদা সীমান্তের বাসিন্দা মাহমুদুল হাসান বিবিসি বাংলাকে বলেন, এই সীমান্ত দিয়ে এখন কোনো গরু আসছে না।
তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ি বর্ডার লাগোয়া। এখানেও চাষীদের গরুর চাহিদাই বেশি।’
‘ছড়াচ্ছে রোগ, ক্ষতিগ্রস্ত হবেন প্রান্তিক চাষীরা’
গবাদি পশুর জন্য মারাত্মক দু’টি রোগ লাম্প স্কিন ডিজিজ এবং ক্ষুরা রোগ।
পাচার বন্ধ থাকায় এতোদিন এই রোগদুটির প্রাদুর্ভাব কম ছিল বলে জানান ডেইরি ফার্মার্স’ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি।
তবে, এখন আবার এসব রোগের বিস্তার ঘটছে বলে দাবি তার।
‘এতে খামারিদের ঘরের গুরুগুলো রোগাক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে।’
ইমরান হোসেন কুষ্টিয়া-চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের খামারিদের উদ্ধৃত করে জানান, অন্যান্য বছর নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ইত্যাদি এলাকা থেকে বেপারিরা যেতেন গরু আনতে।
‘তাদের চাহিদার জন্য ভালো দাম পেতেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু, এবার চট্টগ্রাম ও আশেপাশের অঞ্চলের বেপারিদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে,’ যোগ করেন তিনি।
বড় খামারিদের ওপর পাচার হয়ে আসা গরুর প্রভাব তেমন পড়বে না দাবি করে ইমরান হোসেন বলেন, বড় খামারিরা শৌখিন গরু প্রস্তুত করে। তাদের ক্রেতা আলাদা।
‘ছোট খামারিরা যারা মাঝারি আকার ও দামের গরু নিয়ে আসেন, ভারত-মিয়ানমার থেকে কম দামের গরু ঢুকলে, তারা ক্রেতা হারাবেন।’
ক্রেতারা কিভাবে পাচার করে আনা গরু চিনবেন? এমন প্রশ্নে ইমরান হোসেন বলেন, “সেসব গরু সাধারণত জীর্ণশীর্ণ হয়। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ‘যেনতেনভাবে’ আনা হয় বলে, দুর্বল হয়ে পড়ে এসব পশু।”
সরকার কী বলছে?
মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার সীমান্ত রয়েছে।
দেশটির রাখাইন রাজ্য থেকে এই দুই জেলার সীমান্তের কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে গরু পাচারের কথা জানান স্থানীয়রা।
তবে বান্দরবানের পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন বিবিসি বাংলাকে বলেন, নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের অপর পাশে মিয়ানমারে এখন যুদ্ধ চলছে। এই পরিস্থিতিতে চোরাচালানের সুযোগ নেই।
স্বাভাবিক সময়েও চোরাচালান প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর থাকে বিধায় এ ধরনের ঘটনা ঘটে না বলে জানান তিনি।
গরু পারাপারের বিষয়ে সীমান্তগুলোতে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর শিথিল মনোভাবের অভিযোগ রয়েছে।
প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আবদুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেছেন, এইদেশে চোরাই পথে অনেক কিছুই আসে।
তিনি বলেন, ‘সীমান্তরক্ষীদের চোখের আড়ালে হয়তো কিছু আসতে পারে। কিন্তু, আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছি, সীমান্ত রক্ষীবাহিনী যারা আছে তারা যেন আরো তৎপর হয়।’
গরু আমদানি না করার ক্ষেত্রে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে তার দাবি, ‘(চোরাচালানের কারণে) খামারিরা পথে বসে যাওয়ার কোনো কারণই নেই।’
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply