ইসরাইলের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ঘোষণা করতে আগামীকাল বুধবার ইসরাইল যাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি এর পর জর্ডানও যাবেন বলে জানানো হয়েছে। চলমান ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ আঞ্চলিক লড়াইয়ে পরিণত হতে যাচ্ছে, এমন আশঙ্কার মধ্যেই বাইডেন ইসরাইল সফরের ঘোষণা দিয়েছেন।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিনকেন ঘোষণা করেছেন, গাজা উপত্যকায় মানবিক পরিস্থিতি ভয়াবহ অবস্থায় উপনীত হওয়া, হামাসকে নির্মূল করতে গাজায় ইসরাইলের সম্ভাব্য স্থল হামলার প্রস্তুতির প্রেক্ষাপটে এই সফর হচ্ছে।
উল্লেখ্য, মার্কিন ও ইসরাইলি কর্মকর্তারা ৭ অক্টোবর ইসরাইলের অভ্যন্তরে হামাসের হামলাকে হলুকাস্টের পর ইহুদিদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে প্রাণঘাতী আক্রমণ মনে করছেন।
বাইডেন সফরকালে ইসরাইলের প্রতি সমর্থনের প্রবলতম বার্তা দেবেন। তার ডেমোক্র্যাটিক প্রশাসন সামরিক সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, মার্কিন বিমানবাহী রণতরী পাঠিয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, তারা ইসরাইল ও ইউক্রেনকে আরো দুই বিলিয়ন ডলার সহায়তা প্রদান মঞ্জুর করার জন্য কংগ্রেসের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে পেন্টাগন জানিয়েছে, তাদের দুই হাজার সৈন্য ইসরাইলে মোতায়েনের জন্য পাঠানো হচ্ছে। তারা ইসরাইলের সহায়তায় কাজ করবে। তবে তারা যুদ্ধে জড়াবে না, বরং চিকিৎসা এবং পরামর্শকের দায়িত্ব পালন করবে।
এদিকে গাজায় স্থল অভিযানের পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে ইসরাইল। গাজায় বোমা হামলাও অব্যাহত রেখেছে দেশটি।
এই প্রেক্ষাপটে রক্তাক্ত গাজা থেকে ১০ লাখেরও বেশি বাসিন্দা পালাতে বাধ্য হচ্ছে। তারা সকলে সাথে যা যা নিতে পারছে সেটুকু নিয়েই পালাচ্ছে। ব্যাগে কিংবা স্যুটকেসে, তিন চাকার মোটর বাইকে করে, ব্যাটারি চালিত গাড়িতে, ভ্যানে এমনকি গাধার টানা গাড়িতে করেও কেউ কেউ তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সাথে নিয়ে যাচ্ছে।
বোমা হামলার ভয়ে এবং গাজার দক্ষিণাঞ্চল ছেড়ে দেয়ার ইসরাইলি নির্দেশের কারণে রাস্তা ও জাতিসংঘ পরিচালিত স্কুলসহ যে যেখানে পারছে সেখানে আশ্রয় নিচ্ছে।
গাজার রাফা শহর থেকে পালিয়ে আসা ৫৫ বছর বয়সী মোনা আবদেল হামিদ বলেছেন, ‘বিদ্যুত নেই, পানি নেই, ইন্টারনেট নেই। আমার মনে হচ্ছিল আমি মানবতা হারিয়ে ফেলছি।’
গত শনিবার ফিলিস্তিনি গ্রুপ হামাস ইসরাইলে আকস্মিক বড়ো ধরনের হামলা চালায়। এর পরপরই ইসরাইল গাজায় নির্বিচারে বোমা হামলা শুরু করে। এই হামলা অব্যাহত রয়েছে। এই অবস্থাতেই ইসরাইল গাজায় আকাশ, স্থল ও নৌ হামলা চালানোর প্রস্তৃতি নিয়েছে। একে তারা ‘গুরুত্বপূর্ণ স্থল অভিযান’ হিসেবে বর্ণনা করছে।
এদিকে হামাস ও লেবাননের হিজবুল্লাহকে সমর্থনদানকারী ইরান সতর্ক করে বলেছে, এই ধরনের হামলার জবাব দেয়া হবে।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ান বলেছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং সংঘাতের বিস্তৃতি ঘটবে না এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না।
এদিকে ইসরাইল লেবানন সীমান্তেও গত সপ্তাহে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। বেসামরিক নাগরিকদের জন্যে ওই এলাকা বন্ধ করে দিতে ইসরাইল বাধ্য হয়েছে।
রোববার দক্ষিণ লেবাননের জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী ঘাঁটিতে রকেট আঘাত হানে। ইসরাইলে হিজবুল্লাহর হামলায় একজন নিহত হয়েছে বলে ইসরাইলি সেনা সূত্র নিশ্চিত করেছে।
গত সপ্তাহে লেবাননে অন্তত ১০ জন এবং ইসরাইলে দু’জন নিহত হয়েছে। লেবাননে নিহতদের মধ্যে রয়টার্সের এক সাংবাদিকও রয়েছেন।
ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াভ গ্যালান্ট বলেছেন, উত্তরে যুদ্ধ করার কোনো আগ্রহ তার দেশের নেই। তারা পরিস্থিতিকে আরো তীব্র করতে চাইছেন না।
ইসরাইল দেশটির দক্ষিণে মরুভূমিতে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হাজার হাজার সৈন্যের সমাবেশ ঘটিয়েছে। এসব সৈন্য গাজায় প্রবেশের সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় রয়েছে।
ইসরাইলি সেনাবাহিনী গাজা উপত্যকার উত্তরাঞ্চলের ১১ লাখ ফিলিস্তিনিকে দক্ষিণাঞ্চলে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। অথচ খান ইউনুসসহ পুরো দক্ষিণে ইসর্ইাল অব্যাহত বোমা বর্ষণ করে যাচ্ছে।
এদিকে জাতিসঙ্ঘ, রেডক্রসহ বিদেশী সরকার এবং দাতা সংস্থাগুলো ফিলিস্তনিদের চলে যেতে ইসরাইল যে নির্দেশ দিয়েছে তার সমালোচনা করেছে।
জাতিসঙ্ঘ বলছে, সংঘাতের প্রথম সপ্তাহেই প্রায় ১০ লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এই সংখ্যা আরো বেশিও হতে পারে বলে জাতিসংঘ সতর্ক করেছে।
এদিকে গাজার হাসপাতাল হতাহতদের ভিড়ে উপচে পড়ছে। রোববার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, নির্বিচারে বোমা হামলায় নয় হাজার ছয় শ’ ফিলিস্তিনি আহত হয়েছে।
ইসরাইল নিয়ন্ত্রিত ক্রসিং এবং দক্ষিণে রাফা সীমান্ত মিশর বন্ধ করে দেয়ায় গাজাবাসী কার্যত আটকা পড়েছে।
এদিকে হামাসের হাতে বন্দীদের ইসরাইলিদের নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কিত তেলআবিব।
নয় মাস এবং চার বছর বয়সী শিশুদের খালা ইরাত জাইলার কান্না জড়িত কন্ঠে বলছিলেন, আমরা তাদের জীবিত ফিরিয়ে আনতে চাই। মা’সহ এসব শিশুদের বন্দী করে রেখেছে হামাস।
ফিলিস্তিনি অঞ্চলের জাতিসঙ্ঘ মানবিক সমন্বয়কারী লিন হেস্টিংস সমালোচনা করে বলেছেন, ইসরাইল জিম্মিদের মুক্তির বিনিময়ের সাথে গাজায় মানবিক সহায়তার বিষয়টি যুক্ত করে রেখেছে।
কোন কিছুই শর্তযুক্ত হওয়া উচিত নয় বলে তিনি তার ভিডিও পোস্টে উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, ইসরাইল বলছে তারা হামাসকে ধ্বংস করবে, কিন্তু তাদের বর্তমান গতিবিধিতে মনে হচ্ছে তারা গাজাকেই ধ্বংস করতে যাচ্ছে।
পরিস্থিতি বিবেচনায় জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেস সতর্ক করে বলেছেন, পুরো অঞ্চল এখন এক অতল গহ্বরের কিনারে রয়েছে।
সূত্র : আল জাজিরা, এএফপি এবং অন্যান্য
Leave a Reply