আল্লাহর পক্ষ থেকে একমাত্র মনোনীত ও বিজয়ী দ্বীন হচ্ছে আল-ইসলাম। অথচ আজ পৃথিবীব্যাপী এক চরম সঙ্কট ও বিপর্যস্ত সময় পার করছে মুসলিম উম্মাহ। একসময় ঘোড়ার ক্ষুরে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ তুলে দুনিয়া দাপিয়ে বেড়িয়েছে যে জাতি, আজ তারা ভেজা বিড়াল হয়ে একান্তে নিভৃতে আপন ক্যারিয়ার গঠনে ব্যস্ত!
এই পৃথিবীতে সভ্যতার আলো দেখিয়েছে যে মুসলিম জাতি, তারা আজ পাশ্চাত্যের মগজ দিয়ে চিন্তা করে, তাদের চোখ দিয়ে দেখে, তাদের কান দিয়ে শোনে, তাদের রুচি অনুযায়ী আহার করে। পাশ্চাত্যের অপপ্রচারে আল্লাহর ফরজ বিধানের ‘জিহাদ’ নাম মুখে উচ্চারণ করতেও ইতস্তত বোধ করে। এমনকি এরা এতটাই আত্মকেন্দ্রিক হয়েছে যে, ক্যারিয়ারকে নিজেদের প্রভু বানিয়ে অনেক ক্ষেত্রে নিজের মুসলমান পরিচয়টুকু পর্যন্ত আড়াল করে রাখতে কুণ্ঠা বোধ করে না।
কেন এই অধঃপতন? কেনই বা উম্মাহ এতটা চেতনাহীন হয়ে পড়েছে? কোথায় হারিয়ে গেল খাব্বাব, খুবাইব, বিলাল, সুমাইয়া রা:-এর মতো দীপ্ত ঈমানের অধিকারী সেই মানুষগুলো? আবু বকর, ওমর, ওসমান, আলী রা:-এর মতো মুত্তাকি রাজনীতিবিদ, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ, মুয়াজ ইবনে জাবাল রা:-এর মতো বিজ্ঞ আলেম-ফকিহ, খালিদ বিন ওয়ালিদ রা:, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী, মোহাম্মদ বিন কাসিমের মতো বীর যোদ্ধা; ওমর খৈয়াম, আল বিরুনিরা কোথায় হারিয়ে গেলেন? কেন আজ তাদের শূন্যতায় হাহাকার করছে এ ধরণী? হাসান বিন সাবিত, আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা, হাফিজ রুমি, ইকবালরা কেন লিখছে না আজ আর বিজয়ের মহাকাব্য?
এর অন্যতম প্রধান কারণ রব্বে কারিমের প্রথম নির্দেশ আমরা অগ্রাহ্য করে চলছি, যা বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত রাসূলে আকরাম সা:-এর ওপর সর্বপ্রথম ওহি করা হয়েছে। ‘ইকরা-পড়ো’। আমরা ভুলে গেছি জ্ঞানার্জন করাকে আল্লাহ আমাদের জন্য ফরজ করে দিয়েছেন। ভুলে গেছি বিশ্বমানবতাকে পথনির্দেশ করার জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা পবিত্র কুরআন নাজিল করেছেন এবং এর বাস্তব নমুনা হিসেবে মুহাম্মাদ সা:-কে একমাত্র অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যিনি চরম অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি সমাজকে আলোকিত করেছেন ওহির জ্ঞান দিয়ে। তৈরি করেছিলেন ‘দারুল আরকাম’ নামক প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যা ‘মসজিদে নববী’ ও ‘সুফফা’য় বিস্তৃতি লাভ করেছিল।
এই প্রতিষ্ঠান থেকেই তিনি তৈরি করেছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা:-এর মতো কুরআনের জবরদস্ত গবেষক ও কারি; তৈরি করেছিলেন আবু হুরায়রা ও আয়েশা রা:-এর মতো হাদিস বিশারদ; ইবনে মাসউদ, মুয়াজ ইবনে জাবাল রা:-এর মতো ফকিহ। যার ধারাবাহিকতায় তৈরি হয়েছিলেন ইমাম আবু হানিফা, ইমাম শাফেয়ি, মালেক ও আহমদ ইবনে হাম্বল। তৈরি হয়েছেন ইমাম বুখারি, ইমাম মুসলিমসহ অসংখ্য হাদিস বিশারদ, আলিম, ফকিহ, গবেষক।
অথচ এই উম্মাহর মধ্যে আজ পাঠকের সঙ্কট, লেখকের সঙ্কট, গবেষকের সঙ্কট। হাজারো কাজের ভিড়ে বই পড়ার সময় কোথায়? উম্মাহর সদস্যরা আজ নিজেকে নিয়ে বড্ড ব্যস্ত। ক্যারিয়ার, খেলাধুলা, বিনোদন ও বিলাসিতাই যেন জীবনের প্রধান ও একমাত্র উদ্দেশ্য। বিশেষ করে যুবসমাজ আজ সবচেয়ে বেশি উদাসীন, সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্ত ও নৈতিকতাহীন হয়ে পড়েছে। যুবসমাজের একটি বড় অংশ আজ পাশ্চাত্যের বস্তাপচা ধ্যানধারণায় নিমজ্জিত হয়ে বস্তুবাদ ও নাস্তিক্যবাদের দিকে দ্রুত বেগে ধাবিত হচ্ছে। অথচ ইউরোপা-আমেরিকাকে সভ্যতা শিখিয়েছে মুসলমানরা। আজকের আধুনিক ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তৈরি হয়েছে সেলজুক সাম্রাজ্যের বিখ্যাত নিজামিয়া মাদরাসার অনুকরণে, যেটি তৈরি করেছিলেন তৎকালীন সেলজুক মন্ত্রী আবু আলী হাসান ইবনে আলী ওরফে নিজামুল মুলক (১০১৮-১০৯২)। সেখান থেকেই তৈরি হয়েছিলেন উম্মাহর দুই কিংবদন্তি সুলতান নুরউদ্দিন জিঙ্কি রহ. ও ‘কুদস’ বিজয়ী গাজী সালাহউদ্দিন আইয়ুবী রহ:।
আজ আমরা ইতিহাস ভুলে, ঐতিহ্য ভুলে চেতনাহীন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি স্বার্থের দুনিয়ায়। অথচ মুসলিম উম্মাহ এক গভীর সঙ্কটময় মুহূর্ত অতিক্রম করছে। এই সময়ে দ্বীনের প্রকৃত জ্ঞান, মুসলিমদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, ঈমানি চেতনা জাগ্রত করতে ও বিজয়ের পথে হাঁটতে উম্মাহর পাঠকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। কেননা, জ্ঞান বিজয়ের পথকে সুগম করে, অনুপ্রেরণা জোগায়, বিজয়ের পর সেটি সংরক্ষণ করতে ভূমিকা পালন করে।
এ বিষয়টি সবচেয়ে ভালো উপলব্ধি করেছিল মোঙ্গল-তাতাররা। তাই তো তারা সবচেয়ে বেশি আঘাত হেনেছিল মুসলিমদের লাইব্রেরিগুলোতে। লাখ লাখ মানুষ হত্যার পাশাপাশি তারা বাগদাদের বিখ্যাত ও বিশ্বের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি ‘দারুল হিকমাহ’ ধ্বংস করেছিল। মানব সভ্যতার মহামূল্যবান বইগুলো একে একে ফোরাত নদীতে ফেলেছিল। বইয়ের স্তূপে ফোরাতের স্রোত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল নদীর পানির রঙ।
কিন্তু জ্ঞানের শক্তি, বিশেষ করে কুরআনের জ্ঞান এতটাই শক্তিশালী যে, মোঙ্গল তাতারদের হাতে বন্দী থাকা মুসলিমদের (যাদের বেশির ভাগই ছিল নারী) দাওয়াতে মাত্র ৪০ বছরে মধ্যে তারা নিজেদের লালিত ঐতিহ্য, সাম্রাজ্য, সভ্যতাকে বিসর্জন দেয়, স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুসলমান হয়ে যায়। কী অসাধারণ ক্ষমতা বইয়ের!
অথচ আজ মুসলিম উম্মাহর তরুণ-যুবকদের মধ্যেই বই পড়ার প্রবণতা সবচেয়ে কম। কী লজ্জা! কী নির্মম পরিণতি! কী নিদারুণ মানসিক বিকৃতি! এসব নিয়ে ভাবতে গেলে ক্রোধে-আক্রোশে, অনুতাপে আর অনুশোচনায় চেতনা বিবশ হয়ে আসে যেন। চোখ ফেটে অশ্রু বেরিয়ে আসে, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়!
তাই আসুন নিজেদের অবস্থানটা বুঝার চেষ্টা করি। এই বিপর্যয়কর অবস্থা কাটিয়ে উঠতে হলে, নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে হলে আশ্রয় নিতে হবে বইয়ের কাছে। অবগাহন করতে হবে জ্ঞানের সাগরে।
আসুন পাঠক হই। পাঠক হই কুরআনের, হাদিসের, ইসলামী সাহিত্যের, জ্ঞান ও বিজ্ঞানের, ইতিহাসের, দর্শনের।
লেখক :
সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক
Leave a Reply